![এই ‘মরণযাত্রা’ কি কখনো শেষ হবে না?](uploads/2024/01/31/1706680907.Arup-Talukder.jpg)
কখনো কখনো এ বিষয়টি ভুক্তভোগী এবং সাধারণ মানুষের কাছে বড় মর্মস্পর্শী হয়ে দেখা দেয়। ভাবনাটা তখনি আসে যখন প্রশ্ন ওঠে, দেশজুড়ে নানা খাতে এত উন্নয়ন হওয়া সত্ত্বেও এসব মানুষ কেন তার শরিক হচ্ছেন না? কেন তারা যেকোনো কাজের খোঁজে বিদেশে যাওয়ার জন্য এত মরিয়া হয়ে ওঠেন? এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তাৎক্ষণিকভাবে কঠিন মনে হলেও কিছুটা চিন্তাভাবনা করে উত্তরটা দেওয়া যায়।
তাছাড়া বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি যেভাবে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের ধারা বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল এবং তার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষ দেশে ও বিদেশে তাদের চাকরি হারিয়েছিলেন, তাদের আর্থিক, পারিবারিক এবং সামাজিক অবস্থা বলা যায় বিপর্যয়ের একেবারে শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল।
পরে করোনার তাণ্ডব স্তিমিত হয়ে আসার পর স্বাভাবিকভাবে বিদেশফেরত শ্রমজীবীরা পুনরায় তাদের কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য রীতিমতো মরিয়া হয়ে ওঠে ছিলেন। কিন্তু অনেকেরই চাকরি ছিল না, তবু তাদের যেকোনোভাবে যেতে হবে নতুন চাকরির সন্ধানে। তারা তখন বৈধ-অবৈধ যেকোনো পথেই হোক তাদের পুরোনো কর্মস্থল বা নতুন কোনো স্থানে গিয়ে নতুন চাকরি সন্ধানে ক্ষেত্রে ছিলেন মরিয়া। বৈধ হলে তবু রক্ষা, কিন্তু অবৈধ পথে দালাল নামের মাফিয়া চক্রের হাতে পড়লে তাদের যে কী অবস্থা হয়, তা অনেক ভুক্তভোগীই জানেন। তবু হাজার হাজার মানুষ সব জেনেশুনেই এক সময় পা বাড়িয়েছিলেন সেই অনিশ্চয়তার পথে।
আমরা দেখেছি, কয়েক বছর আগে থ্যাইল্যান্ডে আমাদের দেশ থেকে আন্তর্জাতিক দালাল চক্রের মাধ্যমে বিশেষ করে, সমুদ্রপথে অবৈধভাবে প্রচুর মানুষকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে তাদের আটকে রেখে কীভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে। পরে কীভাবে বাংলাদেশে থাকা তাদের পরিবারের কাছ থেকে নানা কৌশলে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করা হয়েছে তার খবরাখবর আমরা বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে পেয়েছি।
এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বছরের পর বছর ধরে অনেক মানুষ নানা প্রলোভনে বিভ্রান্ত হয়ে অসৎ আদম ব্যবসায়ীদের হাতে পড়ে সর্বস্ব খুইয়ে বিদেশে গিয়ে তাদের হাতে জিম্মি হয়েছে। অনেকের নির্মম নির্যাতনের কারণে মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে। এসব খবর দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমে বেশ ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে।
সে সময় এসব নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা দেশের সাধারণ মানুষ সোচ্চার হয়েছেন। সভা সেমিনারে এ বিষয় নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে, বিশেষজ্ঞরা নানাভাবে এই অবস্থার বিচার বিশ্লেষণ করেছেন, সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হয়ে ভবিষ্যতে যাতে এরকম কোনো ঘটনা আর না ঘটে সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন।
কিন্তু সেই আশ্বাস বাণীতে ভুক্তভোগী অনেকে আশ্বস্ত হলেও, বেশির ভাগ মানুষ আশ্বস্ত হতে পারেননি। কারণ তারা জানেন, কোনো ধরনের অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটার পর বেশির ভাগ সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এরকম আশার বাণী শুনিয়ে সবাইকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলে থাকেন। পরবর্তী সময়ে যা তেমন কোনো কাজে আসে না। ফলে সামগ্রিকভাবে অবস্থারও তেমন কোনো উন্নতি হয় না। বাস্তব সত্য এটাই।
