ঢাকা ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

পর্যটকদের বিশ্বস্ত বন্ধু ক্রেডিট কার্ড

প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:৪১ এএম
আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৫:০৭ এএম
পর্যটকদের বিশ্বস্ত বন্ধু ক্রেডিট কার্ড

দেশে ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবার একটি বড় অংশ হলো কার্ডে নগদ অর্থ উত্তোলন, শপ বা হোটেল-রেস্টুরেন্টে পেমেন্ট, অনলাইনে কেনাকাটা ও ইএমআই বা ইকুয়্যাল মান্থলি ইনস্টলমেন্টসের আওতায় পণ্য কেনার সুবিধা। ব্যাংকের এই কার্ড সেবা দেশে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পর্যটকদের কাছে এটি বিশেষ ‘এক বন্ধু’।

কার্ড ব্যবহারে বড় সুবিধা পেয়ে থাকেন পেশাগত কাজের প্রয়োজনে বা শখের বশে ভ্রমণকারী ব্যক্তি বা পর্যটক। কার্ডে দেশে ও বিদেশে শহর, নগর বা বন্দরে এমনকি প্রত্যন্ত এলাকাতেও নগদ অর্থ উত্তোলনসহ জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় আর্থিক সব সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। তবে কার্ড ব্যবহারে সুবিধা যেমন বিস্তর, তেমনি আর্থিক ঝুঁকিসহ অসুবিধাও রয়েছে অনেক। এই কার্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে যাবতীয় তথ্য জানা না থাকলে ব্যবহারকারী বড় ধরনের বিপত্তির সম্মুখীন হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতিসহ নানা বিড়ম্বনার সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

ব্যাংকগুলো তাদের কার্ড সেবার আওতায় মোটাদাগে গ্রাহককে তিন ধরনের কার্ড অফার করে থাকে। এগুলো হলো ডেবিট, ক্রেডিট ও প্রি-পেইড কার্ড। এর মধ্যে ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ড গ্রাহককে নানা লোভনীয় অফার দিয়ে থাকে। ক্রেডিট কার্ডের সুদ ও সার্ভিস চার্জ নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বোচ্চ ২০ শতাংশের বেশি সুদ বা মুনাফা নিতে নিষেধ করলেও এ সুদহার ক্ষেত্রবিশেষে ২৪ থেকে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত গড়ায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ জমা পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে।

যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক খবরের কাগজকে জানান, অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তি করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি স্বতন্ত্র ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। সেখানকার কর্মকর্তারা গুরুত্বের বিচারে অভিযোগ নিষ্পত্তিতে নিয়মিত কাজ করে থাকেন।

সিনিয়র ব্যাংকাররা জানান, ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের বিভিন্ন চাহিদা মেটাতে ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড এবং প্রিপেইড কার্ডসহ বিভিন্ন ধরনের কার্ড অফার করে। কোনো কোনো বেসরকারি ব্যাংক সব কার্ডেই ডুয়েল কারেন্সি সুবিধা দেয়। যার মাধ্যমে দেশে-বিদেশে নিরবচ্ছিন্ন লেনদেন করতে পারেন ক্রেতারা।

রিওয়ার্ড পয়েন্ট, ক্যাশব্যাক অফার, ভ্রমণ সুবিধা এবং জীবনযাত্রার বিভিন্ন অফারের সঙ্গে অনেক সুবিধাসহ বিভিন্ন সেগমেন্টের ক্রেডিট কার্ড অফার করে ব্যাংকগুলো। এসব ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকদের বিভিন্ন খরচের ধরন এবং প্রয়োজনীয়তা মেটানোর লক্ষ্যে ডিজাইন করা হয়েছে। সিনিয়র ব্যাংকাররা বলেন, কার্ড গ্রাহককে নগদ বহনের বিড়ম্বনা ও ঝুঁকি থেকে মুক্তি দেয়। এই কার্ডে বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকেন পর্যটক বা ভ্রমণকারী ব্যক্তি।

কার্ড নিয়ে অভিযোগ প্রসঙ্গে একটি শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকের কার্ড ডিভিশনের প্রধান নাম প্রকাশ না করার অনুরোধে বলেন, ‘ক্রেডিট কার্ড নিয়ে অজ্ঞ গ্রাহকের অভিযোগই বেশি। কারণ তারা কার্ড সম্পর্কিত সব বিষয়ে অবগত নন বা জানা প্রয়োজন মনে করেন না। এ জন্য সংশ্লিষ্ট গ্রাহক বিপাকে পড়েন। তার আর্থিক ক্ষতি হয় এবং একই সঙ্গে ব্যাংকেরও বদনাম হয়।’

ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘একজন সচেতন ও নিয়মিত ক্রেডিট কার্ড গ্রাহক কখনো অভিযোগ করেন না। কারণ তিনি সময়মতো কার্ডের অর্থ ব্যাংকে পরিশোধ করেন এবং বছরজুড়ে কার্ডের আওতায় নানা সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করেন।’

দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ইসলামী ব্যাংকের কার্ড ডিভিশনের প্রধান বলেন, ‘ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহককে একটু ক্যালকুলেটিভ বা অঙ্ক ও তারিখ-সচেতন হতে হবে। কারণ প্রত্যেক ব্যাংক একটি নির্দিষ্ট তারিখে সব কার্ডের স্টেটমেন্ট তৈরি করে তা গ্রাহকের ই-মেইলে পাঠায়। গ্রাহককে এক স্টেটমেন্ট থেকে আরেকটি স্টেটমেন্ট এর অন্তর্বর্তী এক মাস সময়টাকে খুবই সতর্কতার সঙ্গে নগদ অর্থ উত্তোলন এবং পেমেন্ট ও ইএমআই সেবা নিতে হবে। এখানেই ঘটে যতো বিপত্তি।

গ্রাহক দুই স্টেটমেন্টের অন্তর্বর্তী সময়ের মধ্যে অনুমোদিত সীমার অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলন বা পণ্য ও সেবা ক্রয় করলে জরিমানাসহ অতিরিক্ত আর্থিক দায় তৈরি হয়। এটি গ্রাহক বুঝতে পারেন না। ফলে প্রতি মাসেই তার কাছে মনে হয় ব্যাংক বোধহয় বেশি টাকা নিচ্ছে। ওই ব্যাংকার আরও বলেন, কার্ড ব্যবহারকারীকে পিন সংরক্ষণেও সতর্ক হতে হবে, তা না হলে রয়েছে আর্থিক ঝুঁকি।

কার্ডে যত ফি বা চার্জেস

একেক ব্যাংক তার কার্ডে অফার দেওয়া সেবাগুলো ও তার গ্রাহক কর্তৃক ব্যবহারের মাত্রা ও ধরন অনুযায়ী চার্জেস বা ফি আদায় করে থাকে। ধরা যাক, মিডল্যান্ড ব্যাংকের কথা। এ ব্যাংকটি দুই ধরনের ক্রেডিট কার্ড অফার করে থাকে। এ দুই ধরনের কার্ডেই ডুয়েল কারেন্সি সুবিধা পাওয়া যায়।

ভিসা গোল্ড কার্ড এবং প্লাটিনাম কার্ড
ইস্যু বা নবায়ন ফি ৩ হাজার টাকা/ ৪,৫০০
কার্ড রিপ্লেসমেন্ট ফি ৫০০ টাকা/ ৬০০
পিন রিপ্লেসমেন্ট ফি ৪০০ টাকা/    ৫০০
লেট পেমেন্ট ফি ১০০০ টাকা/ ১০ ডলার ও ১২০০ টাকা বা ১৫ ডলার
ওভার লিমিট ফি ৭০০ টাকা বা ১১ ডলার/ ৭০০ টাকা বা ১১ ডলার
বিদেশে নগদ অর্থ উত্তোলন ফি ৩ শতাংশ বা ৪ ডলার, প্রতি ট্রানজ্যাকশন
প্রিন্টেড স্টেটমেন্ট ফি ৩০০ টাকা
স্টেটমেন্ট পুনরুদ্ধার ফি ৫০ টাকা
সুদ ২০ শতাংশ 
কার্ড চেক বুক ফি ৩০০ টাকা
কার্ড চেক রিটার্ন ফি ৬০০ টাকা
কার্ড চেক প্রসেসিং ফি ১ দশমিক ৫০ শতাংশ 
সার্টিফিকেট ইস্যুর ফি ৩০০ টাকা
ভিসা মানি ট্রান্সফার ৫০ টাকা
ট্রানজ্যাকশন অ্যালার্ট ফি ৩০০ টাকা
মার্কআপ ফি ৩ শতাংশ

ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর কার্ডে এটিএম বুথ থেকে নগদ অর্থ উত্তোলনের ক্ষেত্রে একটি ট্রানজ্যাকশন করে সময়মতো উত্তোলন করা টাকা পরিশোধ করলে ফি মাত্র ১০০ টাকা এবং এর ওপর মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট। সময়মতো নগদ উত্তোলিত অর্থ পুরোটা বা আংশিক পরিশোধ না করলে ১ হাজার ৭২৫ টাকা ‘লেট পেমেন্ট ফি’ ব্যাংক কর্তৃক আদায়যোগ্য হিসেবে সংশ্লিষ্ট ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকের হিসাবে যোগ হবে। এরই মধ্যে আবারো যদি গ্রাহক নগদ অর্থ উত্তোলন করেন, তাহলে প্রতিবার জরিমানা বা পেনাল্টির অর্থ যোগ হবে। এতে ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকের আর্থিক দেনা বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রাপ্ত হিসাবে জানা যায়, দেশে সব ব্যাংকের মোট ইস্যুকৃত কার্ডের সংখ্যা ৪ কোটি ১৬ লাখ ৯৬ হাজার ৪০৫টি। কিন্তু এটি দিয়ে ইউজার বা ব্যবহারকারীর সংখ্যা জানার উপায় নেই। কারণ একই ব্যক্তি একাধিক কার্ড ব্যবহার করে থাকেন। গত নভেম্বরের হিসাবে আরও জানা যায়, একক মাস নভেম্বরে কার্ডে ট্রানজ্যাকশন হয়েছে ৪ কোটি ৫৯ লাখ ৩০ হাজার ১০০ বার। লেনদেন করা অর্থের পরিমাণ ৪২ হাজার ৩৮৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।

চার বছর আগে ২০১৯ সালের একক মাস নভেম্বরে কার্ডের সংখ্যা ছিল প্রায় ২ কোটি। ওই মাসে লেনদেনের পরিমাণ ছিল সোয়া ২ কোটির মতো। আর লেনদেনের আর্থিক মূল্য ছিল ১৫ হাজার ৪২ কোটি টাকা। দেশে এখন এটিএম বুথের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। আছে এক ব্যাংকের কার্ড দিয়ে অন্য ব্যাংকের বুথ থেকে নগদ অর্থ উত্তোলনের সুবিধাও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা যায়, গত নভেম্বর মাস শেষে দেশে মোট এটিএম বুথের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৪৩৭টি। এর মধ্যে শহর এলাকায় ৯ হাজার ৪৫৮টি এবং গ্রামাঞ্চলে ৩ হাজার ৯৭৯টি। দেশের বাইরে কার্ড ব্যবহারকারীর জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে ও শহরের বাইরে বুথ সুবিধা একেবারেই সহজলভ্য।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, গত নভেম্বর মাসে বৈদেশিক মুদ্রায় কার্ডে লেনদেন হয়েছে মোট ১১ লাখ ৪০ হাজার ২০৯টি। লেনদেনের আর্থিক মূল্য ৭৯৮ কোটি টাকা। তথ্য অনুযায়ী বর্তমান সময়ে বিদেশে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর কার্ড ব্যবহার করে লেনদেন হয় গড়ে প্রতি মাসে ৭০০/৮০০ কোটি টাকা। দিনে গড়ে এ লেনদেনের সংখ্যা ৩৮ হাজার ৬টি। প্রতিদিন লেনদেনের আর্থিক মূল্য গড়ে ২৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

এই লেনদেনের পরিমাণ বিগত ৪ বছর আগে ২০১৯ সালে ছিল গড়ে প্রতি মাসে ২৫০ কোটি টাকা। দিনে গড়ে লেনদেনের সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৬০০টি। লেনদেনের মূল্য ছিল ৮ কোটি ১৬ লাখ ২০ হাজার টাকা। গত চার বছরে লেনদেনের সংখ্যা বেড়েছে ১৪৩ শতাংশ বা দেড় গুণ এবং আর্থিক মূল্য বেড়েছে ২২১ শতাংশ বা প্রায় আড়াই গুণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে জানা যায়, গত চার বছরে দেশে সব ব্যাংকের ইস্যুকৃত কার্ডের সংখ্যা বেড়েছে ১১০ শতাংশ। লেনদেন বেড়েছে ১৮১ শতাংশ।

কলি

ঘুরে এলাম নিঝুম দ্বীপ

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১২:১৭ পিএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১২:১৭ পিএম
ঘুরে এলাম নিঝুম দ্বীপ

অনেক দিন থেকেই হ্যাংআউটে বের হওয়া হচ্ছিল না। একটা রিফ্রেশমেন্টের খুব প্রয়োজন ছিল। তাই হঠাৎ করেই তিন বন্ধু মিলে ঠিক করলাম, পরীক্ষা শেষ হতেই নিঝুম দ্বীপ ট্যুরে যাব এবং রীতিমতো অ্যাডভেঞ্চার করব।

নিঝুম দ্বীপ সম্পর্কে একটু প্রাথমিক ধারণা দিয়ে রাখি। এটা বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মাঝে নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত উপজেলা হাতিয়া দ্বীপের পাশে (হাতিয়া থেকে ৬০ কি.মি. দক্ষিণে) অবস্থিত ৬৩ বর্গমাইল আয়তনের একটি ছোট দ্বীপ।

তো পরীক্ষা শেষ হতেই আমরা রওনা হয়ে গেলাম। বাসে করে চলে এলাম সদরঘাট। উঠলাম এমভি ফারহান ৩-এ। বিশাল লঞ্চ, ডোবার আশঙ্কা কম। ঠিক সাড়ে ৫টায় লঞ্চ ছেড়ে দিল। লঞ্চের সর্বশেষ গন্তব্য হাতিয়া দ্বীপের তমরুদ্দিন ঘাট। আমরা ওখানেই যাব। জার্নিটা ছিল মোট ১৭ ঘণ্টার। রাতে চাঁদের আলোতে লঞ্চের ছাদে উঠেছিলাম। ছাদের সে আড্ডায় আমাদের খাঁচা-ছাড়া মনের কথাগুলো জোছনার মতো ঝরছিল।

সকালে মনপুরায় মালামাল নামাতে লঞ্চ থামল প্রায় ১ ঘণ্টা। আমরাও টুপ করে নেমে গেলাম মনপুরা দ্বীপে। সকালের নাশতাটা সেখানেই সেরে ফেললাম। ৯টার দিকে পৌঁছলাম আমাদের গন্তব্যে- হাতিয়া দ্বীপের তমরুদ্দিন ঘাটে।

নিঝুম দ্বীপ যেতে হলে হাতিয়া দ্বীপের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে হয়। যাওয়ার উপায় দুটি। সরাসরি বাইকে, সেক্ষেত্রে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ২০০-৩০০ টাকা। অথবা তমরুদ্দিন ঘাট থেকে জাহাজমারা ঘাট পর্যন্ত বেবিট্যাক্সিতে। ভাড়া জনপ্রতি ১০০ টাকা। এরপর জাহাজমারা থেকে মোক্তারিয়া ঘাট/নিঝুম দ্বীপ ঘাট পর্যন্ত বাইকে জনপ্রতি ১০০ টাকা। বলে রাখি- তমরুদ্দিন ঘাট থেকে সরাসরি বেবিট্যাক্সি নেবেন না। কেননা জাহাজমারারও কিছুদূর পর পর্যন্ত পাকা রাস্তা, কিন্তু এরপরের রাস্তা এতটাই খারাপ যে, বেবিট্যাক্সি প্রায় সময়ই উল্টে যায়। মোক্তারিয়া ঘাটে এলেই আপনি প্রথম দেখতে পাবেন ওপারের নিঝুম দ্বীপ।

মোক্তারিয়া ঘাট থেকে নদী পার হতে হবে ইঞ্জিন নৌকায়। সময় লাগে ৫ মিনিট, ভাড়া জনপ্রতি ১৫ টাকা। নদী পার হলেই চলে আসবেন স্বপ্নের সেই নিঝুম দ্বীপে!

