নদীটা এখানে ছিল । খবরের কাগজ
ঢাকা ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪

নদীটা এখানে ছিল

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৩৪ পিএম
নদীটা এখানে ছিল

একদিন দূর থেকে দেখেছিলাম।
মৃত মানুষের শরীরে থাকা নিষ্প্রাণ ধমনীর মতো 
কিংবা মৃত গাছের শুকনো ডালের মতো
একটা মরা নদী…
বিছিয়ে পড়ে আছে জলহীন, দলহীন।
মানুষ মরে গেলে তবু মাটি কিংবা আগুনের হতে পারে।
গাছ মরে গেলেও তাই…
আর নদী?
বেঁচে থেকে কিংবা মরে গিয়েও কারও হতে পারে না।
যে জল তাকে সাগরে মেলায়, তারও হতে পারে না।
কোথাও যেতে পারবে না জেনেই জলহীন পড়ে থাকে নদী।
কোথাও যেতে পারবে না জেনেই দলহীন মরে থাকে নদী।

ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৪, ১২:২২ পিএম
ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা
অলংকরণ: মাসুম

ত্রিপুরার মাটি বাংলাদেশকে জন্মঋণে আবদ্ধ করেছে, পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ ও ধর্ষণ-নির্যাতন থেকে বাঁচতে ১৫ লাখ বাঙালি সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নিয়েছে ১৬ লাখ মানুষের ক্ষুদ্র ত্রিপুরা রাজ্যে। দেশত্যাগী এই উদ্বাস্তু অসহায়কে আগলে রেখেছে ত্রিপুরাবাসী পরম মমতায়। সীমান্তছোঁয়া আগরতলা এবং ত্রিপুরার পাহাড়, সমতল, গ্রাম, শহর-গঞ্জ সয়লাব হয়েছে লাখো ভিনদেশি জনস্রোতে ও মুক্তিবাহিনীর পদভারে। হাসপাতালগুলো ভরে উঠেছে আহত নারী-পুরুষে। ১৯৭১-এর বিস্ময়কর সেই ঐতিহাসিক উপাখ্যান প্রথমবারের মতো উঠে এসেছে উপন্যাসে।...

আগরতলার কুঞ্জবন থেকে শেষ পর্যন্ত কলকাতার গল্ফ গ্রিনের বাড়িতে পাড়ি জমাতে হয়েছে ডা. রথীন দত্তকে। বন্ধুবান্ধব ও ঘনিষ্ঠজনরা তার ত্রিপুরা ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তে মত দেয়নি। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে নিজের রাজ্যে থাকা হলো না প্রখ্যাত শল্যচিকিৎসক রথীন দত্তের। দীর্ঘ চাকরি জীবন শেষে অবসর নিলেন। ভাবলেন, যে বাড়িতে জীবনের এতগুলো বছর কাটল সেই বাড়িতে বাকি জীবনটাও কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু তা হয়নি। আগরতলার স্মৃতিঘেরা বাড়ি ছেড়ে পাড়ি জমাতে হলো তাকে দক্ষিণ কলকাতায়।

গল্ফ গ্রিনের বাড়িটা বেশ বড়, প্রচুর আলোবাতাস, বিস্তর গাছগাছালি, প্রশস্ত একটা ফুলবাগান। আধুনিক জীবনযাপনের প্রায় সবই আছে বাড়িটায়। কিন্তু সবকিছু থাকলেও লোকজন নেই। আগের বাড়িতে হরহামেশা লোকজনের যাতায়াত ছিল- এখানে তা নেই। কেমন এক সুনসান নীরবতা। ছেলেমেয়েরা দূর-দূরান্তে নিজেদের জীবনজীবিকা গুছিয়ে নিয়েছে। স্ত্রী গাইনোকলজিস্ট ডা. স্বপ্না দত্ত। তিনি যখন বেঁচে ছিলেন তখন সময় কমবেশি কাটত। অবসর নেওয়ার পর তিনিও গত হলেন। এখন নব্বই ছুঁইছুঁই বয়স সার্জন দত্তের। শরীর খানিকটা দুর্বল- ইচ্ছে করলেই আগের মতো চলাফেরা করতে পারেন না। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা বাইরেও যান না এখন। পুরনো সার্জন বন্ধুরা কেউ কেউ টেলিফোনে কথা বলেন, জুনিয়র ডাক্তাররা নানা বিষয়ে পরামর্শ নেয়, ভালোমন্দ খবর জানতে চায়। সার্জারির জরুরি কনসালটেন্সির কলও পান মাঝে-মধ্যে।

এদিকে বিশ্বে নতুন মরক শুরু হয়েছে। বিশ শতকের প্লেগ ১০০ বছর পেরোতেই একুশ শতকে এসে করোনার তাণ্ডব শুরু করেছে। ইউরোপের কিছু দেশে দলে দলে লোকজন মারা যাচ্ছে। এদের মধ্যে বয়স্ক মানুষের ভাগই বেশি। ভারতেও রোগটি ধরা পড়েছে কিন্তু মৃত্যুহার এখনো আতঙ্কজনক হয়ে ওঠেনি। এমন পরিস্থিতিতে বাড়ির বাইরে যাওয়া আরও সীমিত হয়েছে তার। চারদিকেই মৃত্যুর আতঙ্ক!

