উপন্যাসের শ্রেণিবিভাগ থেকে আমরা মোটা দাগে জানতে পারি, উপন্যাস প্রধানত আট ধরনের: সামাজিক, ঐতিহাসিক, মনস্তাত্বিক, রাজনৈতিক, কাব্যধর্মী, গোয়েন্দা, পত্রোপন্যাস ও হাস্যরসাত্মক উপন্যাস। মোস্তফা কামাল রচিত ‘কারবালা উপাখ্যান’ ইতিহাসের মোড়কে ধর্মাশ্রয়ী উপন্যাস। যেকোনো ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে লেখক চরিত্র নির্মাণে কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন; কিন্তু ধর্মাশ্রয়ী উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে ধর্মভীরু মানুষের ভাবাবেগ যাতে ভূলুণ্ঠিত না হয় সে জন্য লেখককে সতর্কতার চূড়োয় বসে থাকতে হয়; সেই সঙ্গে মাছরাঙার দৃষ্টিতে পঠনপাঠন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হয়। উপন্যাসের শেষে গ্রন্থপঞ্জি ও তথ্যসূত্রের দিকে তাকালে লেখককে প্রচুর পরিশ্রমী ও জ্ঞানপিপাসক মনে হয়। লেখকের জীবনদৃষ্টি ও জীবনসৃষ্টির সঙ্গে ভাষা যেমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তেমনি উপন্যাসের বর্ণনা, পরিচর্যা, পটভূমি উপস্থাপন ও চরিত্রের স্বরূপ নির্ণয়ে অনিবার্য ভাষাশৈলীর প্রয়োগ অত্যাবশ্যকীয়ভাবে আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে লেখক অনেকটা সার্থক। উপন্যাসের শুরুটা এভাবে: মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) সাহাবিদের নিয়ে সফরে বের হলেন।
দরবারীয় আবেগ ছুড়ে ফেলে নবিকে সরাসরি নিয়ে গেলেন সফরে; সঙ্গে সাহাবিবৃন্দ। নির্দিষ্ট প্লাটফর্মে গল্পের ট্রেন স্তব্ধতার শেকলে আটকে রাখলেন না তিনি। ফলে পাঠক গলদঘর্ম না হয়েই উপন্যাসে অভিনিবেশ করতে পারেন; আর বার্গসীয় গতিসূত্রের মহারণ তাকে টেনে নেয় উপন্যাসের শেষাবধি। সেজন্য লেখকের কৌশলী অবতারণা ঝুটঝঞ্ঝাট ব্যতিরেকেই প্রশংসার দাবিদার।
যেহেতু কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা বহুল আলোচিত ও বহুল পঠিত, সেহেতু গল্পের সারসংক্ষেপ ‘উপেক্ষা’ নামক দানবের কাছে জিম্মি রেখে কতিপয় চুম্বক অংশ নিয়ে আলোকপাত করব। উপন্যাসের ১২ পৃষ্ঠায় লক্ষ করুন: খুতবায় তিনি (হজরত মুহাম্মদ, সা.) বললেন, হে আমার প্রভু! আমি তোমার প্রেরিত রাসুল। আমি হাসান ও হোসেনকে উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যাচ্ছি। কিন্তু জিবরাইল (আ.) আমাকে জানালেন, তাদের উভয়কে হত্যা করা হবে। কে হত্যা করবে সে প্রসঙ্গেও তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। অর্থাৎ হত্যাকারী হবে মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদ। যদি তাই হয়, তাহলে কারবালার প্রান্তরে সংঘটিত নির্মম হত্যাকাণ্ডের দায় কার? মানুষ কেনই-বা হায় হোসেন! হায় হোসেন করে বুক চাপড়াবে? কেনই-বা ইয়াজিদ ও শিমারকে ঘৃণা করবে? এরকম অনেক প্রশ্ন অবতারণা করা যেতে পারে। উপন্যাসের ১৫ পৃষ্ঠায়: আল্লাহর দূত জিবরাইল (আ.) ধ্যানমগ্ন মুহাম্মদের (সা.) কাছে এলেন একটি রেশমি কাপড়ের আচ্ছাদন নিয়ে। জিবরাইল যেখানে বসবাস করেন সেখানে কী রেশমি কাপড়ের কারখানা আছে? কোথায় পেলেন তিনি?
