![পর্যটকদের বিশ্বস্ত বন্ধু ক্রেডিট কার্ড](uploads/2024/02/08/1707370906.pro-jab.jpg)
দেশে ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবার একটি বড় অংশ হলো কার্ডে নগদ অর্থ উত্তোলন, শপ বা হোটেল-রেস্টুরেন্টে পেমেন্ট, অনলাইনে কেনাকাটা ও ইএমআই বা ইকুয়্যাল মান্থলি ইনস্টলমেন্টসের আওতায় পণ্য কেনার সুবিধা। ব্যাংকের এই কার্ড সেবা দেশে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পর্যটকদের কাছে এটি বিশেষ ‘এক বন্ধু’।
কার্ড ব্যবহারে বড় সুবিধা পেয়ে থাকেন পেশাগত কাজের প্রয়োজনে বা শখের বশে ভ্রমণকারী ব্যক্তি বা পর্যটক। কার্ডে দেশে ও বিদেশে শহর, নগর বা বন্দরে এমনকি প্রত্যন্ত এলাকাতেও নগদ অর্থ উত্তোলনসহ জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় আর্থিক সব সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। তবে কার্ড ব্যবহারে সুবিধা যেমন বিস্তর, তেমনি আর্থিক ঝুঁকিসহ অসুবিধাও রয়েছে অনেক। এই কার্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে যাবতীয় তথ্য জানা না থাকলে ব্যবহারকারী বড় ধরনের বিপত্তির সম্মুখীন হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতিসহ নানা বিড়ম্বনার সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
ব্যাংকগুলো তাদের কার্ড সেবার আওতায় মোটাদাগে গ্রাহককে তিন ধরনের কার্ড অফার করে থাকে। এগুলো হলো ডেবিট, ক্রেডিট ও প্রি-পেইড কার্ড। এর মধ্যে ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ড গ্রাহককে নানা লোভনীয় অফার দিয়ে থাকে। ক্রেডিট কার্ডের সুদ ও সার্ভিস চার্জ নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বোচ্চ ২০ শতাংশের বেশি সুদ বা মুনাফা নিতে নিষেধ করলেও এ সুদহার ক্ষেত্রবিশেষে ২৪ থেকে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত গড়ায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ জমা পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক খবরের কাগজকে জানান, অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তি করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি স্বতন্ত্র ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। সেখানকার কর্মকর্তারা গুরুত্বের বিচারে অভিযোগ নিষ্পত্তিতে নিয়মিত কাজ করে থাকেন।
সিনিয়র ব্যাংকাররা জানান, ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের বিভিন্ন চাহিদা মেটাতে ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড এবং প্রিপেইড কার্ডসহ বিভিন্ন ধরনের কার্ড অফার করে। কোনো কোনো বেসরকারি ব্যাংক সব কার্ডেই ডুয়েল কারেন্সি সুবিধা দেয়। যার মাধ্যমে দেশে-বিদেশে নিরবচ্ছিন্ন লেনদেন করতে পারেন ক্রেতারা।
রিওয়ার্ড পয়েন্ট, ক্যাশব্যাক অফার, ভ্রমণ সুবিধা এবং জীবনযাত্রার বিভিন্ন অফারের সঙ্গে অনেক সুবিধাসহ বিভিন্ন সেগমেন্টের ক্রেডিট কার্ড অফার করে ব্যাংকগুলো। এসব ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকদের বিভিন্ন খরচের ধরন এবং প্রয়োজনীয়তা মেটানোর লক্ষ্যে ডিজাইন করা হয়েছে। সিনিয়র ব্যাংকাররা বলেন, কার্ড গ্রাহককে নগদ বহনের বিড়ম্বনা ও ঝুঁকি থেকে মুক্তি দেয়। এই কার্ডে বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকেন পর্যটক বা ভ্রমণকারী ব্যক্তি।