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে একটা রুটিন, অভ্যেসও বলা যায়, রপ্ত করেছেন সার্জন দত্ত। সকালে চা নিয়ে খবরের কাগজ হাতে দক্ষিণের জানালামুখী ড্রইং রুমটায় বসেন। রয়াল ক্যালকাটা গল্ফ ক্লাবের বিস্তৃত উদ্যান, দক্ষিণ কলকাতার বহু জায়গা দেখা যায় জানালা দিয়ে। সকালের সময়টা এভাবেই কাটান তিনি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের নতুন নতুন গবেষণার খবর নেন। নিজের রাজ্য ত্রিপুরার খবরাখবর জানার চেষ্টা করেন। বাংলাদেশের খবর পেলে প্রথম থেকে শেষ অব্দি চোখ বুলিয়ে নেন। চোখের ঝামেলাটা বেশ খানিকটা বেড়েছে, তবু চশমা চোখে নিয়মিত টেলিভিশন দেখেন। এক-দুটো বইও পড়েন। রবীন্দ্রসংগীত ও শচীন কর্তার গানের ভক্ত তিনি, আগে রেডিওতে শুনতেন, এখন একটা সাউন্ড সিস্টেম লাগিয়েছেন। বাছাই কিছু গান শুনে সময় কাটান।

নিচতলার দক্ষিণমুখী যে ঘরটায় প্রতিদিন সকালে তিনি বসেন, তার দুটি দেয়ালে নিজের পেশাগত ও পারিবারিক জীবনের অনেক স্মৃতিস্মারক সাজানো আছে। স্ত্রী, সন্তান ও নিজের ছবির বাইরেও আছে কয়েকটি বিশেষ মানুষের ছবি- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সি আর দাস, শরৎ চন্দ্র বসু, নেতাজী সুভাষ বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, মাস্টারদা সূর্য সেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্ত্রীর সঙ্গে মিলে নিজের রুচিতে ছবিগুলো পরিপাটি করে সাজিয়েছিলেন তিনি নতুন বাড়িতে ওঠার পর পর- সেও অনেক বছর হলো। দীর্ঘকালীন গৃহকর্মী ভজহরি এখন ধুলোবালি পরিষ্কার করে। অবসরপ্রাপ্ত সার্জন চেয়ারে বসেন, চশমাটা ঠিকঠাক করে দেয়ালের দিকে তাকান। ভারতের অন্যতম ক্ষুদ্র রাজ্য ত্রিপুরার দ্বিতীয় পদ্মশ্রী উপাধি লাভের গৌরব তার। শিক্ষাগত ও ডাক্তারি জীবনেরও অর্জন কম নেই। এর বাইরে আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা এবং আরও আছে একটি নয়-দশ বছরের বালিকার ছবি। তারও পাশে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের সিল দেওয়া একটি পুরনো খাম। খামের লেখাগুলো খুব স্পষ্ট না হলেও পড়া যায়। লেখাটা এ রকম: ‘বড় আব্বা, ডা. রথীন দত্ত, জিবি হাসপাতাল, কুঞ্জবন, আগরতলা, ত্রিপুরা, ভারত।’

পুরনো এই খামটা ডাক্তার দত্তের জীবনের বড় স্মৃতিস্মারক। মাঝেমধ্যে পা ফেলে তিনি দেয়ালটার কাছে যান। চশমা মুছে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখেন। চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে।

একদিন সকালের চা খেতে খেতে আনন্দবাজারসহ কয়েকটা দৈনিকের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন রথীন বাবু। পাশের টেবিলে রাখা আগরতলার দৈনিক সংবাদ ও কলকাতার আরও কিছু কাগজ। হঠাৎ একটি খবরে তার চোখ পড়ল। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বাংলাদেশের, সে নিয়ে কলকাতার সাউথ ব্লক ও ঢাকার সেগুন বাগিচার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আগাম প্রস্তুতি চলছে। নতুন দিল্লি ডেটলাইনের খবরটা তিনি মনোযোগসহকারে পড়লেন। কী মনে করে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। ধীরে এগিয়ে গিয়ে দেয়ালে সাঁটানো পুরনো চিঠিটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলেন। ইদানীং তার হাত কাঁপে- তবু পিন খুলে চিঠিটা হাতে নিলেন সার্জন দত্ত। তারপর আবার চেয়ারে গিয়ে বসলেন।

চলবে...

রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে জুজুৎসু

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৪, ১২:১৫ পিএম
রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে জুজুৎসু

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেন জাপানের ‘জুউদোও’ (জুডো) তথা ‘জুউজুৎসু’ (জুজুৎসু) খেলাকে পছন্দ করেছিলেন সে এক রহস্য। যদিও তিনি চেয়েছিলেন বাংলার ছেলেমেয়েরা জুজুৎসু ক্রীড়ায় পারদর্শী হয়ে শারীরিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠুক। সারা ভারতে ছড়িয়ে যাক জুউজুৎসুর কলাকৌশল। ভারতবর্ষে বাঙালিরা বরাবরই অগ্রগামী। সুতরাং জুউজুৎসুও বাংলা থেকে ভারতে ব্যাপ্তিলাভ করুক এটাও হয়তো তার মনে ছিল। তিনি যখন জুউজুৎসুকে শান্তিনিকেতনের আশ্রম বিদ্যালয়ে প্রচলন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তখন জাপানেও এই ক্রীড়াটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভের সন্ধিক্ষণ সেই সময়টা।

জুউ+দোও দুটো কানজি অক্ষরের সমন্বয়ে ‘জুউদোও’ শব্দ। ‘জুউ’ হচ্ছে ‘কোমল’ বা ‘নরম’ আর ‘দোও’ হচ্ছে ‘পথ’ বা ‘পদ্ধতি’ অর্থাৎ সহজপদ্ধতি। প্রতিপক্ষকে কঠোর আঘাত না করে কোমল কলাকৌশলে পরাস্ত করে নিজেকে রক্ষা করা।

মানুষের ব্যক্তিজীবনে প্রতিরক্ষা বা আত্মরক্ষামূলক পথ বা পদ্ধতি হিসেবেও দেশ-বিদেশে সমাদৃত এই ক্রীড়া। জুউদোও ছাড়াও ফুলসজ্জা (ইকেবানা), চা-অনুষ্ঠান (চাদোও), কেন্দোও (লাঠিখেলা), সুইবোকুগা (কালো রঙের চিত্রাঙ্কনচর্চা) ইত্যাদিও ‘সামুরাই সংস্কৃতি’র ধারা, যা খুবই নান্দনিক এবং মানবিক। সৌন্দর্যের পূজারি রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে এসব প্রচলন করতে প্রবলভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন।

বলা প্রয়োজন যে, সামুরাই যোদ্ধাদের চর্চিত ও লালিত সংস্কৃতি জাপানিদের জাতীয়তাবাদী চেতনার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। দেশব্যাপী ‘জুউদোও’, ‘কারাতে’, ‘কেন্দোও’র প্রচুর চর্চাকেন্দ্র বিদ্যমান। এগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতার অঙ্গ। কারণ এগুলোচর্চার মধ্যে পারস্পরিক অভিবাদন, সম্ভাষণ, স্বাস্থ্যজ্ঞান, সত্যনিষ্ঠা, আত্মসংযম, প্রফুল্লভাব, অধ্যাবসায়, আত্মনির্ভরতা, সহিষ্ণুতা ইত্যাদি গুণগুলোর বিকাশ ঘটে থাকে। যা জাতীয়তাবোধকে সুসংহত করে। সুতরাং জাপানি ‘জুউজুৎসু’ ক্রীড়া বাঙালি জাতীয়তাবোধে আপ্লুত রবীন্দ্রনাথকে যে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল তা আর না বললেও চলে। বাঙালি সন্তানরা দৈহিক-মানসিকভাবে শক্তিশালী হোক জাপানিদের মতো এটাই ছিল তার প্রকৃত লক্ষ্য বলে প্রতীয়মান হয়। সাম্রাজ্যবাদী শ্বেতাঙ্গ শক্তি ব্রিটিশশাসিত পরাধীন ভারতে বাঙালিরা যেভাবে নির্যাতিত, নিপীড়িত আর দুর্বল হয়েছিল; তাদের দেহমনে সবল হয়ে ওঠার লক্ষ্যে জাপানের তেজোদীপ্ত জাতিসত্তার অন্যতম প্রতীক ‘জুউজুৎসু’ তথা ‘জুউদোও’ খেলাটিকে তিনি মোক্ষম হাতিয়ার বলে বিবেচনা করেছিলেন সন্দেহ নেই। স্বদেশি যুগের স্বনামধন্য বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাস (১৮৭৭-১৯৪৯) যিনি ঢাকায় ‘অনুশীলন সমিতি’র শাখা প্রতিষ্ঠাতা, গোপনে জুউজুৎসু প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন জাপানি প্রশিক্ষক সানো জিননোসুকের কাছে। পরবর্তীকালে তরুণ বিপ্লবীদের কেউ কেউ পুলিন বিহারীর কাছ থেকে শিক্ষালাভ করেছিলেন বললে অত্যুক্তি হবে না। তাছাড়া, আরও একটি কারণ রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল মনে হয়, যেটা জুউদোও-জনক কানোও জিগোরোওর ভাষ্য থেকে জানা যায়, তা হলো:

‘কিছুদিন আগে গুরু টেগোর জাপানে আগমনের সময়, জাপানি সংস্কৃতি ভারতে প্রচলন করত ভারতীয় সংস্কৃতিকে অগ্রগামী করতে চাই, এই চিন্তা থেকে জুউদোও প্রশিক্ষককে আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনাকল্পে, কোওদোকান ভবনে আলাপ করতে আসেন। তখন পঞ্চম পদমর্যাদাসম্পন্ন তাকাগাকিকে নির্বাচন করা হয়।’