আমরা নিঝুম দ্বীপে নেমেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলাম। আসল গন্তব্য কিন্তু নিঝুম দ্বীপের অপর প্রান্তের নামাবাজার। এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তের ১৪ কি.মি. পাকা রাস্তা আছে। আমরা সাথে দ্বীপের সব ধরনের ম্যাপ নিয়েছিলাম। সাথে ছিল কম্পাস। প্ল্যান ছিল এ ট্যুরে সর্বোচ্চ মাত্রায় পরিশ্রম করব, অ্যাডভেঞ্চার করব। কম্পাস আর ম্যাপ দেখে দিক বুঝে নিজেরাই ঘোরাঘুরি করব এবং সে হিসেবে দ্বীপে নামার পর ও-প্রান্তে হেঁটেই চলে যাব।

কিন্তু দ্বীপ যে নেহায়েতই ছোটও নয়, রাস্তা যে ১৪ কি.মি., সে ধারণা ছিল না। বন্দরটিলা বাজার পার হয়ে অনেক দূর আসার পর যখন শুনলাম নামাবাজার আরও ১১ কি.মি. দূরে, তখন আমরা পাথর বহনকারী একটা লরিভ্যানে উঠলাম। লরিটি আমাদের পাকা রাস্তা শেষের প্রায় কাছাকাছিতে নামিয়ে দিল এবং আমাদের থেকে কোনো ভাড়াই নিল না।

মাঝের কিছু অংশ রাস্তা বনের ভেতর দিয়ে গেলেও বাকি রাস্তার ডানপাশে ছিল বন আর বামপাশে ছিল সমুদ্র। এরপরের ৩ কি.মি. রাস্তা এখনো কাঁচা, তবে রাস্তা পাকাকরণের কাজ চলছে দেখে এসেছি। বাকি রাস্তা আমরা হেঁটেই চলে এলাম। অবশেষে লঞ্চ ছাড়ার ২১ ঘণ্টা পর দুপুর সাড়ে ১২টায় প্রকৃত গন্তব্য নিঝুম দ্বীপের নামাবাজারে এসে পৌঁছলাম।

সেখানে দুপুরের লাঞ্চ সেরে বিশ্রাম নিয়ে চলে গেলাম পাশের পুলিশ ফাঁড়িতে। কারণ বনে ঘোরার এবং রাতে সমুদ্রের পাড়ে ক্যাম্প করার ব্যাপারে অনুমতি নিতে হবে। শুনেছিলাম পুলিশের অনুমতি পেতে অনেক ঝামেলা হয়। স্টুডেন্টশিপের প্রমাণ দিতে হয়... হেন-তেন। কিন্তু সেখানে সম্পূর্ণই ভিন্ন অভিজ্ঞতা হলো। দ্রুতই অনুমতি পেয়ে গেলাম।

হরিণ থাকে বনের একদম ভেতরে। ওরা বের হয় বনের ডানপাশের নদীর দিকে। আরও একটা কথা, হরিণ বের হয় শুধু আসরের পর। অর্থাৎ হরিণ দেখার সময় আসর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। প্ল্যান করলাম, হেঁটে বনের ভেতর দিয়ে ওপাশে চলে যাব। বনে ঢুকতেই টের পেলাম, একা একা বনে যাওয়া সহজ কথা নয়। যতই ম্যাপ আর কম্পাস থাক, শ্বাসমূল ভরা বনে প্রচুর রাস্তা। ঠিক কোন রাস্তা দিয়ে গিয়েছিলেন তা মনে রাখা দুষ্কর তো বটেই, এর থেকেও বড় সমস্যা বনের মাঝের খালগুলো। যেগুলো পারাপারের কোনো সাঁকো নেই। একমাত্র উপায় ট্রলার অথবা নৌকা।

অবশেষে একটা নৌকা ভাড়া করলাম ৭০০ টাকা দিয়ে। নদী হয়ে ঘুরে বনের ওপাশে চৌধুরীর খাল দিয়ে বনে ঢুকলাম। ঢুকতেই একদম কাছ দিয়ে এক পাল বন্য মহিষ খাল পার হয়ে গেল। বনের ভেতরে একটু ঢুকতেই দেখা পেয়ে গেলাম সোনার হরিণের। আস্তে আস্তে ওদের কাছে যেতে লাগলাম। কিন্তু সমস্যা হলো, সমস্ত বনে শুকনা পাতা বিছানো। চলতে গেলে এগুলোয় পাড়া পড়বেই। আর শব্দ হলেই হরিণ চলে যাবে। হরিণ অনেক দূর থেকে শুনতে পায়, তাই আস্তে কথা বলাও নিষেধ। সম্পূর্ণ ইশারায় আমরা তিনজন ও মাঝি দুজন তিন দিক থেকে ৩টি ডিজিটাল ক্যামেরা নিয়ে ভেতরে ঢুকতে লাগলাম। বিশ্বাস করেন, প্রেমিকার কাছে প্রেম নিবেদনের সময় যেমন হার্টবিট বেড়ে যায়, তেমনি হার্টবিট বেড়ে গিয়েছিল। হয়তো একটু অসতর্কতায় পাতার ওপর দিয়ে চলার শব্দে হরিণ চলে যাবে। আমার ভুলে অন্য তিনজনেরও হরিণের ফটো তোলা হবে না। গেরিলা হয়ে মাটি ঘেঁষে একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল, হার্টবিটের শব্দেই বুঝি হরিণ চলে যাবে!

কিন্তু না, হরিণ চলে গেল পাখির শব্দে। হঠাৎ গাছের ডালে বসা পাখিরা এমন কিচির-মিচির শব্দ করা শুরু করল, সে শব্দেই হরিণ ভাইয়া সিগনাল পেয়ে গেল। দিল দৌড়। আমরা কিছুক্ষণ গাছের আড়ালে মাটিতে গামছা বিছিয়ে শুয়েও ছিলাম। মনে আশা, আধঘণ্টা বা এক ঘণ্টা পর হরিণ আবার আসবে। তখন কাছ থেকে দেখা যাবে। কিন্তু বুঝতে পারলাম এদিকে যেহেতু ঝামেলা হয়েছে, সেহেতু এদিকে হরিণ আর আসবে না।

বনের ভেতরে ঢোকা শুরু করলাম। বেশ খানিক যাওয়ার পর দেখলাম এক পাল হরিণ হেঁটে যাচ্ছে। পাশে হরিণ শাবকও লাফাতে লাফাতে চলে গেল। ফেরার পথে বন থেকে শুকনো কাঠ নিয়ে এলাম, যাতে রাতে ক্যাম্পে ফায়ারিং করতে পারি।

সৈকতে লাকড়ি ফেলে কাছের বাজারে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে এলাম। ফিরে এসে প্রথমেই ক্যাম্প করে ফেললাম। ক্যাম্প বানাতে স্বেচ্ছায় সাহায্য করলেন গ্রামের এক চাচা। এমনকি কেরোসিন দেওয়ার পরও যখন লাকড়িতে আগুন ধরছিল না, তখন চাচা পাশের এক খেজুর গাছে উঠে শুকনো ডাল পেড়ে আনলেন। আগুন জ্বলল।

ইচ্ছা ছিল পূর্ণিমার রাতে একই সাথে জোছনাস্নান ও সমুদ্রস্নান করব। কিন্তু খেয়ালই ছিল না, রাতে ভাটা থাকে। সে সময় সমুদ্রে নামা যায় না। আমরাও পরিশ্রমে ক্লান্ত ছিলাম। তাই এক সময় আগুন নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। মাঝরাতের পর হঠাৎ প্রচণ্ড আলোতে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি চাঁদের আলো এত তীব্র, এত তীব্র হয়েছে যে, আমাদের ক্যাম্পের ত্রিপল ভেদ করে চোখে পড়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। আর থাকতে পারলাম না, তাঁবু থেকে বের হয়ে এলাম। দেখি চাঁদের আলোর সত্যিই বাঁধ ভেঙেছে। চারপাশ একদম দিনের মতোই পরিষ্কার। সে আলোয় আমরা সমুদ্র পাড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটলাম। সমুদ্রপাড় থেকে ফিরে আসতেই পূর্ব আকাশে সূর্য দেখা দিল। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাজারে এলাম সকালের নাশতার জন্য।

