বেলাল ইবনে হারিস (রা.) বলেন, “একবার নবিজি (সা.)-এর সঙ্গে আমরা সফরে বের হলাম। তিনি প্রাকৃতিক প্রয়োজনে সাড়া দেওয়ার জন্য বের হলেন। সে সময় কেউ শৌচকর্ম করার জন্য বসতি থেকে দূরে কোথাও যেত। আমি একটি পাত্রে পানি নিয়ে তাঁর পেছন পেছন চললাম। কিছু দূর যাওয়ার পর হঠাৎ নবিজির কাছে এমন হট্টগোল শুনতে পেলাম, যা আমি আগে কখনো শুনিনি। ফিরে এসে তিনি বললেন, ‘কে বেলাল?’ বললাম, ‘জি বেলাল।’ তিনি বললেন, ‘তোমার কাছে পানি আছে?’ বললাম, ‘জি আছে।’ তিনি বললেন, ‘ভালো করেছ, এই বলে তিনি পানি নিয়ে অজু করলেন।’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আপনার কাছে এমন বাগবিতণ্ডা ও শোরগোল শুনলাম যা আগে কখনো শুনিনি।’ তিনি বললেন, ‘মুসলিম জিন ও অমুসলিম জিন উভয়েই আমার কাছে তাদের বসবাসের স্থান করে দিতে বলে। আমি মুসলিম জিনদের ‘আলাস’ এবং অমুসলিম জিনদের ‘গাওর’-এ বসবাস করতে বলি।’ আবদুল্লাহ ইবনে কাসির বলেন, “আমি আমার বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আলাস ও গাওর কি?’ তিনি বলেন, ‘আলাস’ হলো জনবসতিপূর্ণ এলাকা ও পাহাড়, আর গাওর হলো পাহাড়ের উপত্যকা ও সমুদ্র।” (আল মুজামুল কাবির, তাবরানি, হাদিস: ১১৪৩)
আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, “নবিজি ‘কার’ বিশিষ্ট ভূমিতে প্রবেশ করতে নিষেধ করছেন। কারণ সেটা তোমাদের ভাই জিনদের আবাসস্থল। নবিজিকে জিজ্ঞাসা করা হলো—‘কার’ কি? তিনি বলেন, ‘ঘন ঝাড়-জঙ্গল, গাছপালা বিশিষ্ট নিম্নাঞ্চল।” (আল-কামিল ফি জুআফাইর রিজাল, খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ৩১০)
এ ছাড়া জনবসতির শৌচাগার, গোসলখানা, নোংরা ও অপবিত্র স্থান, আবর্জনার স্তূপ এবং কবরস্থানে দুষ্ট জিন-শয়তান বিচরণ করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “নিশ্চয় শৌচাগারে দুষ্ট জিন-শয়তান উপস্থিত থাকে। তাই তোমরা যখন সেখানে প্রবেশ করবে তখন বলবে, বাংলা উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিলান খুবুসি ওয়াল খবাইস।’ বাংলা অর্থ: আমি আল্লাহর কাছে যাবতীয় দুষ্ট পুরুষ ও নারী জিন ও শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।” (আবু দাউদ, হাদিস: ৬)
হাদিসে শৌচাগার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, যেখানে নাপাকি থাকে বা শরীর বস্ত্রহীন করতে হয়, সে সকল স্থানে শয়তানের আনাগোনা থাকে। মানুষকে বিবস্ত্র করা শয়তানের অন্যতম একটি মিশন। কারণ আল্লাহর এবং বান্দার মাঝে আবরণ হলো লজ্জা। আদম ও হাওয়া (আ.) যখন আল্লাহর আদেশ অমান্য করেছিলেন, প্রথমেই তাদের শরীর থেকে জান্নাতি পোশাক খুলে গিয়েছিল।
রাসুলুল্লাহ (সা.) মাটির গর্তে প্রস্রাব করতে নিষেধ করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে সারজিসের সূত্রে কাতাদা (রহ.) বর্ণনা করেন, ‘গর্তে প্রস্রাব করতে নবিজি নিষেধ করছেন। কাতাদাকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘কেন তিনি নিষেধ করছেন?’ কাতাদা বলেন, ‘জিনদের বসবাসের স্থান।” (আবু দাউদ, হাদিস: ২৯)
কবরস্থানে জিনেরা সাধারণত মানুষের মতোই যাওয়া-আসা করে। আবার কখনো অবস্থান করে দীর্ঘদিন। ভালো-মন্দ সব ধরনের, এমনকি সেখানে দুষ্ট প্রকৃতির জিন-শয়তানরাও অবস্থান করে। একটা ভুল ধারণা লোকসমাজে প্রসিদ্ধ আছে, ‘বদকারদের কবরের আজাবের ভয়ে জিনেরা কবরস্থানে থাকে না।’ যেমনভাবে মানুষ কবরস্থানে যেতে ভয় পায়, বিশেষ করে একা একা রাতের বেলা, জিনেরাও তেমনই ভয় পায়। কবরে কাফেরকে প্রশ্নোত্তর করার পরের অবস্থা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘অতঃপর তার জন্য লোহার বিশাল হাতুড়িধারী একজন অন্ধ ও বধির ফেরেশতা নিযুক্ত করা হয়। যদি সে ওই হাতুড়ি দিয়ে পাহাড়কেও আঘাত করে তবে পাহাড় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, সেই ফেরেশতা ওই হাতুড়ি দিয়ে কাফেরকে এমন জোরে আঘাত করে; যার আওয়াজ মানুষ ও জিন ছাড়া পূর্ব-পশ্চিমের সকল সৃষ্টি শুনতে পায়। আঘাতে সে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ধুলায় পরিণত হয়ে যায়। অতঃপর তাকে আবার জীবিত করা হয়।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ৪৭৫৩)
এসব বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, জীবিত মানুষের কবরস্থানে যাওয়া-আসা বা অবস্থান করা যেমন সাধারণ বিষয়, হোক সে ভালো কিংবা খারাপ, মুমিন বা কাফের, তেমনই জিনদের বেলায়ও একই ব্যাপার। কারণ মানুষের মতো তারাও কবরের ভয়ানক আজাব দেখতে বা শুনতে পায় না। তাই কবরস্থানে জিন শয়তান থাকে না; এমন কথা একেবারেই অবান্তর; বরং বিভিন্ন কবরস্থানে মাঝে মধ্যে যে ভৌতিক ঘটনা ঘটে থাকে, তা মূলত সেখানে উপস্থিত জিন-শয়তনেরাই করে থাকে।
যেসব জায়গায় দুষ্ট জিন-শয়তানের আনাগোনা বেশি—
- বাজার ও দোকানপাট। আল্লাহর রাসুল জানিয়েছেন, বাজারে শয়তান তার যুদ্ধের পতাকা উত্তোলন করে। (মুসলিম, হাদিস: ২৪৫১)
- শয়তানরা আঁধারের আগমনকালে ছড়িয়ে পড়ে এবং জড়ো হয়। অর্থাৎ মাগরিবের ওয়াক্তের সূচনাকালে শয়তানরা এদিক-সেদিক ছড়িয়ে যায়। (বুখারি, হাদিস: ৩২৮০)
- আজান শুনলে শয়তানরা পালিয়ে যায়। (বুখারি, হাদিস: ১২২২)
- শয়তান রোদ ও ছায়ার মাঝখানে বসে। (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩৭২২)
লেখক: আলেম, গবেষক ও সাংবাদিক