উল্লেখ্য, ১৯২৯ সালে শেষবারের মতো জাপানে আগমন করলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোওদোওকান ভবনে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেখানে তার সম্মানে জুউদোও খেলা দেখার সুযোগ হয়েছিল বলে মনে হয়। তখন তিনি পুনরায় শান্তিনিকেতনে একজন দক্ষ প্রশিক্ষক প্রেরণ করার অনুরোধ জানান তার সদ্য ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও আতিথ্যকর্তা কাগজ ব্যবসায়ী ও আধ্যাত্মিক চিন্তাবিদ ড. ওওকুরা কুনিহিকোকে। কুনিহিকো তার অনুরোধ রক্ষার্থে জুউদোও প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র কোওদোওকান ভবনের পরিচালক কানোও জিগোরোওর শরণাপন্ন হন। জুউদোও প্রশিক্ষক তাকাগাকি শিনজোওকে নির্বাচন করে শান্তিনিকেতনে পাঠানো হয়। কলিকাতায় তাকাগাকির জুউদোও খেলা উপভোগ করেছিলেন মেয়র সুভাষ চন্দ্র বসু।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘জুউজুৎসু’র কথা অবগত হলেন কীভাবে সেও এক রহস্য। এই সম্পর্কে কোথাও কোনো লেখা বা উৎস সম্পর্কে কিছু আছে কি না জানা নেই। ১৯০২ সালে যখন জাপানি মনীষী শিল্পাচার্য ওকাকুরা তেনশিন (১৮৬৩-১৯১৩) কলকাতায় যান এবং প্রায় ১০ মাস অবস্থান করেন ভারতে, তখন কি তার সঙ্গে কোনো কথা প্রসঙ্গে জুউজুৎসুর কথা জেনেছিলেন, নাকি জাপানি কোনো গ্রন্থাদি থেকে তিনি জেনেছিলেন সে-সম্পর্কেও তথ্যাদি অপর্যাপ্ত। ওকাকুরাকে তিনি একজন জুউজুৎসু প্রশিক্ষককে শান্তিনিকেতনে প্রেরণ করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন বলে কোনো কোনো উৎস থেকে জানা যায়। ওকাকুরা স্বনামধন্য কেইও গিজুকু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সানো জিননোসুকেকে ভারতে পাঠান। সানো তিন বছর শান্তিনিকেতনে অবস্থান করেছিলেন। বেশ কয়েক বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয় প্রশিক্ষক হিসেবে যান শিনজোও তাকাগাকি। তাতে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ কতখানি আগ্রহী ছিলেন জুউজুৎসুর বিষয়ে! এই গুরুত্বটাই অনুধাবন করেছিলেন জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক বাঙালিপ্রেমী অধ্যাপক কাজুও আজুমা (১৯৩১-২০১১), তাই ‘রবীন্দ্রনাথের চোখে জুউজুৎসু’ নামে একটি তথ্যবহুল অসাধারণ প্রবন্ধ লিখেছিলেন কলকাতার ‘বইয়ের দেশ’ ম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যায় ২০০৬ সালে।

প্রাগুক্ত দুজন জুউদোও প্রশিক্ষক শান্তিনিকেতনে গেলেও রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই জুউজুৎসু দীর্ঘদিন চালু রাখা যায়নি। অন্যান্য প্রদেশের ছাত্রদের আগ্রহ থাকলেও বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের ছিল না। ফলে ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়েছিল। তবে জুউজুৎসুর কল্যাণে প্রশিক্ষক সানো শান্তিনিকেতনে জাপানি ভাষাও শিখিয়েছেন, নিজেও বাংলা ভাষা শিখতে পেরেছিলেন, রবীন্দ্রসাহিত্যসহ ভারতের ইতিহাস, সংস্কৃতিও পাঠ করেছিলেন। জাপানে ফিরে আসার অনেক বছর পর ১৯২৪ সালে গুরুদেবের দীর্ঘ উপন্যাস ‘গোরা’ বাংলা থেকে জাপানি ভাষায় অনুবাদ করে অসামান্য একটি কাজ সম্পাদন করেছেন। শুধু তাই নয়, ভারত ও ভারতীয়দের সম্পর্কে একাধিক গ্রন্থও লিখে গেছেন।

পরিশেষে বলা যায়, ‘জুউজুৎসু’ তথা ‘জুউদোও’ খেলার মধ্যে যে অপূর্ব এক পুরুষালী সৌন্দর্য ও শৃঙ্খলা আছে সেটা রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। আর শক্তিশালী জাতিগঠনের ক্ষেত্রে ‘শৃঙ্খলা’ যে প্রথম ও প্রধান শর্ত সেটা তিনি ভালো করেই জানতেন। যা আছে ‘জউজুৎসু’র মধ্যে। শান্তিনিকেতনে সেই সময় যেসব ছাত্রছাত্রী জুউদোও শিক্ষালাভ করেছিলেন তাদের মধ্যে অমিতা সেন উল্লেখযোগ্য। তিনি বিশ্বভারতীর অধ্যাপক ও লোকগবেষক ক্ষিতিমোহন সেনের কন্যা এবং অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের মাতা।

রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানচিন্তা

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৪, ১২:০৭ পিএম
রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানচিন্তা
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আইনস্টাইন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) পেয়েছিলেন আশি বছরের আয়ু। এই দীর্ঘজীবনে তিনি সৃষ্টিশীল ভুবনের যেখানেই হাত দিয়েছেন, সোনা ফলিয়েছেন। অসামান্য কোনো মহৎ প্রতিভার পক্ষেই এ ধরনের অর্জন ও সিদ্ধিলাভ সম্ভবপর। কবি তার ছেলেবেলা থেকেই বিজ্ঞানমনস্ক ছিলেন। আগ্রহ, কৌতূহল ও অনুসন্ধিৎসা ছিল বিজ্ঞান বিষয়ে। তার বিচিত্রগামী প্রতিভার স্ফুরণ প্রতিফলন আছে যে বিপুল রচনাসম্ভারে, তার অনেক ক্ষেত্রেই আমরা বিজ্ঞানচিন্তার ছাপ দেখতে পাই। বস্তুত শিশুকালেই তার মানসগঠন হয়েছিল বৈজ্ঞানিক আবহে। ক্রমে ক্রমে তা বিকশিত হয়েছে। পেয়েছে পরিণতি। রবীন্দ্র সৃষ্টিসম্ভার বিজ্ঞানের মোহন আলোয় উদ্ভাসিত, ঐশ্বর্যমণ্ডিত এবং কালজয়ী হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন শিশু, তখন থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছিল। পরিণত বয়সে তিনি লিখলেন বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ ‘বিশ্বপরিচয়’। এ বইয়ে আছে পরমাণুলোক, গ্রহলোক, ভূলোক, নক্ষত্রলোক নামের অধ্যায়। সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় তিনি বিজ্ঞানের জটিল সব তথ্য ও তত্ত্ব পাঠকসমীপে উপস্থাপন করেছেন। খুব সহজেই তিনি প্রবেশ করেছেন বিষয়ের গভীরে। তার রচনাশৈলীর যে অনন্য মুনশিয়ানা, তার বৈগুণ্যে বিজ্ঞানের জটিল সব অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে বোধগম্য এবং উপভোগ্য।

তার কালে, পিছিয়ে থাকা বাঙালি সমাজে কেমন করে অতটা বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠেছিলেন তিনি? ‘বিশ্বপরিচয়’ বইয়ের ভূমিকায় এ সম্পর্কে বিশদ লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। লিখেছেন আমাদের মন অবৈজ্ঞানিক, শুধু বিদ্যার বিভাগে নয়, কাজের ক্ষেত্রেও আমাদের অকৃতার্থ করে রেখেছে। ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ,

‘…আমি বিজ্ঞানের সাধক নই সে কথা বলা বাহুল্য। কিন্তু বালককাল থেকে বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত ছিল না। আমার বয়স বোধ করি তখন নয়-দশ বছর; মাঝে মাঝে রবিবারে হঠাৎ আসতেন সীতানাথ দত্ত [ঘোষ] মহাশয়। আজ জানি তাঁর পুঁজি বেশি ছিল না, কিন্তু বিজ্ঞানের অতি সাধারণ দুই-একটি তত্ত্ব যখন দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিতেন আমার মন বিস্ফারিত হয়ে যেত। মনে আছে আগুনে বসালে তলার জল গরমে হালকা হয়ে উপরে ওঠে আর উপরের ঠাণ্ডা ভারী জল নীচে নামতে থাকে, জল গরম হওয়ার এই কারণটা যখন তিনি কাঠের গুঁড়োর যোগে স্পষ্ট করে দিলেন, তখন অনবচ্ছিন্ন জলে একই কালে যে উপরে নীচে নিরন্তর ভেদ ঘটতে পারে তারই বিস্ময়ের স্মৃতি আজও মনে আছে। যে ঘটনাকে স্বতই সহজ ব’লে বিনা চিন্তায় ধরে নিয়েছিলুম সেটা সহজ নয় এই কথাটা বোধ হয় সেই প্রথম আমার মনকে ভাবিয়ে তুলেছিল। তার পরে বয়স তখন হয়তো বারো হবে (কেউ কেউ যেমন রঙ-কানা থাকে আমি তেমনি তারিখ-কানা এই কথাটি বলে রাখা ভালো) পিতৃদেবের সঙ্গে গিয়েছিলুম ড্যালহৌসি পাহাড়ে। সমস্তদিন ঝাঁপানে করে গিয়ে সন্ধ্যাবেলায় পৌঁছতুম ডাকবাংলায়। তিনি চৌকি আনিয়ে আঙিনায় বসতেন। দেখতে দেখতে, গিরিশৃঙ্গের বেড়া-দেওয়া নিবিড় নীল আকাশের স্বচ্ছ অন্ধকারে তারাগুলি যেন কাছে নেমে আসত। তিনি আমাকে নক্ষত্র চিনিয়ে দিতেন, গ্রহ চিনিয়ে দিতেন। শুধু চিনিয়ে দেওয়া নয়, সূর্য থেকে তাদের কক্ষচক্রের দূরত্বমাত্রা, প্রদক্ষিণের সময় এবং অন্যান্য বিবরণ আমাকে শুনিয়ে যেতেন। তিনি যা বলে যেতেন তাই মনে ক’রে তখনকার কাঁচা হাতে আমি একটা বড়ো প্রবন্ধ লিখেছি। স্বাদ পেয়েছিলুম বলেই লিখেছিলুম, জীবনে এই আমার প্রথম ধারাবাহিক রচনা, আর সেটা বৈজ্ঞানিক সংবাদ নিয়ে।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বিভিন্ন কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, নাটক, উপন্যাসেও আমরা পাব বিজ্ঞানচেতনার সুস্পষ্ট প্রতিফলন ও বর্ণচ্ছটা। আমরা জানি, বিশ্বনন্দিত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন ও জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে নিবিড় গভীর বন্ধুতা ছিল কবির। গ্রামোন্নয়ন ও কৃষির উন্নতির কথা শুধু ভাবেনইনি, এই কাজে রীতিমতো ব্রতী ও উদ্যোগী হয়েছিলেন। পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিতে পাঠিয়েছিলেন। রথীন্দ্রনাথের অধীত বিষয় ছিল কৃষি ও গো পালন। গ্রাম উন্নয়ন করার লক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথই প্রথম চালু করেছিলেন সমবায় ব্যাংক। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রীনিকেতনের কাছে কৃষি গবেষণাগার। সারা জীবন তিনি কৃষি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছেন। এক পত্রে তার প্রিয় বিজ্ঞানীবন্ধু জগদীশচন্দ্র বসুকে লিখছেন,