কার্ড নিয়ে অভিযোগ প্রসঙ্গে একটি শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকের কার্ড ডিভিশনের প্রধান নাম প্রকাশ না করার অনুরোধে বলেন, ‘ক্রেডিট কার্ড নিয়ে অজ্ঞ গ্রাহকের অভিযোগই বেশি। কারণ তারা কার্ড সম্পর্কিত সব বিষয়ে অবগত নন বা জানা প্রয়োজন মনে করেন না। এ জন্য সংশ্লিষ্ট গ্রাহক বিপাকে পড়েন। তার আর্থিক ক্ষতি হয় এবং একই সঙ্গে ব্যাংকেরও বদনাম হয়।’
ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘একজন সচেতন ও নিয়মিত ক্রেডিট কার্ড গ্রাহক কখনো অভিযোগ করেন না। কারণ তিনি সময়মতো কার্ডের অর্থ ব্যাংকে পরিশোধ করেন এবং বছরজুড়ে কার্ডের আওতায় নানা সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করেন।’
দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ইসলামী ব্যাংকের কার্ড ডিভিশনের প্রধান বলেন, ‘ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহককে একটু ক্যালকুলেটিভ বা অঙ্ক ও তারিখ-সচেতন হতে হবে। কারণ প্রত্যেক ব্যাংক একটি নির্দিষ্ট তারিখে সব কার্ডের স্টেটমেন্ট তৈরি করে তা গ্রাহকের ই-মেইলে পাঠায়। গ্রাহককে এক স্টেটমেন্ট থেকে আরেকটি স্টেটমেন্ট এর অন্তর্বর্তী এক মাস সময়টাকে খুবই সতর্কতার সঙ্গে নগদ অর্থ উত্তোলন এবং পেমেন্ট ও ইএমআই সেবা নিতে হবে। এখানেই ঘটে যতো বিপত্তি।
গ্রাহক দুই স্টেটমেন্টের অন্তর্বর্তী সময়ের মধ্যে অনুমোদিত সীমার অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলন বা পণ্য ও সেবা ক্রয় করলে জরিমানাসহ অতিরিক্ত আর্থিক দায় তৈরি হয়। এটি গ্রাহক বুঝতে পারেন না। ফলে প্রতি মাসেই তার কাছে মনে হয় ব্যাংক বোধহয় বেশি টাকা নিচ্ছে। ওই ব্যাংকার আরও বলেন, কার্ড ব্যবহারকারীকে পিন সংরক্ষণেও সতর্ক হতে হবে, তা না হলে রয়েছে আর্থিক ঝুঁকি।
কার্ডে যত ফি বা চার্জেস
একেক ব্যাংক তার কার্ডে অফার দেওয়া সেবাগুলো ও তার গ্রাহক কর্তৃক ব্যবহারের মাত্রা ও ধরন অনুযায়ী চার্জেস বা ফি আদায় করে থাকে। ধরা যাক, মিডল্যান্ড ব্যাংকের কথা। এ ব্যাংকটি দুই ধরনের ক্রেডিট কার্ড অফার করে থাকে। এ দুই ধরনের কার্ডেই ডুয়েল কারেন্সি সুবিধা পাওয়া যায়।
ভিসা গোল্ড কার্ড এবং প্লাটিনাম কার্ড
ইস্যু বা নবায়ন ফি ৩ হাজার টাকা/ ৪,৫০০
কার্ড রিপ্লেসমেন্ট ফি ৫০০ টাকা/ ৬০০
পিন রিপ্লেসমেন্ট ফি ৪০০ টাকা/ ৫০০
লেট পেমেন্ট ফি ১০০০ টাকা/ ১০ ডলার ও ১২০০ টাকা বা ১৫ ডলার
ওভার লিমিট ফি ৭০০ টাকা বা ১১ ডলার/ ৭০০ টাকা বা ১১ ডলার
বিদেশে নগদ অর্থ উত্তোলন ফি ৩ শতাংশ বা ৪ ডলার, প্রতি ট্রানজ্যাকশন
প্রিন্টেড স্টেটমেন্ট ফি ৩০০ টাকা
স্টেটমেন্ট পুনরুদ্ধার ফি ৫০ টাকা
সুদ ২০ শতাংশ
কার্ড চেক বুক ফি ৩০০ টাকা
কার্ড চেক রিটার্ন ফি ৬০০ টাকা
কার্ড চেক প্রসেসিং ফি ১ দশমিক ৫০ শতাংশ
সার্টিফিকেট ইস্যুর ফি ৩০০ টাকা
ভিসা মানি ট্রান্সফার ৫০ টাকা
ট্রানজ্যাকশন অ্যালার্ট ফি ৩০০ টাকা
মার্কআপ ফি ৩ শতাংশ
ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর কার্ডে এটিএম বুথ থেকে নগদ অর্থ উত্তোলনের ক্ষেত্রে একটি ট্রানজ্যাকশন করে সময়মতো উত্তোলন করা টাকা পরিশোধ করলে ফি মাত্র ১০০ টাকা এবং এর ওপর মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট। সময়মতো নগদ উত্তোলিত অর্থ পুরোটা বা আংশিক পরিশোধ না করলে ১ হাজার ৭২৫ টাকা ‘লেট পেমেন্ট ফি’ ব্যাংক কর্তৃক আদায়যোগ্য হিসেবে সংশ্লিষ্ট ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকের হিসাবে যোগ হবে। এরই মধ্যে আবারো যদি গ্রাহক নগদ অর্থ উত্তোলন করেন, তাহলে প্রতিবার জরিমানা বা পেনাল্টির অর্থ যোগ হবে। এতে ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকের আর্থিক দেনা বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রাপ্ত হিসাবে জানা যায়, দেশে সব ব্যাংকের মোট ইস্যুকৃত কার্ডের সংখ্যা ৪ কোটি ১৬ লাখ ৯৬ হাজার ৪০৫টি। কিন্তু এটি দিয়ে ইউজার বা ব্যবহারকারীর সংখ্যা জানার উপায় নেই। কারণ একই ব্যক্তি একাধিক কার্ড ব্যবহার করে থাকেন। গত নভেম্বরের হিসাবে আরও জানা যায়, একক মাস নভেম্বরে কার্ডে ট্রানজ্যাকশন হয়েছে ৪ কোটি ৫৯ লাখ ৩০ হাজার ১০০ বার। লেনদেন করা অর্থের পরিমাণ ৪২ হাজার ৩৮৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
চার বছর আগে ২০১৯ সালের একক মাস নভেম্বরে কার্ডের সংখ্যা ছিল প্রায় ২ কোটি। ওই মাসে লেনদেনের পরিমাণ ছিল সোয়া ২ কোটির মতো। আর লেনদেনের আর্থিক মূল্য ছিল ১৫ হাজার ৪২ কোটি টাকা। দেশে এখন এটিএম বুথের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। আছে এক ব্যাংকের কার্ড দিয়ে অন্য ব্যাংকের বুথ থেকে নগদ অর্থ উত্তোলনের সুবিধাও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা যায়, গত নভেম্বর মাস শেষে দেশে মোট এটিএম বুথের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৪৩৭টি। এর মধ্যে শহর এলাকায় ৯ হাজার ৪৫৮টি এবং গ্রামাঞ্চলে ৩ হাজার ৯৭৯টি। দেশের বাইরে কার্ড ব্যবহারকারীর জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে ও শহরের বাইরে বুথ সুবিধা একেবারেই সহজলভ্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, গত নভেম্বর মাসে বৈদেশিক মুদ্রায় কার্ডে লেনদেন হয়েছে মোট ১১ লাখ ৪০ হাজার ২০৯টি। লেনদেনের আর্থিক মূল্য ৭৯৮ কোটি টাকা। তথ্য অনুযায়ী বর্তমান সময়ে বিদেশে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর কার্ড ব্যবহার করে লেনদেন হয় গড়ে প্রতি মাসে ৭০০/৮০০ কোটি টাকা। দিনে গড়ে এ লেনদেনের সংখ্যা ৩৮ হাজার ৬টি। প্রতিদিন লেনদেনের আর্থিক মূল্য গড়ে ২৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
এই লেনদেনের পরিমাণ বিগত ৪ বছর আগে ২০১৯ সালে ছিল গড়ে প্রতি মাসে ২৫০ কোটি টাকা। দিনে গড়ে লেনদেনের সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৬০০টি। লেনদেনের মূল্য ছিল ৮ কোটি ১৬ লাখ ২০ হাজার টাকা। গত চার বছরে লেনদেনের সংখ্যা বেড়েছে ১৪৩ শতাংশ বা দেড় গুণ এবং আর্থিক মূল্য বেড়েছে ২২১ শতাংশ বা প্রায় আড়াই গুণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে জানা যায়, গত চার বছরে দেশে সব ব্যাংকের ইস্যুকৃত কার্ডের সংখ্যা বেড়েছে ১১০ শতাংশ। লেনদেন বেড়েছে ১৮১ শতাংশ।
কলি