অন্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া সুন্নাহ। এটা ইসলামে সর্বোৎকৃষ্ট আখলাক হিসেবে বিবেচিত। অন্যকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিনিময়ে মহান আল্লাহ দুনিয়া-আখেরাতে বিপুল সওয়াব দান করবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই পছন্দ করবে, যা নিজের জন্য পছন্দ করে।’ (বুখারি, হাদিস: ১২)
আল্লাহতায়ালা জান্নাতের বিশেষ কিছু নেয়ামত উল্লেখপূর্বক এসব নেয়ামতের অধিকারীদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছেন, ‘(তারাই সেসব নিয়ামত লাভ করবে, যারা...) এবং যারা মিসকিন, এতিম ও বন্দিদের খাবার দান করে তার প্রতি (নিজেদের) আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও। (আর বলে) আমরা তো তোমাদেরকে খাওয়াই শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। তোমাদের থেকে আমরা কোনো প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।’ (সুরা দাহর, আয়াত: ০৯)
রাসুলুল্লাহ (সা.) অন্যদের অগ্রাধিকার দিতেন
সাহল (রা.) থেকে বর্ণিত, “এক নারী রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে একখানা বুরদা (চাদর) নিয়ে এলেন, যা ঝালরযুক্ত ছিল। সাহল (রা.) বললেন, ‘তোমরা জানো, বুরদা কী?’ তারা বলল, ‘চাদর’। সাহল (রা.) বললেন, ‘ঠিক’। নারী বললেন, ‘চাদরখানা আমি নিজের হাতে বুনেছি এবং তা আপনার জন্য নিয়ে এসেছি, যেন আপনি এটি পরিধান করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তা গ্রহণ করলেন এবং তাঁর চাদরের প্রয়োজনও ছিল। তারপর তিনি তা লুঙ্গি হিসেবে পরিধান করে আমাদের সামনে এলেন। তখন এক ব্যক্তি ওই চাদরের সৌন্দর্য বর্ণনা করে বলল, ‘বাহ। এ যে কত সুন্দর। আমাকে তা পরার জন্য দান করুন।’ সাহাবিরা বললেন, ‘তুমি ভালো করোনি, রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজের প্রয়োজনে পরেছেন, তবুও তুমি তা চেয়ে বসলে। অথচ তুমি জানো যে, তিনি কাউকে ফিরিয়ে দেন না।’ ওই ব্যক্তি বলল, ‘আল্লাহর শপথ। আমি তা পাওয়ার উদ্দেশ্যে চাইনি। আমার চাওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য চাদরটি যেন আমার কাফন হয়।’ সাহল (রা.) বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত ওই চাদরই তার কাফন হয়েছিল।’ (বুখারি, হাদিস: ১৯৮৭)
এ ঘটনা থেকে সুন্নতে নববির অভাবনীয় সৌন্দর্য আমরা উপলব্ধি করতে পারি। কারণ একদিকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাদরের প্রয়োজন ছিল, এর বিকল্পও ছিল না তাঁর কাছে। ফলে উপহারটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তা পরে নেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও একজন প্রার্থী যখন সেই প্রয়োজনীয় চাদরটিই চেয়ে বসল, সঙ্গে সঙ্গে তা খুলে তাকে উপহার দিয়ে দিতে সামান্য দেরি করেননি তিনি। কীভাবে অন্যকে অগ্রাধিকার দিতে হয় এটাই তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
অন্যদের অগ্রাধিকার দিলে আল্লাহ খুশি হয়
রাসুলুল্লাহ (সা.) অন্য মুসলিমদেরও এই চমৎকার সুন্নাহ পালনে উদ্বুদ্ধ করেছেন। একে অন্যকে প্রাধান্য দেওয়ার সাহাবায়ে কেরামদের হৃদয়ছোঁয়া ও অশ্রুসিক্তকারী ঘটনা রয়েছে। আবু হুরাইরা রা. বলেন, “এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বলল, ‘আমি খুব ক্ষুধার্ত।’ এরপর তিনি তাঁর কোনো এক স্ত্রীর কাছে লোক পাঠালেন। স্ত্রী বললেন, ‘যে সত্তা আপনাকে সত্য দ্বীন দিয়ে পাঠিয়েছেন তাঁর শপথ। আমার কাছে পানি ছাড়া কিছু নেই।’ তিনি অন্য এক স্ত্রীর কাছে লোক পাঠালে তিনিও একই কথা বললেন। এভাবে সব স্ত্রী একই কথা বললেন যে, ‘সেই সত্তার শপথ। যিনি আপনাকে সত্য দ্বীনসহ পাঠিয়েছেন, আমার কাছে পানি ছাড়া অন্য কিছু নেই।’ তখন তিনি (সাহাবিদের লক্ষ করে) বললেন, ‘আজ রাতে কে লোকটির মেহমানদারি করবে, আল্লাহ তার ওপর রহম করবেন।’ এ সময় এক আনসারি ব্যক্তি উঠে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আমি।’ এরপর লোকটিকে নিয়ে আনসারি নিজের ঘরে গেলেন এবং তার স্ত্রীকে বললেন, ‘তোমার কাছে কি কিছু আছে? সে বলল, না। শুধু বাচ্চাদের জন্য সামান্য কিছু খাবার আছে।’ তিনি বললেন, ‘তুমি বাচ্চাদের অন্য কিছু দিয়ে ভুলিয়ে রাখো। আর যখন মেহমান প্রবেশ করবে, তখন তুমি বাতি নিভিয়ে দেবে। তুমি তাকে দেখাবে যে, আমরাও খাবার গ্রহণ করছি। সে (মেহমান) যখন খাওয়া শুরু করবে, তখন তুমি আলোর কাছে গিয়ে সেটা নিভিয়ে দেবে।’ বর্ণনাকারী বলেন, ‘এরপর তারা বসে রইলেন, আর মেহমান খেতে লাগল। সকালবেলা তিনি (আনসারি) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হলে রাসুল (সা.) তাকে বললেন, ‘আজ রাতে মেহমানের সঙ্গে তোমাদের দুজনের আচরণে আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন।’ (মুসলিম, হাদিস: ২০৫৪)
এই হাদিস থেকে শিক্ষা হলো, আপনার প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও আপনি অন্যের প্রয়োজনকে বড় করে দেখতে পারেন। তাকে অগ্রাধিকার দিতে পারেন। এই কাজের পুরস্কার সামান্য কিছু নয়; বরং এটিই প্রকৃত সফলতা।
লেখক: আলেম ও সাংবাদিক