‘আমার চাষ-বাসের কাজও মন্দ চলিতেছে না। আমেরিকান ভুট্টার বীজ আনিয়েছিলাম- তাহার গাছগুলা দ্রুতবেগে বাড়িয়া উঠিতেছে। মান্দ্রাজি সরু ধান রোপণ করিয়াছি, তাহাতেও কোন অংশে নিরাশ হইবার কারণ দেখিতেছি না।’

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক শ্যামল চক্রবর্তী বাংলা একাডেমি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন বেশ কয়েক বছর আগে। উপস্থাপিত প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের বহু গল্পে বিজ্ঞান ভাবনার উজ্জ্বল উপস্থিতি রয়েছে। শেষ জীবনে তিনি বিজ্ঞানকে তার ভাবনার অন্যতম প্রধান উপজীব্য বিষয় করে তুলেছিলেন। ছিয়াত্তর বছর বয়সে তিনি ‘বিশ্বপরিচয়’-এর পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন। তিনি ‘সমগ্র’ দিয়ে বিজ্ঞানকে অনুভব করার কথা বলতেন।’

একই অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ ইব্রাহীম বলেন, ‘জীবনকে যিনি বুঝতে ও উপভোগ করতে চান তার দরকার বিজ্ঞানচর্চা। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন প্রায়োগিক বিজ্ঞানী। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যুক্তিতর্কের মাধ্যমে ভালো কিছু করার চেষ্টা করতেন। তিনি মহাবিশ্ব, গ্যালাক্সি, সীমা-পরিসীমা সর্বোপরি বৃহতের সন্ধান করতেন। বিভিন্ন গ্রহের মধ্যে জীবের সন্ধান অনুধাবন করেন তিনি, যা নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচায়ক।’

শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৪, ১২:০২ পিএম
শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ

‘আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতূহল ভরে, আজি হতে শতবর্ষ পরে!’…

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ছিন্নপত্র’ ১০ মে ১৮৯৩ সালে শিলাইদহে লিখেছেন, ‘এই দরিদ্র প্রজাগুলোকে দেখলে আমার ভারি মায়া করে, এরা যেন বিধাতার শিশুসন্তানের মতো নিরুপায়। তিনি এদের মুখে নিজের হাতে কিছু তুলে না দিলে এদের আর গতি নেই। পৃথিবীর স্তন যখন শুকিয়ে যায় তখন এরা কেবল কাঁদতে জানে- কোনোমতে একটুখানি ক্ষুধা ভাঙলেই আবার তখনই সমস্ত কিছু ভুলে যায়।’...

রবীন্দ্রনাথের চেতনায় নন্দনতত্ত্ব, বিশ্বমানবিকতা বা মানবধর্ম প্রধানত ছিল তার গভীর আধ্যাত্মিক উপলব্ধিজাত ও সত্য। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে পৃথিবীর সৃষ্টি ও বিবর্তনের লীলাকে গ্রহণ করেও তিনি মানুষ এবং পৃথিবীর সামগ্রিক পরিপূর্ণ পরিচয় পাওয়ার জন্য দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টি উন্মুক্ত রেখেছিলেন, এখানেই তার অনন্যতা এবং বিশেষত্ব। রবীন্দ্রনাথ তার কৈশোর থেকে পরিণত বয়সে বহুবার কুষ্টিয়ার শিলাইদহ এসেছেন এবং কুঠিবাড়িতে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছেন। শুধু সস্ত্রীক শেষবার যখন এসেছিলেন, তখন উপলক্ষ ছিল জমিদারির পড়ে থাকা বকেয়া খাজনা আদায়। যত না খাজনা আদায় হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি তিনি গ্রাম-বাংলার অজপাড়াগাঁয়ের সৌন্দর্যসুধা প্রাণ ভরে উপভোগ করেছেন। পদ্মা-গড়াই পলিবিধৌত শান্ত-সমাহিত গ্রাম ও মেঠোপথের ছবি যেমন বক্ষে ধারণ করেছেন, তেমনি তার কাব্যিক দৃষ্টি দিয়ে অবলোকন করেছেন খেয়া পারাপারের মাঝিটিকে পর্যন্ত। এসবের ছাপ তার ‘সোনার তরী’ ও ‘মানসী’ কাব্যে পাওয়া যায়।

কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদহ গ্রাম ‘বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ এই বিশ্ববিখ্যাত নামের সঙ্গে জড়িত হয়ে সারা বিশ্বে পরিচিত হয়েছে। সম্ভবত, খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীর দিকে শিলাইদহে পূজনীয় শীলাদেবীর মন্দির ও শিলাকুঞ্জ বা দহ ছিল। সেই থেকে শিলাইদহ নামের উৎপত্তি। ড. নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাংলার নদনদী’ গ্রন্থে এর সমর্থন পাওয়া যায়। ১৭৯১-১৮০৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ রামলোচন ঠাকুর নাটোররাজ রামকৃষ্ণ রায়ের জমিদারি অঞ্চল বিরাহিমপুর পরগনা নিলামে ক্রয় করেন। ঠাকুরবাড়ির শিলাইদহ জমিদারি ছিল অবিভক্ত নদীয়া জেলার ৩৪৩০ সংখ্যক তৌজিভুক্ত। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর নীলকর সাহেব মি. শেলীর নীলচাষের জমিজমা ও কুঠিবাড়ি ক্রয় করেন এবং ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শিলাইদহে চিনি কারখানা স্থাপন করেন। শিলাইদহে নীলকর সাহেবদের কুঠি নদীগর্ভে বিলীন হলে ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান নতুন কুঠিবাড়ি নির্মিত হয়; যা ১৩ বিঘা জমির ওপর অবস্থিত এবং আম, কাঁঠাল, ফুলের বাগান, দুটি পুকুরসহ বিস্তৃত সবুজের সমারোহে শিলাইদহ কুঠিবাড়ি।

রবীন্দ্র জীবনীকার শ্রীশচীন্দ্রনাথ অধিকারী তার ‘রবীন্দ্রনাথ ও শিলাইদহ’ গ্রন্থে লিখেছেন: “মাত্র ১৫ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে শিলাইদহে প্রথম আসেন। এখানকার জঙ্গলে বিশ্বনাথ শিকারির সঙ্গে বাঘশিকারের কথা কবি তার ‘ছেলেবেলা’ গ্রন্থে লিখেছেন।” কবি ২৭ বছর বয়সে ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে শিলাইদহে এসে নৌকাবাস করেন। ২৯ বছর বয়সে ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে কবি জমিদারি দেখাশোনার ভার পান এবং শিলাইদহে এসে কাছারির পুণ্যাহ উৎসবে যোগ দেন, প্রজাদের সঙ্গে কবির পরিচয় হয়। কিন্তু কবি ‘ছেলেবেলা’ বইতে তার ছেলেবেলার স্মৃতিচারণে শিলাইদহের আব্দুল মাঝির কথা এবং অন্য পাতায় শিলাইদহে ফুল বাগানের মালির সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো বিষয়ে যা লিখেছেন তাতে সুস্পষ্ট ধারণা হয়, তিনি ১৮৭৬ সালে অথবা তার আগেও শিলাইদহে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে ১৮৯১ সালে ‘ছিন্নপত্র’ গ্রন্থে উল্লেখ, কবি শিলাইদহ থেকে একখানা চিঠিতে যা লিখেছেন সেটাও ওই ধারণার সহায়ক। এ ছাড়া এর আগে কবি বাল্যকালে তার দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গে রেলগাড়িতে চড়ার শখে কুষ্টিয়া এসে তার পর নদীপথে শিলাইদহে গিয়েছিলেন বলেও জানা যায়। রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় ১৮৯০-১৯১০। ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় এসে জমিদারি পরিদর্শন করেন এবং সমুদয় ভার গ্রহণ করেন। শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ প্রথমে ‘চিত্রা’ ও পরে ‘পদ্মা’ বজরায় নদীভ্রমণ করতেন আর প্রজাবর্গের কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে যেতেন। জীবনের শেষ পাদপীঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন: ‘আমার যৌবন ও প্রৌঢ় বয়সের সাহিত্য-রস-সাধনার তীর্থস্থান ছিল পদ্মা প্রবাহ চুম্বিত শিলাইদহ পল্লীতে’।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়ির পরিচিতি সারা দেশ, এমনকি বিশ্বব্যাপী। তবে খাজনা আদয়ের লক্ষ্যে কুঠিবাড়ির খুব কাছেই স্মৃতিধন্য আরেকটি স্থাপনা ১৮৯২ সালে নির্মিত হয় দ্বিতল ভবনবিশিষ্ট শিলাইদহ কাছারি বাড়ি। শিলাইদহ ছিল রবীন্দ্রনাথের জমিদারির কেন্দ্রবিন্দু। কবি এখান থেকেই শাহাজাদপুর, পতিসর যাতায়াত করতেন। রবীন্দ্রনাথের আগমন উপলক্ষে কাছারি বাড়িকে জাঁকজমকের সঙ্গে সজ্জিত করা হতো। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক পূজা-পার্বন-অনুষ্ঠানে পুণ্যপ্রার্থী প্রজাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ মিশে যেতেন, বরকন্দাজরা গোল হয়ে ঘিরে ধরত তাকে। লাঠিয়ালরা নানারূপ লাঠিখেলা, কুস্তি, বল্লম ও তরবারী খেলায় বাহাদুরি প্রদর্শন করে বাবু মশায়ের নিকট থেকে পুরস্কার নিত। এই কাছারিতে থাকত না কোনো পার্থক্য জমিদার এবং প্রজার। এক আসনে বসতে হবে রবীন্দ্রনাথের হুকুম!