নাশতার পর হোটেলে উঠেই দিলাম ঘুম। এক ঘুমেই দুপুর। ঘুম থেকে উঠেই চলে এলাম সৈকতে। সমুদ্রস্নানের পর পাড়ে বসে বিশ্রাম নিলাম। ঘুড়ি বানিয়ে ওড়ালাম অনেকক্ষণ। হরিণ দেখা তো হয়েছেই, শুধু ফটো তোলা হয়নি।

কিন্তু ক্যামেরায় তো চার্জ নেই। তাই আর বনে না গিয়ে দ্বীপটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। রাতে ফানুশ ওড়ালাম। এরপর উঠলাম সৈকত থেকে বের হওয়া খালে থাকা মাঝধরা ট্রলারে, তাদের সাথে গল্পগুজব করলাম।

হাতিয়া থেকে ঢাকার লঞ্চ ছাড়ে সাড়ে ১২টায়। তাই পরদিন ভোরে উঠে নাশতা সেরেই রওনা হলাম ঢাকার উদ্দেশে। ভালোমতো ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। বারবার চেক করে নিলাম সবকিছু ঠিকঠাক মতন নিয়েছি কি না। কিন্তু তারপরও নিঝুম দ্বীপ ছেড়ে আসার সময় থেকে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, কি যেন নিয়ে আসিনি, কি যেন ফেলে এসেছি, কি যেন রেখে এসেছি!

জাহ্নবী

পর্যটকশূন্য শ্রীমঙ্গল

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৪, ০৩:৩২ পিএম
আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২৪, ০৪:০৬ পিএম
পর্যটকশূন্য শ্রীমঙ্গল
ছবি : খবরের কাগজ

চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতার কারণে গত ১৯ জুলাই থেকে কারফিউ থাকায় পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে চায়ের শহর শ্রীমঙ্গল। কারফিউ ও তার আগে থেকে চলা আন্দোলনের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে শ্রীমঙ্গলের পর্যটনখাতে।

বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) সরেজমিনে দেখা যায়, শহরের হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট ও কটেজগুলোতে শূন্যতা বিরাজ করছে। খাঁ খাঁ করছে পর্যটন স্পটগুলো। ফলে ক্ষতির মুখে পড়েছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।

শ্রীমঙ্গলের পাঁচতারকা মানের রিসোর্ট গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট ও গলফের জেনারেল ম্যানেজার আরমান খান খবরের কাগজকে জানান, শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলন ও কারফিউয়ে খারাপ প্রভাব পড়েছে পর্যটনখাতে। ১৫ জুলাই থেকেই শ্রীমঙ্গলে পর্যটক আসা কমে গিয়েছিল। ১৯ জুলাই কারফিউ জারির পর থেকে তো আর কোনো পর্যটকের আসারও সুযোগ নেই। বিদেশি পর্যটকরাও ইন্টারনেট সমস্যায় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। 

শ্রীমঙ্গলের চামুং রেস্টুরেন্ট ও ইকো ক্যাফের সত্বাধিকারী তাপস দাশ বলেন, ‘আমাদের ব্যবসাটাই পর্যটক কেন্দ্রিক। পর্যটক না আসলে আমাদের প্রতিদিন লোকসান দিতে হয়। কারফিউ জারির পর থেকেই আমাদের রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখতে হয়েছে। রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকলেও প্রতিদিন রেস্টুরেন্টের কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ বিল, পানি বিলসহ আনুষাঙ্গিক খরচ আমাদের ঠিকই বহন করতে হচ্ছে। কারফিউয়ের কারণে পর্যটকরা তো আসতে পারছেনই না, পাশাপাশি স্থানীয়রাও ঘুরতে বের হচ্ছেন না।’

গ্রিন লিফ গেস্ট হাউসের সত্বাধিকারী ও শ্রীমঙ্গল পর্যটন সেবা সংস্থার সাংগঠনিক সম্পাদক এসকে সুমন বলেন, ‘কারফিউ জারির আগের দুই-একদিন কয়েকজন পর্যটক ছিলেন। কিন্তু গত ১৮ তারিখ থেকে সারাদেশে পরিস্থিতি উতপ্ত হয়ে উঠলে তারাও ফিরে যান। কারফিউ জারির পর থেকে পুরোপুরি গেস্ট হাউস বন্ধ করে বসে আছি। এভাবে চলতে থাকলে বেশিদিন পর্যটন ব্যবসায় টিকে থাকতে পারব না।’

কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ট্যুর গাইড সাজু মারছিয়াং বলেন, ‘কারফিউয়ের প্রভাবে উদ্যানে পর্যটকরা আসছেন না। আমরা ট্যুর গাইডরা পর্যটকদের বিভিন্ন পর্যটন স্পট ঘুরিয়ে দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি। পর্যটকরা না আসায় আমরা বেকার হয়ে পড়েছি।’

বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, পর্যটকশূন্য হওয়ায় ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলোও নেই। ক্রেতার অভাবে দোকান নিয়ে বসছেন না তারা।

শহরের বধ্যভূমির সামনের ভ্রাম্যমাণ আনারস বিক্রেতা দুলাল মিয়া বলেন, ‘গণ্ডগোলের কারণে মানুষ ঘুরতে আসে না। মানুষ না আসার কারণে আমরাও দোকান নিয়ে বসি না।’

এদিকে কারফিউ জারির পর কয়েকজন পর্যটক শ্রীমঙ্গলে আটকা পড়েছিলেন। বুধবার থেকে সীমিত আকারে ব্যাংক ও যানবাহন চালুর পর তারা শ্রীমঙ্গল ছেড়ে যেতে পেরেছেন বলে জানিয়েছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা।

হৃদয় শুভ/জোাবইদা/অমিয়/

এক বৃষ্টির দিনে রাতারগুলে

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৪, ১২:৪৬ পিএম
আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৪, ১২:৪৬ পিএম
এক বৃষ্টির দিনে রাতারগুলে
রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট

প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় ও সেতুবন্ধন তৈরির অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ভ্রমণ। ভ্রমণ মানেই প্রশান্তি এবং আনন্দ। তাই তো যখনই সময় পাই, প্রকৃতির কাছে ছুটে যাই। কারণ প্রকৃতি আমাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য লাভের আশায় আমিও মাঝে মধ্যে ব্যাকুল হয়ে উঠি। অনেক দিন ধরে আমাদের পরিকল্পনায় ছিল সিলেট ভ্রমণ। এর আগেও সিলেটে ভ্রমণ করেছি। তবে সেটা ছিল ঝটিকা সফর। শুনেছি বৃষ্টিতে সিলেট নাকি অন্য রূপে সাজে। তাই বৃষ্টির দিনেই সিলেটে রওনা হলাম।

তিন দিনের সফরের দ্বিতীয় দিনে আমাদের গন্তব্য ছিল রাতারগুল। নিয়ম অনুযায়ী আমরা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। কিন্তু তখন অনেক বৃষ্টি হচ্ছিল। হোটেলের জানালা থেকে বাইরের রাস্তা দেখা যায়। আমাদের গাড়ি ইতোমধ্যে চলে এসেছে। তবে বৃষ্টির কারণে কেউই নামতে চাইছে না। সকাল ৭টায় বৃষ্টি কিছুটা কমলে আমরা হোটেল থেকে বের হই। পাশের একটি হোটেলে সকালের নাশতা শেষ করে গাড়িতে উঠি। আমাদের গন্তব্য ‘রাতারগুল’।

বর্ষায় বাংলার অ্যামাজন নামে পরিচিত সিলেটের গোয়াইনঘাটের রাতারগুল আমাদের তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে। রাতারগুল আমাদের দেশের একমাত্র ‘ফ্রেশওয়াটার সোয়াম্প ফরেস্ট’ বা জলাবন। সিলেট থেকে দেশের একমাত্র স্বীকৃত এই সোয়াম্প ফরেস্টের দূরত্ব প্রায় ২৬ কিলোমিটার। সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর ইউনিয়নে এ জলাবনের অবস্থান।

