![তৃতীয় বিশ্বের গণতান্ত্রায়ণ ও শিক্ষা পরিস্থিতি](uploads/2023/11/29/1701256702.Hasibul-hasan.jpg)
আধুনিক গণতান্ত্রিক কল্যাণকর রাষ্ট্রের তকমা মুখে ধারণ করে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল অধিকাংশ দেশ নিজেদের তৈরি গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে দাঁড় করাতে গিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলেছে। শাসক চক্র বিশ্বাস করে- শিক্ষা হলো সেই অস্ত্র যা দিয়ে আপনি রাষ্ট্রের মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারবেন। বরঞ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে তথাকথিত শাসক শ্রেণিটির এতে মুনাফা বেশি অশিক্ষা অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে একটি জাতি অগ্রসর হলে তারা কখনো টেকসই উন্নতি করতে পারে না।
গণতন্ত্রের একটি সাধারণ সাদামাটা সূত্র রয়েছে আর সেটি হল সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। সংখ্যা যেদিকে অধিক মাত্রায় প্রভাব বিস্তার করে সেখানে শাসন ক্ষমতা কুক্ষিগত হয় কিন্তু বরাবরের মতোই মানের দিকে নজর না দেওয়ার ফলে সংখ্যা দ্বারাই সমাজের ভালো মন্দ নির্ধারিত হয়, যা শাসনব্যবস্থায় উৎকর্ষ সাধনের জন্য কল্যাণকর নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চাই এবং করে। রাষ্ট্রের সব কিছুতে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয় অন্যদিকে প্রচলিত ব্যবস্থায় অপেক্ষাকৃত প্রাজ্ঞজনেরা হয়ে পড়ে কোনঠাসা,নিগৃহিত আর উপেক্ষিত। সক্রেটিসের ভাষার সমাজে সাধারণের সংখ্যা বেশি হওয়ায় যেহেতু সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের আধিপত্য থাকে বিধায় সেটা কখনও বিবেচনাসুলভ কল্যানকর দূরদর্শী হয়না। এভাবে সমাজে গণতন্ত্রের নামে সাধারণের প্রভাব বিস্তৃত হলে ওই সমাজ ভিতর থেকে হয়ে পড়ে ভঙ্গুর, অস্থিতিশীল, অনমনীয়। এমন সম্ভাবনার কথা আচ করেই পরবর্তীকালে সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টোটল গণতন্ত্রকে মূর্খের শাসন ব্যবস্থা বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। এখানে সমাজের অপেক্ষাকৃত মূর্খরা আধিপত্য বজায় রাখে আর শিক্ষিতরা হয়ে পড়ে তথাকথিত বিচ্ছিন্ন। ফলে যা হবার সেটাই হয় অশিক্ষিতদের দ্বারা একটি অশিক্ষিত সমাজ নির্মাণের পথ প্রশস্ত হয় তারা রাষ্ট্রের সুকুমারবৃত্তির বিকাশ, বৃদ্ধি শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি সবকিছু ভেঙে নিজেদের আদলে তৈরি করে যা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে একটি আত্মবিধ্বংসী প্রচারণা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। একটু পিছনে ফিরে গেলে আমরা দেখবো আধুনিক গণতান্ত্রিক কল্যাণকর রাষ্ট্রের তকমা মুখে ধারণ করে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল অধিকাংশ দেশ নিজেদের তৈরি গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে দাঁড় করাতে গিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলেছে। শিক্ষাব্যবস্থাকে নস্যাৎ করে এমন এক নীতি পদ্ধতি চালু করে যা সমাজ ও রাষ্ট্রের চোখে সার্বজনীন গ্রহণযোগ্য না হয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়। আর একাজে যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন থাকে বিধায় যতই পরিবর্তনের ধোয়া তোলা যাক না কেন প্রাচীন অচলায়তন ভেঙে বের হয়ে আসাটা সহজ না হয়ে আরও কঠিন হয়ে পড়ে। এমন নীতিতে একসময় চিলি, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া