‘কোনো জিনিসের আরম্ভ কী করে হয় তা বলা যায় না। সেই আরম্ভকালটি রহস্যে আবৃত থাকে। আমি চল্লিশ বৎসর পর্যন্ত পদ্মার বোটে কাটিয়েছি, আমার প্রতিবেশী ছিল বালিচরের চক্রবাকের দল। তাদের মধ্যে বসে বসে আমি বই লিখেছি। হয়তো চিরকাল এইভাবেই কাটাতুম। কিন্তু মন হঠাৎ কেন বিদ্রোহী হল, কেন ভাবজগৎ থেকে কর্মজগতে প্রবেশ করলাম।’...

রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছেন, ‘আমার জন্মগত পেশা জমিদারি, কিন্তু আমার স্বভাবগত পেশা আসমানদারি’। ১৮৯১ সালে শিলাইদহে ব্যবসা পরিচালনার জন্য রবীন্দ্রনাথ ‘টেগর অ্যান্ড কোম্পানি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন কুষ্টিয়া শহরের মিলপাড়ায় কবি আজিজুর রহমান সড়কে। পরে ১৮৯৫ সালে ‘টেগর অ্যান্ড কোম্পানি’র অফিস স্থাপন করেন টেগর লজে। ‘টেগর লজ’-এর নামকরণ ‘কুষ্টিয়া কুঠিবাড়ি’ কবি নিজেই করেন। ‘টেগর লজ’-এর পাশেই ভুষিমালের ব্যবসার পাশাপাশি এখানে জুট বেলিং প্রেস এবং আখমাড়াই কল ও কৃষি সরঞ্জামনির্মাণ ব্যবসা যুক্ত করেন। অনেক সময় কলকাতা থেকে ট্রেনে কুষ্টিয়ায় নেমে শিলাইদহে যাওয়ার পথে ‘টেগর লজে’ বিশ্রাম নিতেন কিংবা রাত্রিবাস করতেন। রবীন্দ্রনাথ শেষবারের মতো ১৯২২ সালের জানুয়ারি মাসে শিলাইদহে আসেন। তাই কবি আবেগভরা কণ্ঠে বলেছিলেন,

‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী
আমারই সোনার ধানে গিয়াছে যে ভরি’।
বাঙালি চিরকাল যাদের নিয়ে গর্ব করবে, তাদের মধ্যে অন্যতম।

বিশ্বসভায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৪, ১১:৫৮ এএম
বিশ্বসভায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ২৫ বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দ, ৭ মে ১৮৬১ সোমবার রাত ২টা ১০ মিনিটে কলকাতার দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাতা সারদা সুন্দরী দেবী। তিনি পিতার চতুর্দশ সন্তান, অষ্টম পুত্র। ১৩ নভেম্বর ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি (ইংরেজি অনুবাদ) কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। গীতাঞ্জলিই রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বকবির পরিচয় এনে দিয়েছে। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘স্যার’ উপাধি (নাইটহুড) দেয়, তবে তিনি তা বর্জন করেন। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ৫২টি, নাটক ৩৮টি, উপন্যাস ১৩টি, প্রবন্ধ ৩৬টি, ছোটোগল্প ৯৫টি, গান ১৯১৫টি, ছবি ২০০০টি। প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনাসমূহ ৩২ খণ্ডে ‘রবীন্দ্র রচনাবলি’ এবং পত্রসাহিত্য উনিশ খণ্ডে চিঠিপত্র প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের রচনা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। প্রতিবছর ২৫ বৈশাখ উপলক্ষে ‘রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উৎসব’ সাড়ম্বরে পালিত হয় কুষ্টিয়ার শিলাইদহ ও স্মৃতিমাখা টেগর লজে, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের কাছারিবাড়ি, নওগাঁর আত্রাই উপজেলার পতিসর এবং খুলনার দক্ষিণডিহিতে। ২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ, ৭ আগস্ট ১৯৪১ দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে ৮০ বছর ৩ মাস বয়সে রবীন্দ্রনাথ কলকাতার জোড়াসাঁকোরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।