
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সফল নারী উদ্যোক্তা সায়রা আমিন। তিনি ট্রাইকো কম্পোস্ট সার উৎপাদন করেন। তার এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে অদম্য ইচ্ছাশক্তি। সবজি ও মৎস্য চাষের পাশাপাশি তিনি ট্রাইকো কম্পোস্ট সার উৎপাদন কারখানা গড়ে তুলেছেন। তার গল্প আজ অনেক নারীর জন্য অনুপ্রেরণা।
সায়রা আমিন সীতাকুণ্ড উপজেলার পশ্চিম বাঁকখালী গ্রামের বাসিন্দা। তিনি প্রবাসী আবদুর রহমানের স্ত্রী। তার স্বামী একসময় সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন। ২০২০-২১ সালে করোনার কারণে তিনি দেশে আটকা পড়েন। কিছুদিন পর বিদেশে যাওয়ার পর তিনি কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে আবার দেশে ফিরে আসেন চিকিৎসার জন্য। সায়রার তিনটি মেয়ে, এর মধ্যে দুই মেয়ে বিবাহিত। ছোট মেয়ে এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছেন। সংসারের খরচ ও স্বামীর চিকিৎসা দুটিই সায়রার ওপর পড়ে।
২০২২ সালে সংসারের হাল ধরতে সায়রা তার স্বর্ণালংকার বিক্রি করে বাড়ির পাশে পুকুর খনন করেন। পুকুরে মাছ চাষের পাশাপাশি সবজি চাষ শুরু করেন। এর মধ্যে তিনি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহর সঙ্গে পরিচিত হন। কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে তিনি ট্রাইকো কম্পোস্ট সার উৎপাদন শুরু করেন। কৃষি কর্মকর্তা হাবিবুল্লাহ তাকে সার উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেন। প্রয়োজনীয় মেডিসিন বিনামূল্যে সরবরাহ করেন।
সায়রা জানান, কৃষি কর্মকর্তা হাবিবুল্লাহ প্রতি ৪৫ দিন পর ১০ কেজি করে মেডিসিন বিনামূল্যে দেন, যার বাজারমূল্য ৭০০ টাকা কেজি। বর্তমানে সায়রা মাসিক ১ লাখ টাকা আয় করছেন। তবে ট্রাইকো কম্পোস্ট সার উৎপাদন তার প্রধান আয়ের উৎস। ১১০ শতক জমির মধ্যে ২০ শতক জমিতে কম্পোস্ট সার উৎপাদন কারখানা স্থাপন করেছেন। অন্যান্য জমিতে তিনি সবজি ও মাছ চাষ করেন।
খামারে চার-পাঁচজন নারী-পুরুষ কর্মচারী নিয়োগ করেছেন। তারা নিয়মিত বেতন পান। কাজের পরিমাণ বাড়লে, যেমন সার লোড হলে ৮-১০ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। তার খামারে ১১০ শতক জমির এক পাশে পুকুর এবং অন্য পাশে ট্রাইকো কম্পোস্ট সার উৎপাদন কারখানা রয়েছে। তার খামারে গরু, মুরগি ও হাঁসও রয়েছে।
প্রথমে গ্রামের মানুষ তার উদ্যোগ নিয়ে হাসি-তামাশা করলেও আজ তার সফলতা দেখে সবাই প্রশংসা করেন। সায়রার স্বামী তাকে সর্বদা উৎসাহ দিয়েছেন। তার এই সাফল্য এখন অনেকের জন্য উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি এখন প্রতি ৪৫ দিন পর ১০ টনেরও বেশি ট্রাইকো কম্পোস্ট সার উৎপাদন করেন। প্রতি কেজি ২০ টাকায় বিক্রি করেন। সারটির বেশির ভাগ বিক্রি হয় অনলাইনে।
তার খামারে বর্তমানে টমেটো, কাঁচা মরিচ, শিম, মিষ্টিকুমড়া, ব্রোকলি, শসা, শজনে, লেবু, টক ফল, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, লালশাকসহ বিভিন্ন সবজি উৎপাদিত হয়। স্থানীয় পাইকাররা এসব সবজি কেনেন। সায়রার উৎপাদিত কম্পোস্ট সার বিক্রি হচ্ছে সীতাকুণ্ড, কুমিরা, মাদামবিবির, শুকলাল হাট, বাড়বকুণ্ড, চাঁদবাগান ও ঢাকা বসুন্ধরা এলাকায়।
কম্পোস্ট সার উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালগুলো হলো ট্রাইকো ডার্মা পাউডার, গোবর,-মুরগির বিষ্ঠা, সবজির উচ্ছিষ্ট, কচুরিপানা, কাঠের গুঁড়া, ভুট্টার ব্রান, চিটাগুড়, ছাই ও নিমপাতা। এসব উপকরণ একত্রে মিশিয়ে ৪০-৪৫ দিনে উৎকৃষ্ট মানের জৈব সার তৈরি করা হয়। এই জৈব সার গাছের রোগ প্রতিরোধ, ফলন বৃদ্ধি ও পুষ্টিগুণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
সায়রা আমিনের সার এখন দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। সীতাকুণ্ডের কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ বলেন, ‘ট্রাইকো কম্পোস্ট সার গাছের ফলন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ উপজেলায় তিন-চারজন ব্যক্তি কম্পোস্ট সার উৎপাদন করেন। তবে সায়রা আমিন বড় পরিসরে সার উৎপাদন করে লাভবান হচ্ছেন।
২০২৪ সালে সায়রা আমিন উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার পেয়েছেন। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর তাকে এই সম্মাননা দেয়েছে।