উপন্যাসের ৭৯ পৃষ্ঠা: ‘ইমাম হাসান বুঝতে পারছিলেন, তাঁর অন্তিম মুহূর্ত। মৃত্যুযন্ত্রণায় তিনি কাতর। তিনি তার (এখানে চন্দ্রবিন্দু বাদ পড়েছে) হোসেনকে বললেন, ভাই আমার! আমাকে বাড়ির সামনে উঠানে নিয়ে চলো। যাতে আমি আকাশের বিশালত্ব দেখতে পারি।’ তিনি নির্মোহ ইতিহাসের কচকচানি থেকে পাঠককে নিয়ে যান আকাশের বিশালত্বের দিকে; একটু হলেও পাঠককে ফিরিয়ে দেন প্রকৃতি ও মানবাত্মার যে অমোঘ মেলবন্ধন, তারই স্বস্তির কোমল গান্ধার। লেখক অনেক জায়গায় এরকম মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন কবিত্বভারে জারিত হয়ে।
একদিন হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কূটাভাস সত্যে পরিণত হয়। জিবরাইলের ইঙ্গিত মোতাবেক সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং কারবালা প্রান্তরে হত্যার মঞ্চ তৈরি করে রেখেছিলেন; বাকি ছিল ইমাম হোসেন ও ইয়াজিদ বাহিনীর মধ্যকার বেদনাবিধুর বিগ্রহনাটক মঞ্চায়নের। অতঃপর ইসলামিক পঞ্জিকা অনুসারে ৬১ হিজরির ১০ মহররমে সেই নাটক মঞ্চস্থ হলো। ইমাম হোসেন নিহত হলেন। দেহ থেকে শির আলাদা করা হলো। লেখকের বর্ণনামতে, এমন নির্মমতা যেন প্রকৃতির কাছেও অসহনীয় মনে হয়।
মীর মশাররফ হোসেন ইমাম হোসেনের কাটামুণ্ডু নিয়ে বাঙালি পাঠকদের আবেগ নিয়ে যেভাবে ছেলেখেলা খেলেছেন সেই একই রাস্তায় পা বাড়াননি এ উপন্যাসের লেখক। বলা ভালো তিনি শুধু একজন লেখকই নন; সাংবাদিকও বটে; ঘুরেছেন দেশ-বিদেশ। ইতিহাসের আয়নায় দাঁড়িয়ে, অতিকথনীয় আবেগ বর্জন করে, সত্যকে তুলে ধরবার প্রয়াস থেকেই যবনিকা টেনেছেন এ উপন্যাসের। ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনার পেছনে যেসব চালিকাশক্তি কাজ করে- প্রেম, ঘৃণা, ক্ষমতার লোভ, বিশ্বাসঘাতকতা ও বিদ্রোহ, তা এখানে দারুণভাবে বিন্যাসিত। তাছাড়া, ভাষা প্রাঞ্জল; বুনন ও গাঁথুনিতে অপ্রয়োজনীয় মেদ নেই; সংলাপের আলখেল্লা কোথাও ঝুলে পড়েনি। ইতিহাস খুঁড়ে বিশ্বাসের অলিগলি ঢুঁরে উপন্যাস রচনা অনেক জটিল; তবুও সেই জটিল কাজকে নিজের আঙুলের ডগায় আনতে পেরেছেন জ্ঞানের ঋদ্ধতার কারণে। সব বিবেচনায় এ উপন্যাস রচনা সার্থক হয়েছে বলে আমি মনে করি। ১৮৩ পৃষ্ঠার বৃহৎ কলেবরের এ বইটি প্রকাশ করেছে সময় প্রকাশন। আব্বাস আল মুসাভির চিত্রকর্ম থেকে প্রচ্ছদ করেছেন মেধা রোশনান সারওয়ার। ছাপাখানার ভূত প্রকটভাবে মাথাচাড়া না দিলেও কোথাও কোথাও চোখ মেলে তাকিয়েছে। বইটির মূল্য ৪৬০.০০ টাকা।