একটি জাতীয় দৈনিকে বাংলাদেশের মাদারীপুর থেকে ইতালি যাওয়া, যাত্রাপথে অনেকের মৃত্যুসহ নানা সমস্যা ও সংকট নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইতালি উদ্দেশে ২০২১ সালের এপ্রিলে মাদারীপুর সদর উপজেলার মধ্য পেয়ারপুর গ্রামের ২২ বছর বয়সি তরিকুলনিজের ও পরিবারের ভাগ্য ফেরাতে দালালের মাধ্যমে প্রথমে গিয়েছিল ভূমধ্যসাগর পারের আফ্রিকার দেশ লিবিয়ায়।
সেখান থেকে চার মাস পরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে অন্যদের সঙ্গে লিবীয় উপকূল থেকে নৌকায় উঠেছিল, কিন্তু ইতালি পৌঁছানোর আগেই তাদের নৌকাটি ডুবে যায়। ফলে নৌকায় থাকা অন্যদের সঙ্গে নিখোঁজ হয় তরিকুল। সেই থেকে এখন পর্যন্ত তার পরিবার তার কোনো খোঁজখবর পায়নি। ধারণা করা যায়, অন্যদের সঙ্গে তরিকুলেরও সলিল সমাধি ঘটেছে।
একই ধরনের ঘটনার শিকার হয়েছে একই গ্রামের রুবেল নামের ২৭ বছরের আরেক তরুণ। নিখোঁজ সন্তানদের জন্য এই দুই পরিবারের সদস্যদের কান্না এখনো থামেনি। এর আগে এই রকম আরেকটি ঘটনায় নিখোঁজ হয়েছিল ইমন মোল্লা। পরে তারও কোনো খোঁজ খবর পায়নি তার পরিবারের সদস্যরা।
এরকম ঘটনা মাদারীপুরের বিভিন্ন এলাকার অনেক তরুণের বেলায় ঘটেছে। কিন্তু তারপরও এসব এলাকা থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার প্রবণতা কমেছে বলে মনে হয় না। যাদের অনেকের ভাগ্যে লেখা থাকে মৃত্যু।
রাজিব মীর নামের এক তরুণের অভিজ্ঞতাও কম ভয়ংকর নয়। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে দুবাই হয়ে লিবিয়া গিয়েছিল সে। অন্যদের সঙ্গে এক দিন মধ্যরাতে নৌকায় তুলে দেওয়া হয়েছিল তাকে। তখন সাগর ছিল উত্তাল। সেই উত্তাল সাগরের ঢেউয়ের কবলে পড়ে একসময় ডুবে যায় নৌকাটি। যাত্রীরা সাঁতরাতে সাঁতরাতে অনেক কষ্ট করে একসময় নৌকাটিকে আবার ভাসিয়ে ১০৫ জনের মতো যাত্রী তাতে উঠে পড়ে। কিন্তু তরঙ্গ শঙ্কুল সাগরে পুনরায় নৌকায় উঠতে না পারার কারণে ভাগ্যহীন ১৬ জন বাংলাদেশি যাত্রীর সলিল সমাধি ঘটে। সাগর উত্তাল থাকায় শেষ পর্যন্ত নৌকাটি পুনরায় লিবিয়ার উপকূলে ফিরে আসতে বাধ্য হয়।
ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া রাজিব জানিয়েছে, ফিরে আসার পর দালাল চক্র তাদের আরেকটি গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেয়। তারা তাদের কয়েকদিন আটকে রেখে টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে। টাকা দিতে না পারায় শুরু করে মারধর এবং নির্যাতন। চার দিন পর বাধ্য হয়ে বাড়িতে ফোন করে রাজিব। পরে সাড়ে তিন লাখ টাকা পাঠিয়ে তাকে দালাল চক্রের কবল থেকে উদ্ধার করা হয়।
এরপর রাজিব অন্য পথে চলে যায় ত্রিপোলিতে। সেখানে কাজও শুরু করে। তবে কিছুদিন পরে গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। কাশির সঙ্গে রক্ত আসতে থাকে। পরে অন্য এক দালালের মাধ্যম পাসপোর্ট করে দেশে ফিরে আসে। তারপর আর কোথাও যায়নি। এখন বিদেশের কথা উঠলেই বলেন, ‘বেঁচে ফিরেছি, এভাবে আর বিদেশে যেতে চাই না।’
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এভাবে মানব পাচারকারী দালাল চক্রের মাধ্যমে বিদেশে যাওয়ার নজির আছে অসংখ্য, যাদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষই প্রতারিত হয়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন। অনেকের অকালমৃত্যু ঘটেছে বিদেশের বনে বাঁদাড়ে কিংবা সলিল সমাধি ঘটেছে ভূমধ্যসাগর বা অন্য কোনো সমুদ্রে। কেউ কেউ টাকা দিতে না পারার জন্য মিথ্যা মামলায় বিদেশের মাটিতে এখনো জেল খাটছেন বছরের পর বছর।
কিন্তু এরপরও সোনার হরিণের লোভে বিদেশ যাত্রা থামেনি। বন্ধ হয়নি দেশি-বিদেশি ভয়ংকর দালাল চক্রের অবৈধ কার্যক্রম। যদিও আগের চেয়ে আদম ব্যবসায়ীদের ব্যবসা কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে এসেছে, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নানা ধরনের প্রতারণা এবং ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন কাজ খুঁজতে যাওয়া বিদেশগামীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, এভাবে ক্ষমতাধর দালালদের হাতে নির্যাতিত এবং প্রতারিত হওয়ার পরও অধিকাংশ ভুক্তভোগী বা পরিবার মামলা করতে উৎসাহী হন না নানা কারণেঅ যার মধ্যে দীর্ঘসূত্রিতা, হয়রানি এবং পুনরায় প্রচুর অর্থনাশের কারণ থাকে।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আই ও এম জানায়, ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত শুধু ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নিখোঁজ বা মারা গেছে ২২ হাজার ৮৪৫ জন। এদের মধ্যে কারও লাশ উদ্ধার হলেও পাসপোর্ট না থাকার কারণে তাদের সত্যিকার পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি।
