![’৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ](uploads/2024/01/24/1706092081.Editorial-Bolte-Chai-Arup-Talukder.jpg)
২৪ জানুয়ারি, ১৯৬৯। ওই দিন ছিল দেশব্যাপী হরতাল। নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ওই দিনটি ছিল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী মিছিল-আন্দোলনে মুখরিত একটি ঐতিহাসিক গণ অভ্যুত্থান দিবস। ওইদিন সরকার ঘোষিত সব বাধা উপেক্ষা করে কারফিউ ভঙ্গ করে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ মিছিল বের করেছিল।
প্রকৃতপক্ষে ’৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানই ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান প্রেরণা। অস্বীকার করা যাবে না, ওই সময়ে জনজীবনে চলমান নানা বৈষম্য, অসঙ্গতি এবং সামাজিক নিষ্পেষণের প্রেক্ষাপটে ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছিল গণ অভ্যুত্থানের পটভূমি। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ পরবর্তীকালে তা আরও প্রবল হয়ে দেখা দেয়।
তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের চাকরি-বাকরি, জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বঞ্চনা ও বৈষম্য সৃষ্টির ফলে পাকিস্তানের দুই অংশের জনগণ এবং শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমশ দূরত্বের সৃষ্টি হতে থাকে। এমনকি ’৬৫-এর যুদ্ধকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নিরাপত্তা সম্পর্কেও শাসকগোষ্ঠী ছিল রীতিমতো উদাসীন। তাদের এই অমানবিক আচরণ এ দেশের বাঙালিদের মধ্যে রীতিমতো ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
এর আগে ১৯৬৬ সালে বাঙালি জাতির ত্রাতা শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে যে ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেছিলেন তার প্রভাবও বিপুলভাবে সঞ্চারিত হয়েছিল এর সঙ্গে। আঁধারে আলোক শিখার মতো সেই ছয় দফা দাবিকে বাঙালিরা নিজেদের ‘মুক্তির সনদ’ হিসেবে ধরে নিয়ে পরবর্তীকালে উনসত্তর সালে গণজোয়ারে পরিণত করেছিল।
এর পর আসে ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। সেই মামলাকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার অনুসারী আরও ৩৫ জনকে বিচারের আওতায় আনা হয়। অভিযোগে বলা হয়, বাঙালিদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তার অনুসারীরা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে সমগ্র পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এদের সবাইকে বিচারের মুখোমুখি করার অজুহাতে আটক করে রাখা হয় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে।
একসময় ঢাকায় এই প্রহসনের মামলার বিচার শুরু হয় বিচারপতি এস এ রহমানের নেতৃত্বে। গ্রেফতার করা হয় প্রধান অভিযুক্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে। শেখ মুজিবের গ্রেপ্তার পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বেলে দেয়। পরবর্তীকালে তা ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয় আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে।
তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-নির্যাতন ও সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যের বিরুদ্ধে চরম বহিঃপ্রকাশ ছিল গড়ে ওঠা এই গণ আন্দোলন। ‘বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর আত্মসচেতন সংগ্রামী বাঙালি জাতি এবারেও অসীম সাহসের সঙ্গে পুনরায় নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে নির্ভয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে। ১৯৬৯ সালের শুরু থেকেই পাকিস্তানি সামরিক সরকারবিরোধী শোষিত, বঞ্চিত বাঙালিদের আন্দোলন ক্রমশ প্রবল হয়ে ওঠে।
আন্দোলনের একপর্যায়ে বছরের শুরুতেই ২০ জানুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বিশাল মিছিল বের হয়। সেই মিছিল প্রতিরোধে এগিয়ে আসা পুলিশের গুলিতে নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। তারপর ২৪ জানুয়ারি চলমান আন্দোলন দমনে নিয়োজিত পুলিশ পুনরায় গুলি চালালে নবকুমার ইনস্টিটিউশনের একাদশ শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক, মকবুল, রিকশাচালক রুস্তম আলী এবং আলমগীর- এই চারজন নিহত হন।
সেই সময়ের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সম্পর্কে সংগ্রামী ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘আসাদের গায়ের জামা দিয়ে পতাকা তৈরি করলাম। তার লাশ শহীদ মিনারে রেখে শপথ নিলাম, আসাদ, তোমার রক্ত বৃথা যেতে দেব না... ২৪ জানুয়ারি হরতাল পালিত হয়। পল্টনে লাখ লাখ লোক জমায়েত হয়। ঢাকা শহরের সমস্ত মানুষ রাজপথে নেমে আসে। আগুন জ্বলছে। মানুষের স্রোত পল্টনের দিকে। এই যে মতিউর, মকবুল, রুস্তম ও আলমগীর- এই চারজনকে গুলি করে হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ রাজপথে নেমে এলো। আগরতলা মামলার সাক্ষী, তৎকালীন মন্ত্রী, এমনকি বিচারপতির বাড়িতেও মানুষ আগুন লাগিয়ে দিল।’
ছাত্রনেতা আসাদ, মতিউর ও অন্যদের মৃত্যুর প্রতিবাদে এবং ছাত্রদের ১১ দফা দাবির সমর্থনে আন্দোলনরত বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা একযোগে সব বাধা উপেক্ষা করে বিশাল মিছিলসহকারে রাস্তায় নেমে আসে এবং স্বৈরাচার সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর করে তোলে। ছাত্রসমাজের ১১ দফা দাবির মূল ভিত্তি ছিল ছয় দফা, পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন।
চলমান তীব্র গণ আন্দোলনের মুখে এক সময় পিছু হটতে বাধ্য হয় সামরিক সরকার। মিছিলে স্লোগান ওঠে, ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।’ শেখ মুজিব তখন সমগ্র বাঙালি জাতির মুক্তির দূত হয়ে উঠেছেন এ দেশের কোটি কোটি আন্দোলনরত সংগ্রামী জনতার কাছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি গুলি করে হত্যা করা হয় আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে। তারপর ১৭ ফেব্রুয়ারি, ওই দিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা নিহত হন পুলিশের গুলিতে। এই দুটি ঘটনা আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে আরও কঠোর আন্দোলনের দিকে ঠেলে দেয়। সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি চলে যেতে থাকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
প্রবল আন্দোলনের মুখে আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের ঘোষণা আসে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ২২ ফেব্রুয়ারি মামলার প্রধান অভিযুক্ত শেখ মুজিব এবং অন্য অভিযুক্তদেরসহ সব রাজবন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়।
পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) শেখ মুজিবুর রহমানকে সংবর্ধনা দেওয়া করা হয়। সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাকে ভূষিত করা হয় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে।
এর পরবর্তী ঘটনাগুলো দ্রুতই ঘটতে থাকে। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান উদ্ভূত অচল অবস্থা দূর করার লক্ষ্যে এক জরুরি গোলটেবিল বৈঠক ডাকেন। বৈঠকে সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়।
কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে অবস্থা সামাল দিতে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানকে সরিয়ে ড. এস এন হুদাকে গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় ২৫ মার্চ পাকিস্তানব্যাপী সামরিক শাসন জারি করা হয়।
পরে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের কাছে পদত্যাগসহ ক্ষমতা হস্তান্তর করে রাজনীতি থেকে চিরবিদায় নেন তথাকথিত লৌহমানব প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। এভাবে পরিসমাপ্তি ঘটে ’৫৮ পরবর্তী দীর্ঘ এক দশকব্যাপী আইয়ুবি শাসনের।
লেখক: উপদেষ্টা, বরিশাল বিভাগ, খবরের কাগজ এবং শব্দ সৈনিক
[email protected]