
অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল সোমবার ২ জুন বেলা ৩টায় ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ও দেশের ইতিহাসে ৫৪তম বাজেট ঘোষণা করেন তিনি। জাতীয় সংসদ না থাকায় ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট এবার রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম বিটিভিসহ অন্যান্য বেসরকারি গণমাধ্যমে একযোগে প্রচার করা হয়। এর আগে প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠকে অনুমোদন হয়েছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট, যা জিডিপির ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। সংসদ না থাকায় আলোচনা বা বিতর্কের কোনো সুযোগ ছিল না এবারের বাজেট নিয়ে। তবে প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে নাগরিকদের কাছ থেকে মতামত নেবে অর্থ মন্ত্রণালয়। মতামতের ভিত্তিতে তা চূড়ান্ত করা হবে। এরপর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হবে। পরে রাষ্ট্রপতি একটি অধ্যাদেশ জারি করবেন। ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে নতুন বাজেট।
দায়িত্ব গ্রহণের ১০ মাসেরও কম সময়ে সরকার অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার ও নৈরাজ্য দূর করে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে বলে অর্থ উপদেষ্টা উল্লেখ করেন। তার ভাষ্য, একটি টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে কিছুটা সংস্কারভিত্তিক এই বাজেটে উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছে দিতে পরিকল্পনা থাকছে। সরকার চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে ব্যয় কমিয়েছে ৭ হাজার কোটি টাকা। তিনি বলেছেন, বাস্তবতার সঙ্গে মিল রাখতেই ঘাটতি কমিয়ে বাজেটের আকার ছোট রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আন্দোলনের ডামাডোলের মধ্যে নতুন বাজেটে স্বল্প আয়ের মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা থাকবে। বর্তমান সরকার আপাতত প্রবৃদ্ধির গতি বৃদ্ধির পরিবর্তে অর্থনীতির ভিত মজবুত করার দিকে অধিকতর মনোযোগ দিচ্ছে। এ শক্তিশালী ভিতই হবে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের সোপান।
অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি, এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এই বাজেটের আকার চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তুলনায় কম।
মূল্যস্ফীতির কশাঘাত থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে জানুয়ারি ২০২৫ থেকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-এর মাধ্যমে স্মার্ট ফ্যামিলি কার্ডের ভিত্তিতে ৫৭ লাখ পরিবারকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। এবারের বাজেটে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে আরও পাঁচ লাখ পরিবার আওতাভুক্ত হবে বলে অর্থ উপদেষ্টা জানিয়েছেন। বাজেট বক্তৃতায় তিনি আরও বলেন, গত বছরের আগস্টে আমাদের সরকার যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে, তখন আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে মানুষকে স্বস্তি দেওয়া। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে ধারাবাহিকভাবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করেছে সরকার। এর ফলে নীতি সুদহার ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনায় সার্বিকভাবে সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে শুরু করেছে। পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২৫ সালের এপ্রিলে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এই জুনেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের কোটায় নেমে আসবে। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে এ লড়াইয়ের ফলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্যান্য বছরে তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে বলে অর্থ উপদেষ্টা জানিয়েছেন।
বাজেট সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে মৌলিক জায়গায় গলদ রয়েছে। আগের বাজেট যেভাবে চলে আসছে, সেখান থেকে সংখ্যার তারতম্য হয়েছে। কিন্তু বাজেটের প্রিন্সিপাল একই রয়ে গেছে। এটি গতানুগতিক বাজেট।
সাধারণ মানুষের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা অনেক। কারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বিগত সরকারের সময় নাগালের বাইরে চলে যায়। এ নিয়ে মানুষ খুবই অস্বস্তিতে পড়েন। এরপর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করায় সাধারণ মানুষের সেই প্রত্যাশা বহু গুণ বেড়ে যায়। তারা দেখতে চান বাজেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমাতে সরকার কী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বা করবে। সাধারণ মানুষ এর বাইরে বাজেট নিয়ে আর কী-বা ভাববে। প্রত্যাশা করছি, এই বাজেট দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে এবং এর মাধ্যমে জনজীবনে স্বস্তি ফিরে আসবে।