ইউরোপীয় কমিশন বলেছে, গত বছর দশকের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে নানাভাবে কেবল ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গেছে ৬৫ হাজারেরও বেশি মানুষ। এদের মধ্যে পাচার হয়ে যাওয়া বিভিন্ন বয়সের শিশু ও নারী-পুরুষদের ব্যবহার করা হয়েছে নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কোথাও আবার নারীদের নিয়োজিত করা হয়েছে পতিতাবৃত্তিতে। কম বয়স্ক পুরুষদের নানা ধরনের অমানবিক কাজসহ বাধ্য করা হয়েছে ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি এবং খুনের মতো অপরাধমূলক কাজে। যাদের বেশির ভাগ মানুষই আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-এর হিসাব অনুযায়ী, বিদেশে বৈধ কর্মসংস্থানের দিক থেকে ২৩তম জেলা হচ্ছে মাদারীপুর। ২০০৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈধভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় গেছেন ওই জেলার ১ লাখ ২৩ হাজার জন। তবে এই হিসাবের বাইরে রয়ে গেছে আরও হাজার হাজার মানুষ যারা ওইসব দেশে অর্থাৎ ইতালি বা ইউরোপে গিয়েছে অবৈধভাবে দালাল চক্রের মাধ্যমে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও যুক্তরাজ্যের বাথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায়, দেশের সবচেয়ে কম দারিদ্র্যের জেলার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মাদারীপুর। শীর্ষে রয়েছে নারায়ণগঞ্জ, যেখানে রয়েছে নানারকম শিল্প- কলকারখানা। এক্ষেত্রে মাদারীপুর শিল্প এলাকা না হয়েও প্রবাসীদের উপার্জনে এই স্থান ধরে রেখেছে। আর এই কারণেই মাদারীপুরের কোনো কোনো স্থানে চমৎকার সব বাড়িঘর উঠেছে, বিভিন্ন পরিবারে সচ্ছলতা এসেছে।
প্রবাসীদের পাঠানো অর্থে প্রাচুর্য এসেছে পারিবারিক তথা সামাজিক অর্থনীতিতেও। কিন্তু এর পেছনে যে অনেক মানুষ এবং পরিবারের অশ্রুসজল মর্মন্তুদ কাহিনি রয়েছে, তা ক’জনে জানে?
এ ছাড়া এখন আবার নতুন করে সমস্যা শুরু হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েতে। সম্প্রতি সে দেশের আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে বেশ কিছু বাংলাদেশি শ্রমিকসহ এক হাজারেরও বেশি প্রবাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কুয়েতের বিভিন্ন প্রান্তে অভিযান চালিয়ে এই প্রবাসীদের গ্রেপ্তার করেছে কুয়েতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বলা হয়েছে, গ্রেপ্তার করা এসব প্রবাসীকে শিগগির তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। এদিকে নতুন করে আবার মানব পাচার সিন্ডিকেটের তৎপরতাও শুরু হয়েছে।
দৈনিক খবরের কাগজে প্রকাশিত এই সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, অবৈধ উপায়ে ইতালিতে অধিবাসী হতে গিয়ে গত ডিসেম্বর মাসে নিখোঁজ হয়েছেন লিবিয়া প্রবাসী টিটল সর্দার। অল্প খরচে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে নৌকায় করে ইতালিতে ঢোকার ব্যাপারে দালাল চক্র তাকে প্রলুব্ধ করেছিল। তার সঙ্গে একই নৌকায় যাওয়ার জন্য চুক্তি করেছিল আরও ৯ জন। লিবিয়া প্রবাসী এরা সবাই ছিল মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার বাসিন্দা। এদের মধ্যে এখনো নিখোঁজ রয়েছে তিনজন। বাকি সাতজন বর্তমানে তিউনেশিয়ায় পাচারকারী চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে রয়েছে। এই দশজনের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে নানা কৌশলে প্রায় সোয়া কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই চক্র। এদের দমন করা যাবে কীভাবে?
লেখক: উপদেষ্টা, বরিশাল বিভাগ, খবরের কাগজ ও শব্দ সৈনিক
[email protected]