দস্তরখানা বিছিয়ে খাবার খেতেন: রাসুলুল্লাহ (সা.) দস্তরখানা বিছিয়ে বসে বিসমিল্লাহ বলে খাবার খেতেন। (বুখারি, ৫৩৮৬) ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আমার খালাম্মা একবার রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য কাঁধের গোশত ও দুধসহ কিছু খাবার হাদিয়া পাঠালেন। তিনি খাবারগুলো দস্তরখানার ওপরে রাখলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) দুধ পান করলেন এবং ছাগলের গোশত খেলেন। এই হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, রাসুলুল্লাহ (সা.) দস্তরখানা বিছিয়ে খেতেন। (তুহফাতুল কারি, ১০/৩৫৬)
বিসমিল্লাহ বলে ডান হাত দিয়ে খাবার খেতেন, মধ্যখান থেকে নয়; বরং সামনে থেকে খেতেন: উমর ইবনে আবু সালামা (রা.) বলেন, “আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর লালন-পালনে ছিলাম। খাবারের পাত্রে আমার হাত ছোটাছুটি করত।
রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে বললেন, ‘হে ছেলে, বিসমিল্লাহ বলে ডান হাতে খাও এবং তোমার কাছে থেকে (সম্মুখ) খাও।” (বুখারি, ৫০৬; মুসলিম, ২০২২) রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা বাম হাত দিয়ে খাবার খেয়ো না ও পান করো না। কারণ, শয়তান বাম হাত দিয়ে খাবার খায় ও পান করে।’ (তিরমিজি, ১৯১২) রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘খাবারের মধ্যস্থলে বরকত নাজিল হয়। সুতরাং তোমরা পাশ থেকে খাও, মধ্যস্থল থেকে খেয়ো না।’ (তিরমিজি, ১৮০৫)
বিসমিল্লাহ বলতে ভুলে গেলে অন্য দোয়া পড়তেন: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন তোমরা খানা খেতে শুরু করো, তখন আল্লাহর নাম স্মরণ করো। আর যদি আল্লাহর নাম স্মরণ করতে ভুলে যাও, তাহলে বিসমিল্লাহি আউয়ালুহু ওয়া আখিরুহু বলো।’ (রিয়াজুস সালেহিন, ৭২৯)
একাকী না খেয়ে সম্মিলিতভাবে খাবার খেতেন: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সম্মিলিতভাবে তোমাদের খাবার খাও এবং আল্লাহর নামে খাও; দেখবে তোমাদের খাদ্যে বরকত হবে।’ (আবু দাউদ, ৩৭৬৬; ইবনে মাজাহ, ৩২৮৬) তিনি আরও বলেছেন, ‘তোমরা একসাথে খাও এবং পৃথক হয়ে থেকো না। কারণ জামাতের সঙ্গে বরকত আছে।’ (আবু দাউদ, ৩৭৬৪; ইবনে মাজাহ, ৩২৮৭)
হাত ও আঙুল চেটে খেতেন: রাসুলুল্লাহ (সা.) খাওয়ার সময় সর্বদা হাত চেটে খেতেন। না চাটা পর্যন্ত কখনো হাত মুছতেন না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা যখন খাবার গ্রহণ করো তখন আঙুল চেটে খাও। কারণ বরকত কোথায় রয়েছে, তা তোমরা জানো না।’ (ইবনে মাজাহ, ১৯১৪)
খাবারের লোকমা তুলে খেতেন: খাবার খাওয়ার সময় থালা-বাসন থেকে খাবারের লোকমা বা কিছু ভাত, রুটি কিংবা অন্য খাবার পড়ে যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খাবার সময় যদি কোনো খাবার পড়ে যেত, তাহলে তিনি তা তুলে খেতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের খাবার আহারকালে যদি লোকমা পড়ে যায়, তাহলে ময়লা ফেলে তা খাও। শয়তানের জন্য ফেলে রেখো না।’ (তিরমিজি, ১৯১৫, ইবনে মাজাহ, ৩৪০৩)
হেলান দিয়ে খাবার খেতেন না: কোনো কিছুর ওপর হেলান দিয়ে খাবার খেতে নিষেধ করেছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। আবু হুজাইফা (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে ছিলাম। তিনি এক ব্যক্তিকে বলেন, আমি টেক লাগানো অবস্থায় (হেলান দিয়ে) কোনো কিছু খাই না।’ (বুখারি, ৫১৯০; তিরমিজি, ১৯৮৬)
খাবারের দোষ-ত্রুটি ধরতেন না: আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো খাবারের দোষ-ত্রুটি ধরতেন না। পছন্দ হলে খেতেন আর অপছন্দ হলে পরিত্যাগ করতেন।’ (বুখারি, ৫১৯৮; ইবনে মাজাহ, ৩৩৮২)