উত্তরে মেঘালয় থেকে নেমে আসা স্রোতস্বিনী গোয়াইন নদী, দক্ষিণে বিশাল হাওর; মাঝখানে জলাবন রাতারগুল। উইকিপিডিয়ায় পাওয়া তথ্যমতে পৃথিবীতে স্বাদুপানির জলাবন আছে মাত্র ২২টি। ভারতীয় উপমহাদেশ আছে দুটি। একটা শ্রীলঙ্কায়, আরেকটি আমাদের রাতারগুলে। অনিন্দ্যসুন্দর বিশাল এ বনের সঙ্গে তুলনা চলে একমাত্র অ্যামাজনের। রেইন ফরেস্ট নামে পরিচিত হলেও বিশ্বের স্বাদুপানির সবচেয়ে বড় জলাবন কিন্তু এটিই।

সিলেটের স্থানীয় ভাষায় মুর্তা বা পাটিগাছ ‘রাতাগাছ’ নামে পরিচিত। সেই মুর্তা অথবা রাতাগাছের নামানুসারে এই বনের নাম হয়েছে রাতারগুল। অ্যামাজনের মতোই এখানকার গাছগাছালির বেশির ভাগ অংশ বছরে চার থেকে সাত মাস পানির নিচে থাকে। ভারতের মেঘালয়ের জলধারা গোয়াইন নদীতে এসে পড়ে, আর সেখানকার এক সরু শাখা চেঙ্গী খাল হয়ে পানি পুরো রাতারগুল জলাবনকে প্লাবিত করে। বর্ষা মৌসুমের প্রায় সবসময়ই পানি থাকে বনে (মে-সেপ্টেম্বর)। শীতকালে অবশ্য সেটা হয়ে যায় আর দশটা বনের মতোই। যেন পাতা ঝরা শুষ্ক ডাঙা। আর ছোট ছোট খাল হয়ে যায় পায়ে চলা মেঠোপথ। তখন জলজ প্রাণিকুলের আশ্রয় হয় বন বিভাগের খোঁড়া বড় বড় ডোবা।

নৌকায় পর্যটকরা

বর্ষায় বড়ই অদ্ভুত এই জলের রাজ্য। এ সময় কোনো গাছের কোমর পর্যন্ত পানিতে ডুবে থাকে। একটু ছোট যেগুলো, সেগুলোর আবার শরীরের অর্ধেকই জলে তলিয়ে যায়। এ সময় কোথাও চোখে পড়ে জেলেরা মাছ ধরছেন। ঘন হয়ে জন্মানো গাছপালার কারণে কেমন যেন অন্ধকার লাগে পুরো বনটা। মাঝে মধ্যেই গাছের ডালপালা আটকে দেয় পথ। হাত দিয়ে ওগুলো সরিয়ে চলতে হয়। তবে বর্ষায় এ বনে চলতে হয় খুব সাবধানে। কারণ রাতারগুল হচ্ছে সাপের আখড়া। বর্ষায় পানি বাড়ায় সাপেরা ঠাঁই নেয় গাছের ওপর।

বন বিভাগের তথ্যমতে, এই বনের আয়তন ৩ হাজার ৩২৫ দশমিক ৬১ একর। এর মধ্যে ৫০৪ একর বন ১৯৭৩ সালে বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। বিশাল এ বনে জলসহিষ্ণু প্রায় ২৫ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। মূলত প্রাকৃতিক বন হলেও বেত, কদম, হিজল, মুর্তাসহ নানা জাতের পানিসহিষ্ণু গাছ লাগিয়েছে বন বিভাগ। রাতারগুল বনে সাপের মধ্যে নির্বিষ গুইসাপ, জলঢোড়া ছাড়াও রয়েছে গোখরাসহ বিষাক্ত অনেক প্রজাতি। বর্ষায় বনের ভেতর পানি ঢুকলে এসব সাপ গাছের ওপর ওঠে।

বনের ভেতর দাপিয়ে বেড়ায় মেছোবাঘ, কাঠবিড়ালী, বানর, ভোঁদড়, বনবিড়াল, বেজি, শিয়ালসহ নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী। টেংরা, খলিশা, রিঠা, পাবদা, মায়া, আইড়, কালবাউস, রুইসহ আরও অনেক জাতের মাছ পাওয়া যায় এ বনে। পাখিদের মধ্যে আছে সাদা বক, কানি বক, মাছরাঙা, টিয়া, বুলবুলি, পানকৌড়ি, ঢুপি, ঘুঘু, চিল ও বাজ। শীতে মাঝে মধ্যে আসে বিশালকায় সব শকুন। আর লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে ঘাঁটি গাড়ে বালিহাঁসসহ হরেক জাতের পাখি। শুকনো মৌসুমে ডিঙি নিয়ে ভেতরে গেলে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আপনাকে উড়ে সরে গিয়ে পথ করে দেবে। এ দৃশ্য আসলেই দুর্লভ।

গাছের মধ্যে এখানে করচই বেশি। হিজলে ফল ধরে আছে শয়ে শয়ে। বটও চোখে পড়বে মাঝে মধ্যে। আর বনের দক্ষিণে মুর্তা (পাটি) গাছের প্রাধান্য। রাতারগুলের বেশ বড় একটা অংশে বাণিজ্যিকভাবে মুর্তা লাগিয়েছে বন বিভাগ। মুর্তা দিয়ে শীতল পাটি হয়। মুর্তা বেশি আছে নদীর উল্টো পাশে। এ ছাড়া ওদিকে শিমুল বিল হাওর আর নেওয়া বিল হাওর নামে দুটি বড় হাওর আছে।

বর্ষায় হাওরের স্বচ্ছ পানির নিচে ডুবে থাকা গাছগুলো দেখার অভিজ্ঞতা অপূর্ব। শীতকালে আবার বনের ভিন্নরূপ। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে জেগে ওঠে মুর্তা ও জালি বেতের বাগান। সে সৌন্দর্য আবার অন্য রকম! বন এভাবে জলে ডুবে থাকে বছরে চার থেকে সাত মাস। বর্ষা কাটলেই দেখা যাবে অন্য চেহারা। তখন বনের ভেতরের ছোট নালাগুলো পরিণত হবে পায়ে চলা পথে। সেই পথ দিয়ে হেঁটে অনায়াসে ঘুরে বেড়ানো যায়।

রাতারগুল বনে ঢুকতে হয় ডিঙি নৌকায় চেপে। নৌকা একবার বনে ঢুকলেই আর কথা নেই। দুটি মাত্র শব্দ লাগবে আপনার ভাব প্রকাশের জন্য। আপনি হয়তো বলে উঠবেন- ‘আমি মুগ্ধ’! আর বোনাস হিসেবে পাবেন গোয়াইন নদী দিয়ে রাতারগুল যাওয়ার অসাধারণ সুন্দর পথ। এ ছাড়া নদীর চারপাশের দৃশ্যের সঙ্গে দেখবেন দূরে ভারতের মিজোরামের উঁচু সবুজ পাহাড়।

এ তো গেল রাতারগুলের বর্ণনা। এখন আলোচনা করব আমাদের ভ্রমণ নিয়ে। আমরা সিলেটের সবুজ প্রকৃতি দেখতে দেখতে কখন যে রাতারগুলে এসে পৌঁছেছি, তা বুঝতেই পারলাম না। আমরা যখন স্পটে এসে পৌঁছেছি, তখন বৃষ্টি ছিল না। এসে দেখি অনেক পর্যটক এসেছে। বিদেশিরাও আছেন তাদের মধ্যে। দেখে মনে হলো, রাতারগুল ইতোমধ্যে বিদেশি পর্যটকদের কাছেও পরিচিত হয়ে উঠেছে। যাই হোক, রাতারগুল বনের মধ্যে প্রবেশ করতে হলে নৌকা নিয়ে যেতে হবে। স্থানীয় বাসিন্দারাই নৌকা ভাড়া দেন। ভাড়া একটু বেশি। তবে এত দূরে খরচ করে এসে ভাড়ার কথা চিন্তা করলে হবে না।

