২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যু দেশের মানুষকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, সে জন্য দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, বাংলাদেশ জাতীয় নির্মাণবিধি এবং অনুমোদিত নকশা না মেনেই রাজধানীতে এত বহুতল ভবন গড়ে ওঠে কীভাবে! এ ক্ষেত্রে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট ঘাটতি বা দুর্বলতা আছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যখনই কোনো দুর্ঘটনা, দুর্যোগ ও বড় সংকট সৃষ্টি হয়, তখনই দায়িত্ব পালনকারী কর্তৃপক্ষ অনিয়ম-দুর্নীতি ও অপরাধী খুঁজতে মাঠে নামে। শুরু হয় বিশেষ অভিযান। বেইলি রোডের ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে ফায়ার সার্ভিস, রাজউক, সিটি করপোরেশন ও পুলিশ। এ ধরনের অভিযান আগেও হয়েছে। ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবও সুস্পষ্ট। এবার বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছে অভিযান চলমান রেখে যেন স্থায়ী সুফল নিশ্চিত করা হয় এবং অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট সংস্থা পেশাজীবীদের সমন্বয়ে জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করা হয়।
বেইলি রোডের বহুতল ভবন গ্রিন কোজি কটেজের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অগ্নিনিরাপত্তা ও জীবনের সুরক্ষা শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট আইএবি। প্রতিনিধিদলের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির নির্গমন পথ বাধামুক্ত ছিল না। ভবনটির সিঁড়িতে আগুনরোধক দরজা না থাকায় ধোঁয়া অতি দ্রুত একতলা থেকে পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। ভবনটিতে অগ্নি প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় শনাক্তকরণ এবং অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল ছিল। ভবনে গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবস্থাপনা যথাযথ ছিল না। ২০২৩ সালে ঢাকা মহানগরী এলাকায় মার্কেট ও শপিংমল পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। পরিদর্শন শেষে দেওয়া প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, রাজধানীর ৫৮টি মার্কেট, সুপার মার্কেট ও শপিংমল অগ্নিনিরাপত্তার দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলোর মধ্যে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ৯টি, মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ ১৪টি এবং ৩৫টি সাধারণ ঝুঁকিপূর্ণ। অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ এসব ভবনে যেকোনো সময় আগুন লাগতে পারে বলে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ঝুঁকির তালিকায় আছে সিটি করপোরেশনের স্থাপনাও।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সহসভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে বলেছি একটি প্রটোকল তৈরি করতে। রাজউক কী কী করবে, সেটার একটা চেকলিস্ট থাকতে হবে। সেই চেকলিস্ট নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, প্রকৌশলীদের সঙ্গে নিয়ে করতে হবে। অথবা নগর উন্নয়ন কমিটিকে সঙ্গে নিয়ে করতে হবে। তা না হলে আমরা আশঙ্কা করছি, যে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে, সেটি শুধু ঘুষ-বাণিজ্যই বাড়াবে। কাজেই এই দিকটা রাজউককে অবশ্যই খেয়াল করতে হবে।’
ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে রেস্তোরাঁ। এদের জন্য নেই নির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা। নিয়ম না মেনে যাতে রেস্তোরাঁ গড়ে উঠতে না পারে, সে জন্য ভবিষ্যতের জন্য একটি নীতিমালা করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের দৃশ্যমান স্থানে নোটিশ টাঙানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সিলগালা করতে হবে। মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। শুধু নগরায়ণ বাড়ালেই হবে না, বাড়াতে হবে রাজউকের সক্ষমতা। সর্বোপরি অগ্নিকাণ্ড থেকে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারকে জাতীয় ট্রাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। টাস্কফোর্সকে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা দিতে হবে। তাহলেই ঘনবসতিপূর্ণ এই রাজধানী শহরে ঘন ঘন অগ্নিকাণ্ডের হাত থেকে মানুষ রেহাই পাবে।