খাবারের গরম ভাব দূর করে খেতেন: আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ভাপ না চলে যাওয়া পর্যন্ত কোনো খাবার খাওয়া উচিত নয়।’ (বাইহাকি, ১৯৭৮) তিনি আরও বলেছেন, ‘খাবারের বেশি গরম ভাপ দূর করে খেলে তাতে বরকত বেশি হয়।’ (মুসনাদে আহমাদ, ২৬৪১৮)
খাবারে ও পানিতে ফুঁ দিতেন না এবং পানির পাত্রে নিশ্বাস ফেলতেন না: ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো খাবারে ফুঁ দিতেন না। এমনকি ফুঁ দিতেন না কোনো কিছু পানকালেও।’ (ইবনে মাজাহ, ৩৪১৩)
পানির পাত্রে নিঃশ্বাস ফেলতেও নিষেধ করেছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা (পান করার সময়) পাত্রে নিঃশ্বাস ফেলো না।’ (বুখারি, ১৫৪) আবু সাইদ খুদরি (রা.) বলেন, ‘খাবারে ফুঁ দিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) নিষেধ করেছেন। এ ছাড়া পানির পাত্রে শ্বাস ছাড়তে নিষেধ করেছেন।’ (তিরমিজি, ১৮৮৭) আবু কাতাদা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ পানি পান করবে, পানির পাত্রে যেন শ্বাস না ছাড়ে।’ (তিরমিজি, ১৮৮৯)
অতিভোজন না করে পরিমিত খাবার খেতেন: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মানুষের ভরা পেটের চেয়ে খারাপ পাত্র আর নেই। আদম সন্তানের কোমর সোজা রাখার জন্য কয়েকটি লোকমাই যথেষ্ট। সুতরাং সে যদি তাতে তুষ্ট না হতে পারে, তাহলে (পেটকে তিন ভাগে ভাগ করে নেবে) এক-তৃতীয়াংশ খাদ্যের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানির জন্য এবং অপর এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ঠিক করে নেবে।’ (তিরমিজি, ২৩৮০; ইবনে মাজাহ, ৩৩৪৯) রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুসলিমরা খায় এক পেটে আর কাফেররা খায় সাত পেটে।’ (বুখারি, ৫৩৯৬)
খাবার শেষে কুলি করতেন ও হাত ধুয়ে নিতেন: রাসুলুল্লাহ (সা.) খাবার শেষে কুলি করতেন ও হাত ধুতেন। (বুখারি, ৫৩৯০; মুসনাদে আহমাদ, ২৭৪৮৬) আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘(খাবার পর) হাত না ধুয়ে যে হাতে তরকারি বা গোশতের ঝোল লেগে থাকাবস্থায় শয়ন করে; এর কারণে তার কোনো ক্ষতি হলে, সে যেন নিজেকেই এর জন্য দোষারোপ করে।’ (আবু দাউদ, ৩৮৫২; তিরমিজি, ১৮৬০)
খাবারের পাত্রও চেটে খেতেন: ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) আঙুল ও খাওয়ার পাত্র চেটে খাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, তোমাদের জানা নেই, তোমাদের কোন খাবারের মধ্যে বরকত রয়েছে।’ (মুসলিম, ৫৪২০)
খাওয়ার শুরু ও শেষে দোয়া পড়তেন: রাসুলুল্লাহ (সা.) খাওয়ার শুরু ও শেষে দোয়া পড়তেন। খাওয়ার শুরুতে যে দোয়াটি পড়তেন তা হলো—বাংলা উচ্চারণ: বিসমিল্লাহি ওয়া আলা বারাকাতিল্লাহ। বাংলা অর্থ: আল্লাহর নামে ও তাঁর বরকতের প্রত্যাশায়। (মুসতাদরাকে হাকিম, ৭১৬৩) আর খাওয়ার শেষে যে দোয়াটি পড়তেন তা হলো—বাংলা উচ্চারণ: আলহামদুলিল্লাহিল্লাজি আতয়ামানা ওয়া সাকানা ওয়া জায়ালানা মিনাল মুসলিমিন। বাংলা অর্থ: সব প্রশংসা ওই আল্লাহর, যিনি আমাদের পানাহার করিয়েছেন এবং মুসলমান বানিয়েছেন। (আবু দাউদ, ৩৮৫০)
দস্তরখানা উঠানোর দোয়া পড়তেন: খাবার শেষে দস্তরখানা ও থালা-বাসন উঠানোর সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) এই দোয়াটি পড়তেন। বাংলা উচ্চারণ: আলহামদুলিল্লাহি হামদান কাসিরান তাইয়িবান মুবারাকান ফিহি। গাইরা মাকফিইন ওয়ালা মুয়াদদাইন ওয়ালা মুসতাগনা আনহু রব্বানা। বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ, সমস্ত প্রশংসা তোমার। অধিক প্রশংসা তোমার জন্য, যা পবিত্র ও বরকতময়। হে প্রভু, তোমার অনুগ্রহ থেকে মুখ ফেরানো যায় না। এর অন্বেষণ ত্যাগ করা যায় না এবং এর প্রয়োজন থেকে মুক্ত থাকা যায় না। (বুখারি, ৫৪৫৮)
লেখক: আলেম, গবেষক ও সাংবাদিক