বৃষ্টির ভরা মৌসুমে রাতারগুল পানিতে টইটুম্বুর। হাওরের অথই পানি দেখে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ভয়ে নৌকাতে উঠতে চাইল না। আমরা দুটি নৌকা নিয়ে রওনা হলাম। এখানে বাচ্চারাও নৌকা চালায়। পড়ালেখার পাশাপাশি অবসরে তারা নৌকা ভাড়া দিয়ে আয় করে। আমাদের নৌকা যখন হাওরের মাঝখানে, ঠিক তখন আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। বুঝতে বাকি নেই যে বৃষ্টি হবে। হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি শুরু।

আমাদের মতো অনেকেই রওনা হয়েছে রাতারগুলের উদ্দেশে। কারও কারও কাছে ছাতা ছিল বলে রক্ষা। তবে আমাদের কাছে কোনো ছাতা ছিল না। তাই স্থির করলাম বৃষ্টিতে ভিজেই রাতারগুল দেখব। ঝুম বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে হাওরের জলে নৌকার ওপর গলা ছেড়ে গান ধরলেন আমাদেরই এক বন্ধু। আমাদের নৌকার মাঝি ছিল ছোট দুটি ছেলে। ওরাও গান ধরল। আমরা প্রবেশ করলাম রাতারগুলে। আহা, কী রূপ! চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না এই যে আমাদের বাংলাদেশ। সত্যি বাংলার রূপ পৃথিবীর সব রূপের চেয়ে সেরা। অনেকটা সময় আমরা নৌকায় করে বনের চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখলাম। এরপর উঠলাম ওয়াচ টাওয়ারে। সেখানে উঠে পুরো রাতারগুলের ভিউটা চমৎকারভাবে দেখা যায়। বৃষ্টি ভেজা রাতারগুল সত্যি চমৎকার। আমরা প্রায় দুই ঘণ্টা ছিলাম। এরপর আবারও নৌকায় করে ফিরে আসলাম গাড়ির কাছে। গাড়িতে উঠে রওনা দিলাম সিলেট শহরের উদ্দেশে। চমৎকার একটি দিন কাটিয়ে গেলাম রাতারগুলে আর হৃদয়টা রেখে গেলাম হাওরের জলে।

যেভাবে যেতে হবে
রাতারগুল যাওয়া যায় বেশ কয়েকটি পথে। তবে যেভাবেই যান, যেতে হবে সিলেট থেকেই।

প্রথম উপায়: সিলেট থেকে জাফলং-তামাবিল রোডে সারিঘাট হয়ে সরাসরি গোয়াইনঘাট পৌঁছানো। এরপর গোয়াইনঘাট থেকে রাতারগুল বিট অফিসে আসবার জন্য ট্রলার ভাড়া করতে হবে। ভাড়া ৯০০-১৫০০ এর মধ্যে (আসা-যাওয়া), আর সময় লাগে দুই ঘণ্টা। বিট অফিসে নেমে ডিঙি নৌকা নিয়ে বনে ঢুকতে হবে, এতে ঘণ্টাপ্রতি লাগবে ৫০০-৮০০ টাকা।

দ্বিতীয় উপায়: সিলেটের আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে সিএনজি নিয়ে গোয়াইনঘাট পৌঁছানো, ভাড়া পড়বে ৫০০ টাকা। ওসমানী এয়ারপোর্ট-শালুটিকর হয়ে যাওয়া এ রাস্তা বর্ষাকালে খুবই সুন্দর। এরপর একইভাবে গোয়াইনঘাট থেকে রাতারগুল বিট অফিসে আসবার জন্য ট্রলার ভাড়া করতে হবে। ভাড়া ৮০০-১৫০০ টাকার মধ্যে (আসা-যাওয়া), আর সময় লাগে দুই ঘণ্টা। বিট অফিসে নেমে ডিঙি নৌকা নিয়ে বনে ঢুকতে হবে, এতে মাঝি ঘণ্টাপ্রতি নেবে ৪০০-৫০০ টাকা।

আরও একটি উপায়ে পৌঁছাতে পারেন রাতারগুল। সেটা হচ্ছে সিলেটের আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে সিএনজি নিয়ে মোটরঘাট (সাহেব বাজার হয়ে) পৌঁছাতে হবে। ভাড়া নেবে ২০০-৩০০ টাকা, আর সময় লাগবে ঘণ্টাখানেক। এরপর মোটরঘাট থেকে সরাসরি ডিঙি নৌকা নিয়ে বনে চলে যাওয়া যায়। এতে ঘণ্টাপ্রতি ৪০০-৪৫০ টাকা লাগবে। এই তৃতীয় পথটিতেই সময় ও খরচ সবচেয়ে কম।

কিছু সতর্কতা
রাতারগুল বা তার আশপাশে খাবারের হোটেল বা থাকার কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই। তাই খাবার গোয়াইনঘাট বা সিলেট থেকে নিয়ে যেতে পারেন। আরেকটা বিষয়, নৌকায় বেড়ানোর সময় পানিতে হাত না দেওয়াই ভালো। জোঁকসহ বিভিন্ন পোকামাকড় তো আছেই, বর্ষায় বিষাক্ত সাপও পানিতে বা গাছে দেখতে পাওয়া যায়। সাঁতার না জানলে সঙ্গে লাইফ জ্যাকেট রাখা জরুরি। এ ছাড়া ছাতা, বর্ষাতি কিংবা রোদ টুপিও সঙ্গে নিতে হবে। এখানে বেড়ানোর নৌকাগুলো অনেক ছোট। এক নৌকায় পাঁচজনের বেশি উঠবেন না।

জাহ্নবী

বাংলাদেশের সুন্দর ঝরনা

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৪, ১২:৪৪ পিএম
আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২৪, ১২:৪৪ পিএম
বাংলাদেশের সুন্দর ঝরনা
বান্দরবানের থানচির নাফাখুম জলপ্রপাত

বাংলাদেশে ঝরনার অভাব নেই। বর্ষাকালে এই ঝরনাগুলোর রূপ হয়ে ওঠে আরও সুন্দর। চাইলে আপনিও দেখে আসতে পারেন দৃষ্টিনন্দন এসব ঝরনা। আজ থাকছে দেশের দৃষ্টিনন্দন কিছু ঝরনার কথা। লিখেছেন আবুল হাসান

তিনাপ সাইতার ঝরনা
বাংলাদেশের বৃহত্তম জলপ্রপাত তিনাপ সাইতার বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে অবস্থিত। অনেকের কাছে পাইন্দু সাইতার নামে পরিচিত। তিনাপ সাইতার হার্ড ট্রেকিংয়ের জন্য একটি আদর্শ জায়গা। ধৈর্য এবং শারীরিক সামর্থ্য থাকলেই কেবল তিনাপ সাইতারের অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। তিনাপ সাইতার দেখতে হলে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পথ হেঁটে পাড়ি দিয়ে আবার একই পথে ফিরে আসতে হয়।

নাফাখুম জলপ্রপাত
বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নে অবস্থিত নাফাখুম জলপ্রপাত পানি প্রবাহের পরিমাণের দিক থেকে বাংলাদেশের অন্যতম বড় জলপ্রপাত হিসেবে আখ্যায়িত। অনেকে এই জলপ্রপাতকে বাংলার নায়াগ্রা নামে আখ্যায়িত করেন। মারমা ভাষায় খুম মানে জলপ্রপাত। নাফাখুম যেতে হলে থানচি বাজার থেকে সাঙ্গু নদী পথে নৌকা দিয়ে রেমাক্রি যেতে হয়। আর রেমাক্রি থেকে প্রায় তিন ঘণ্টা হাঁটলে তবেই দেখা মিলে প্রকৃতির এই অনিন্দ্য রহস্যের।

আমিয়াখুম জলপ্রপাত
বান্দরবানের অবস্থিত আমিয়াখুম জলপ্রপাত অনেকের কাছে পরিচিত বাংলার ভূস্বর্গ হিসেবে। কেউ কেউ আবার এই আমিয়াখুমকে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর জলপ্রপাত মনে করেন। সবুজ পাহাড় আর পাথরের মধ্য দিয়ে সাদা রঙের ফেনা ছড়িয়ে জলধারা বয়ে চলে। প্রবহমান জলের শব্দতরঙ্গ আর ঝরনার বুনো সৌন্দর্য আজীবন মনের গেঁথে থাকার জন্য যথেষ্ট।