ভেনিজুয়েলা, বিশেষ করে ল্যাটিন আমেরিকার উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে চালু ছিল। এই প্রক্রিয়া পরবর্তীতে আফ্রিকার উন্নয়নশীল বহুদেশ বিশেষকরে দক্ষিন আফ্রিকা, মিশর, আলজেরিয়া, তিউনেশিয়া, লিবিয়া, কেনিয়া ইত্যাদি দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। এশীয় অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ অঞ্চলে পরবর্তীকালে এই প্রবণতা সম্বৃদ্ধি লাভ করে। পাকিস্থান প্রতিষ্ঠার পর এটা স্বর্ণযুগে প্রবেশ করে। শুধু তাই নয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে নতুন মোড়কে সামরিক তন্ত্র পেয়ে বসে ক্ষমতার চারপাশে। শিক্ষার ব্যপক বিস্তার না হলে যেখানে গণতন্ত্র সাফল্যমণ্ডিত হয় না সেখানে শাসক শ্রেণি বরাবরই গণতন্ত্রকে সুসংহত করে শিক্ষা বিস্তারের পলিসি গ্রহণ করে যা সবসময়ই ছিল শুভঙ্করের ফাকির সমতুল্য। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার ফাকাবুলিকে নিজেদের অধিকারে নিয়ে ইচ্ছেমতো গড়াপেটা করার কারণে শিক্ষা গুরুত্ব হারাই এবং অনেক জায়গায় গুরুত্বহীন অবস্থায় চরমভাবে ভেঙে পড়ে।
আর এভাবে চলতে চলতে একসময় দেশের মূল কাঠামো হিসেবে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থা উভয়টিই সমূলে ধবংশ হয়ে যায়। পাকিস্তান, নেপাল, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া এমনকি কোরিয়ার মতো দেশের পরে এমন প্রবণতা দেখা যায় বাংলাদেশেও। বাংলাদেশ পর্বে এসে আমরা যদি অতীত নিয়ে বর্তমানকে দেখার চেষ্টা করি তাহলে আমাদের যেতে হবে ১৯৬২ সালের গোড়ার দিকে যখন উভয় পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, অধিকার রক্ষা, আর শিক্ষায় বৈষম্য হ্রাস শাসনতন্ত্রে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করার আন্দোলন তুঙ্গে। বিপ্লব বিদ্রোহের এমন দিনে বঙ্গবন্ধু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ মনেরথে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন পাকিস্তান বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের এই শিক্ষা আন্দোলন কখনো পূর্ণতা পাবে না, কারণ হিসেবে তিনি দেখেছিলেন পশ্চিমা শাসকচক্র তারা সর্বদা চাই তাদের ক্ষমতাকে টেকসই করতে এজন্য তারা গণতন্ত্রকে ভেঙে শিক্ষাকে প্রতিষ্ঠিত করার কথা বলবে পরে প্রয়োজনমতো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাব্যবস্থা দুটোই ধ্বংস করবে। শাসক চক্র কোনদিনই চায়না দেশ, উপনিবেশ প্রকৃত শিক্ষায় এগিয়ে যাক কারণ তারা মনে করে, তারা বিশ্বাস করে শিক্ষা হলো সেই অস্ত্র যা দিয়ে আপনি রাষ্ট্রের মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারবেন। বরঞ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে তথাকথিত শাসক শ্রেণিটির এতে মুনাফা বেশি অশিক্ষা অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে একটি জাতি অগ্রসর হলে তারা কখনো টেকসই উন্নতি করতে পারে না। উপনিবেশিক শোষণ বৈষম্যের কাল পেরিয়ে স্বাধীন বাংলায় একই অবস্থা বর্তমান। গণতন্ত্রের উত্থানের সাথে সাথে শিক্ষা ধ্বংসের নব্য পায়তারা অতীতকে মনে করিয়ে দেয়। শিক্ষা ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আসলে, টেকসই হলে তা কেবল আমাদের দুশ্চিন্তায় বাড়িয়ে তুলবে। তায় এই জাতীয় সংকট থেকে মুক্তির জন্য গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার, পরিবর্তন, ও মেরামত জরুরি।
লেখক: গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষা গবেষক
[email protected]