ধুপপানি ঝরনা
রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নের ওড়াছড়িতে রয়েছে অনিন্দ্য সুন্দর ধুপপানি ঝরনা। ২০০০ সালের দিকে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এই স্থানে আরাধনা শুরু করেন এবং পরবর্তীতে স্থানীয় মানুষের মাধ্যমে ঝরনাটি সবার কাছে পরিচিতি লাভ করে। ধুপপানি ঝরনা নামের অর্থ সাদা পানির ঝরনা। এই ঝরনাটি ভূমি থেকে প্রায় ১৫০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। ধুপপানি ঝরনার আশপাশে হরিণ, বুনো শূকর, বনবিড়াল এবং ভাল্লুকসহ বেশ কিছু বন্য প্রাণী বসবাস করে। প্রায় ২ কিলোমিটার দূর থেকেও এই ঝরনার পানি আছড়ে পড়ার শব্দ শোনা যায়।

সাইংপ্রা ঝরনা
বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলাযর কির্স তং পাহাড়ের গা বেয়ে চলা সাইংপ্রা ঝরনা এক অনন্য আদিম সৌন্দর্যের ধারক। এই ঝরনা দেখতে যাওয়া মোটেও সহজ নয়। পিচ্ছিল ট্রেইল ধরে হাঁটার সময় প্রতি মুহূর্তে থাকতে হয় সর্বোচ্চ সতর্কতায়। যদিও চারপাশের অপরূপ প্রকৃতি যাত্রাপথে মোটেও হতাশ করে না। আর অনিন্দ্য সুন্দর এই সাইংপ্রা ঝরনার রয়েছে মোট তিনটি ধাপ।

বাকলাই ঝরনা
অভিযাত্রীদের মতে বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু ঝরনার নাম বাকলাই। ঝরনাটির উচ্চতা প্রায় ৩৮০ ফুট। বান্দরবনের থানচি উপজেলার বাকলাই গ্রামে অবস্থিত এই ঝরনায় যাওয়ার পথ বেশ দুর্গম। ফলে বান্দরবান শহর থেকে ঝরনা দেখে ফিরে আসতে ৪-৫ দিন সময় লেগে যায়। তাই পাহাড়ের দুর্গম পথে ভ্রমণের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া বাকলাই ঝরনায় যাওয়া মোটেও উচিত নয়।

জাদিপাই ঝরনা
বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায় অবস্থিত জাদিপাই ঝরনা বাংলাদেশের প্রশস্ততম ঝরনার মধ্যে অন্যতম। আর বর্ষাকালে এই জলপ্রপাতের পানি প্রবাহের পরিমাণ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায় তখন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণকারীরা জাদিপাই ঝরনার রূপ দেখতে আসেন। কেওক্রাডং থেকে প্রায় ২৫০০ ফুট নিচে জাদিপাই ঝরনার অবস্থান হওয়া সেখান থেকে হেঁটে ঝরনায় যেতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগে।

দামতুয়া জলপ্রপাত
দামতুয়া ঝরনা থেকে কয়েক শ গজ উপরে দামতুয়া জলপ্রপাতে অবস্থান। আর দামতুয়া জলপ্রপাতের ধাপগুলো যেন প্রকৃতির হাতে গড়া একেকটি অপূর্ব স্থাপত্য নিদর্শন। দামতুয়া জলপ্রপাত দেখতে হলে বান্দরবানের আলীকদম বাসস্ট্যান্ড থেকে থানচির নতুন রাস্তা ধরে প্রায় ১৭ কিলোমিটার এগিয়ে গাইডের সাহায্যে পাহাড়ি বনের আরও গভীরে যেতে হয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু থানচি রাস্তা ধরে যাওয়ার সময় চারপাশের অদ্ভুত সুন্দর পাহাড়ি দৃশ্য কল্পনাকে হার মানায়।

খৈয়াছড়া ঝরনা
সীতাকুণ্ডের মিরসরাইয়ে অবস্থিত খৈয়াছড়া ঝরনা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঝরনাগুলোর একটি। ঝরনার ৯টি ধাপের নান্দনিক সৌন্দর্য দেখে ভ্রমণপিয়াসী মানুষ মুগ্ধ হয়। গ্রামের সবুজ শ্যামল আঁকাবাঁকা মেঠো পথ আর পাহাড়ের হাতছানিতে অনন্য খৈয়াছড়ার আবেদন উপেক্ষা করা কঠিন বলেই প্রকৃতিপ্রেমীরা খৈয়াছড়া ঝরনাকে বাংলাদেশের ঝরনা রানি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

হামহাম জলপ্রপাত
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি বনাঞ্চলের গভীরে একদল পর্যটক গাইড শ্যামল দেববর্মাকে সঙ্গে নিয়ে হামহাম জলপ্রপাত আবিষ্কার করেন। ২০১০ সাল প্রকাশিত ঝরনাটি স্থানীয়দের কাছে চিতা ঝরনা হিসেবে পরিচিত। প্রায় ১৪০ ফিট উচ্চতা হতে নেমে আসা ঝরনার বুনো সৌন্দর্য দেখার আশায় প্রতি বর্ষায় সারা দেশ থেকে ভ্রমণকারীরা হামহামের উদ্দেশে যাত্রা করে।

জাহ্নবী

বর্ষায় পর্যটন

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:৪৩ পিএম
আপডেট: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:৪৪ পিএম
বর্ষায় পর্যটন
বর্ষায় কক্সবাজারের সৌন্দর্য অন্যরকম। ছবি: প্রশান্ত রায়

বৃষ্টির মৌসুমে প্রকৃতি যেন তার আপন রূপ মেলে ধরে। বাংলার চিরায়ত সবুজ শ্যামল সৌন্দর্য মেলে ধরে বর্ষা। বর্ষায় ঘুরে দেখার জন্য দেশের কিছু জায়গা সম্পর্কে জানাচ্ছেন মোহনা জাহ্নবী

সিলেট
পানি আর সবুজ পাহাড়বেষ্টিত সুন্দর একটি জেলা সিলেট। নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে ভরা এ জেলায় রয়েছে বেশ কিছু আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান। যেমন- জাফলং, বিছানাকান্দি, লোভাছড়া, লক্ষণছড়া, ডিবির হাওড়, হাকালুকি হাওড়, লালাখাল, রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট, সংগ্রামপুঞ্জি ঝরনা, পান্থুমাই ঝরনা, ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর, জৈন্তা হিল রিসোর্ট ইত্যাদি।

মৌলভীবাজার
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি চা বাগান রয়েছে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলায়। বর্ষাকালে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হওয়ার দরুন চা বাগান তার পরিপূর্ণ সৌন্দর্য মেলে ধরে। চা বাগান ছাড়াও মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, মাধবপুর লেক, হাকালুকি হাওড়, হামহাম জলপ্রপাত, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, ক্যামেলিয়া লেক ইত্যাদি এ জেলার পর্যটন স্থান। 

সুনামগঞ্জ
বর্ষা মৌসুম হাওড়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এ জেলায় জনপ্রিয় টাঙ্গুয়ার হাওড় ছাড়াও রয়েছে আরও কিছু দর্শনীয় স্থান। যেমন- বারেক টিলা, যাদুকাটা নদী, শিমুল বাগান, নীলাদ্রি লেক ইত্যাদি।

হবিগঞ্জ
বৃষ্টির দিনে হবিগঞ্জজুড়ে বিস্তৃত বনাঞ্চল আরও নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে ভরে ওঠে। হবিগঞ্জের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে- রেমাকালেঙ্গা অভয়ারণ্য, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, লক্ষ্মীবাউর জলাবন, সাগরদী ঘি ইত্যাদি।

সিরাজগঞ্জ
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল এবং সমৃদ্ধতম জলাভূমি চলনবিল তিনটি জেলাজুড়ে বিস্তৃত। জেলা তিনটি হচ্ছে নাটোর, পাবনা এবং সিরাজগঞ্জ। বর্ষায় চলনবিল পানিতে ভরপুর থাকে। তখন তার সৌন্দর্য বেড়ে যায় বহু গুণ। 

কিশোরগঞ্জ
কিশোরগঞ্জে রয়েছে মিঠামইন হাওড়, ইটনা হাওড়, নিকলী হাওড়, অষ্টগ্রাম হাওড় ইত্যাদি। হাওড়ের মাঝখান দিয়ে দীর্ঘ রাস্তা নির্মাণের ফলে বিগত কয়েক বছর এর জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে অনেক গুণ। এ ছাড়া কিশোরগঞ্জে আরও রয়েছে গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়ি, কবি চন্দ্রাবতী মন্দির, এগারসিন্দুর দুর্গ, ইটনা শাহী মসজিদ, সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক বাড়ি, এমনকি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঈদগাহ ময়দান শোলাকিয়া।

বরিশাল
ঝালকাঠি, বরিশাল এবং পিরোজপুরের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম পেয়ারা বাজার। তিন দিক থেকে আসা খালের মোহনায় বসে এই পেয়ারা বাজার। বৃষ্টি নামলে পেয়ারা বাজারের সৌন্দর্য আরও বেড়ে যায়। বর্ষা মৌসুমে ভ্রমণের জন্য এটি খুব উপযুক্ত স্থান।

ভোলা
ভোলা বাংলাদেশের বৃহত্তম দ্বীপবেষ্টিত জেলা, যা কুইন আইল্যান্ড অব বাংলাদেশ নামেও পরিচিত। জেলাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জল-স্থলের অপূর্ব সুন্দর ল্যান্ডস্কেপের জন্য বর্ষা মৌসুমে ভোলা জেলা আরও নান্দনিক হয়ে ওঠে। ভোলার কিছু দর্শনীয় স্থান হচ্ছে- মনপুরা দ্বীপ, চর কুকরিমুকরি, তালুকদার জমিদার বাড়ি ইত্যাদি।

বর্ষায় বিছানাকান্দি

খুলনা
এ জেলাকে বলা হয় সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার। বৃষ্টির সঙ্গে বনের সৌন্দর্য উপভোগ করার আগ্রহে সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য বর্ষা মৌসুমকেই বেশি উপযুক্ত মনে করেন প্রকৃতি ও ভ্রমণপ্রেমী মানুষ। বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম এ জেলায় রয়েছে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান। ভূতিয়ার পদ্মবিল, পুটনী দ্বীপ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষদের বাড়ি ও শ্বশুরালয়, বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড, করমজল পর্যটন কেন্দ্র, কটকা সমুদ্র সৈকত ইত্যাদি।

বাগেরহাট
বঙ্গোপসাগরের কূলঘেঁষা এ জেলায় রয়েছে কচিখালী সমুদ্র সৈকত, দুবলার চর, মোংলা বন্দর, খাঞ্জেলী দিঘি, যা বর্ষা মৌসুমে ঘুরে দেখার জন্য উপযুক্ত স্থান। 

শেরপুর
শেরপুর জেলাও বন পাহাড়ে ঘেরা অনিন্দ্য সুন্দর একটি প্রাকৃতিক জেলা। বৃষ্টির মৌসুম শুরু হলে গজনী অবকাশ কেন্দ্র, বনরানী ফরেস্ট রিসোর্ট, মধুটিলা ইকোপার্ক প্রভৃতি স্থান তার আপন সৌন্দর্য মেলে ধরে।

নেত্রকোনা
বিরিশিরি আর সোমেশ্বরী নদীর জন্য জনপ্রিয় জেলা নেত্রকোনা। বর্ষায় সোমেশ্বেরী নদী নবযৌবনা হয়ে ওঠে। একদিকে সোমেশ্বরী নদীর স্বচ্ছ পানি, অন্যদিকে গাঢ় সবুজ পাহাড় মিলিয়ে অপূর্ব সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ। নেত্রকোনায় আরও রয়েছে কমলারানীর দিঘি, ডিঙ্গাপোতা হাওড়, সাত শহীদের মাজার ইত্যাদি।

ফেনী
ফেনী জেলায় রয়েছে বেশ কিছু ছোট-বড় দিঘি। বর্ষায় সেসব দিঘি পানিতে টইটম্বুর হয়ে থাকে। তার মধ্যে পরীর দিঘি, বিজয়সিংহ দিঘি, রাজাঝির দিঘি, শমসের গাজীর দিঘি অন্যতম। 

রাঙামাটি
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রাচুর্যে ভরা রাঙামাটি দেশের বৃহত্তম জেলা এবং সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে পুরো জেলাটিই একটি কৃত্রিম হ্রদের ওপর অবস্থিত, যা কাপ্তাই হ্রদ নামে পরিচিত। বর্ষা মৌসুমে ঘোরার কথা মনে হলেই পাহাড়, ঝরনা, হ্রদ এসবের কথা মনে পড়ে। আর রাঙামাটি জেলায় এগুলো সবই আছে। ঝরনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- হাজাছড়া, কমলক, মুপ্পোছড়া, ধূপপানি এবং শুভলং। আর যে জায়গাটির কথা না বললেই নয়, তা সাজেক ভ্যালি। সাজেক ভ্যালির মেঘ ভেসে বেড়ানো পাহাড়ের অপূর্ব সৌন্দর্য পর্যটকদের বারবার সেখানে টেনে নিয়ে যায়। 

খাগড়াছড়ি
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর খাগড়াছড়ি জেলায় রয়েছে পাহাড়ের চূড়ায় গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক লেক মাতাই পুখিরি, হার্টিকালচার হেরিটেজ পার্ক, মানিকছড়ি মং রাজবাড়ি, তৈদুছড়া ঝরনা, পানছড়ি শান্তিপুর অরণ্য কুঠির, স্বর্গের সিঁড়ি বা হাতিমাথা, নিউজিল্যান্ড পাড়া, রিসাং ঝরনা, আলুটিলা গুহা, মায়াবিনী লেক প্রভৃতি।

বান্দরবান
পাহাড়, নদী আর ঝরনা মিলে অপূর্ব সুন্দর জেলা বান্দরবান। বর্ষায় ঝরনা আর নদীগুলো যখন পানিতে ভরপুর থাকে, পাহাড় আরও সবুজ হয়ে ওঠে, তখন তা ভ্রমণপিপাসুদের জন্য আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। বান্দরবানের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- দেবতাখুম, সাতভাইখুম, আমিয়াখুম জলপ্রপাত, ঋজুক ঝরনা, জাদিপাই ঝরনা, মিলনছড়ি, ডিম পাহাড়, মারায়নতং, তিন্দু, দামতুয়া ঝরনা, আলীর 
সুড়ঙ্গ, চিংড়ি ঝরনা, নীলাচল, নীলগিরি, মেঘলা পর্যটন কেন্দ্র, শৈলপ্রপাত ঝরনা, স্বর্ণমন্দির, কেওক্রাডং, বগালেক, সাইরু হিল রিসোর্ট, নাফাখুম প্রভৃতি।

চট্টগ্রাম
পাহাড় আর সমুদ্রে ঘেরা চট্টগ্রাম জেলায় রয়েছে অনেক দর্শনীয় স্থান। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু দর্শনীয় স্থান হচ্ছে- গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত, বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত, মহামুণি বৌদ্ধ বিহার, রাঙ্গুনিয়া চা বাগান, ফয়েস লেক, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, পারকি সমুদ্র সৈকত, বাওয়াছড়া লেক, প্রজাপতি পার্ক, হাজারিখিল অভয়ারণ্য, বাঁশখালী ইকোপার্ক, সোনাইছড়ি ট্রেইল, সুপ্তধারা ঝরনা, সহস্রধারা ঝরনা, খৈয়াছড়া ঝরনা, ঝরঝরি ঝরনা, কমলদহ ঝরনা, নাপিত্তাছড়া ঝরনা ও ট্রেইল, ভাটিয়ারী লেক, ওয়ার সিমেট্রি, চন্দ্রনাথ পাহাড়, মহামায়া লেক, সন্দ্বীপ, সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক, কুমিরাঘাট ইত্যাদি।

জাহ্নবী