কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেন জাপানের ‘জুউদোও’ (জুডো) তথা ‘জুউজুৎসু’ (জুজুৎসু) খেলাকে পছন্দ করেছিলেন সে এক রহস্য। যদিও তিনি চেয়েছিলেন বাংলার ছেলেমেয়েরা জুজুৎসু ক্রীড়ায় পারদর্শী হয়ে শারীরিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠুক। সারা ভারতে ছড়িয়ে যাক জুউজুৎসুর কলাকৌশল। ভারতবর্ষে বাঙালিরা বরাবরই অগ্রগামী। সুতরাং জুউজুৎসুও বাংলা থেকে ভারতে ব্যাপ্তিলাভ করুক এটাও হয়তো তার মনে ছিল। তিনি যখন জুউজুৎসুকে শান্তিনিকেতনের আশ্রম বিদ্যালয়ে প্রচলন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তখন জাপানেও এই ক্রীড়াটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভের সন্ধিক্ষণ সেই সময়টা।
জুউ+দোও দুটো কানজি অক্ষরের সমন্বয়ে ‘জুউদোও’ শব্দ। ‘জুউ’ হচ্ছে ‘কোমল’ বা ‘নরম’ আর ‘দোও’ হচ্ছে ‘পথ’ বা ‘পদ্ধতি’ অর্থাৎ সহজপদ্ধতি। প্রতিপক্ষকে কঠোর আঘাত না করে কোমল কলাকৌশলে পরাস্ত করে নিজেকে রক্ষা করা।
মানুষের ব্যক্তিজীবনে প্রতিরক্ষা বা আত্মরক্ষামূলক পথ বা পদ্ধতি হিসেবেও দেশ-বিদেশে সমাদৃত এই ক্রীড়া। জুউদোও ছাড়াও ফুলসজ্জা (ইকেবানা), চা-অনুষ্ঠান (চাদোও), কেন্দোও (লাঠিখেলা), সুইবোকুগা (কালো রঙের চিত্রাঙ্কনচর্চা) ইত্যাদিও ‘সামুরাই সংস্কৃতি’র ধারা, যা খুবই নান্দনিক এবং মানবিক। সৌন্দর্যের পূজারি রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে এসব প্রচলন করতে প্রবলভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন।
বলা প্রয়োজন যে, সামুরাই যোদ্ধাদের চর্চিত ও লালিত সংস্কৃতি জাপানিদের জাতীয়তাবাদী চেতনার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। দেশব্যাপী ‘জুউদোও’, ‘কারাতে’, ‘কেন্দোও’র প্রচুর চর্চাকেন্দ্র বিদ্যমান। এগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতার অঙ্গ। কারণ এগুলোচর্চার মধ্যে পারস্পরিক অভিবাদন, সম্ভাষণ, স্বাস্থ্যজ্ঞান, সত্যনিষ্ঠা, আত্মসংযম, প্রফুল্লভাব, অধ্যাবসায়, আত্মনির্ভরতা, সহিষ্ণুতা ইত্যাদি গুণগুলোর বিকাশ ঘটে থাকে। যা জাতীয়তাবোধকে সুসংহত করে। সুতরাং জাপানি ‘জুউজুৎসু’ ক্রীড়া বাঙালি জাতীয়তাবোধে আপ্লুত রবীন্দ্রনাথকে যে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল তা আর না বললেও চলে। বাঙালি সন্তানরা দৈহিক-মানসিকভাবে শক্তিশালী হোক জাপানিদের মতো এটাই ছিল তার প্রকৃত লক্ষ্য বলে প্রতীয়মান হয়। সাম্রাজ্যবাদী শ্বেতাঙ্গ শক্তি ব্রিটিশশাসিত পরাধীন ভারতে বাঙালিরা যেভাবে নির্যাতিত, নিপীড়িত আর দুর্বল হয়েছিল; তাদের দেহমনে সবল হয়ে ওঠার লক্ষ্যে জাপানের তেজোদীপ্ত জাতিসত্তার অন্যতম প্রতীক ‘জুউজুৎসু’ তথা ‘জুউদোও’ খেলাটিকে তিনি মোক্ষম হাতিয়ার বলে বিবেচনা করেছিলেন সন্দেহ নেই। স্বদেশি যুগের স্বনামধন্য বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাস (১৮৭৭-১৯৪৯) যিনি ঢাকায় ‘অনুশীলন সমিতি’র শাখা প্রতিষ্ঠাতা, গোপনে জুউজুৎসু প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন জাপানি প্রশিক্ষক সানো জিননোসুকের কাছে। পরবর্তীকালে তরুণ বিপ্লবীদের কেউ কেউ পুলিন বিহারীর কাছ থেকে শিক্ষালাভ করেছিলেন বললে অত্যুক্তি হবে না। তাছাড়া, আরও একটি কারণ রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল মনে হয়, যেটা জুউদোও-জনক কানোও জিগোরোওর ভাষ্য থেকে জানা যায়, তা হলো:
‘কিছুদিন আগে গুরু টেগোর জাপানে আগমনের সময়, জাপানি সংস্কৃতি ভারতে প্রচলন করত ভারতীয় সংস্কৃতিকে অগ্রগামী করতে চাই, এই চিন্তা থেকে জুউদোও প্রশিক্ষককে আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনাকল্পে, কোওদোকান ভবনে আলাপ করতে আসেন। তখন পঞ্চম পদমর্যাদাসম্পন্ন তাকাগাকিকে নির্বাচন করা হয়।’
উল্লেখ্য, ১৯২৯ সালে শেষবারের মতো জাপানে আগমন করলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোওদোওকান ভবনে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেখানে তার সম্মানে জুউদোও খেলা দেখার সুযোগ হয়েছিল বলে মনে হয়। তখন তিনি পুনরায় শান্তিনিকেতনে একজন দক্ষ প্রশিক্ষক প্রেরণ করার অনুরোধ জানান তার সদ্য ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও আতিথ্যকর্তা কাগজ ব্যবসায়ী ও আধ্যাত্মিক চিন্তাবিদ ড. ওওকুরা কুনিহিকোকে। কুনিহিকো তার অনুরোধ রক্ষার্থে জুউদোও প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র কোওদোওকান ভবনের পরিচালক কানোও জিগোরোওর শরণাপন্ন হন। জুউদোও প্রশিক্ষক তাকাগাকি শিনজোওকে নির্বাচন করে শান্তিনিকেতনে পাঠানো হয়। কলিকাতায় তাকাগাকির জুউদোও খেলা উপভোগ করেছিলেন মেয়র সুভাষ চন্দ্র বসু।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘জুউজুৎসু’র কথা অবগত হলেন কীভাবে সেও এক রহস্য। এই সম্পর্কে কোথাও কোনো লেখা বা উৎস সম্পর্কে কিছু আছে কি না জানা নেই। ১৯০২ সালে যখন জাপানি মনীষী শিল্পাচার্য ওকাকুরা তেনশিন (১৮৬৩-১৯১৩) কলকাতায় যান এবং প্রায় ১০ মাস অবস্থান করেন ভারতে, তখন কি তার সঙ্গে কোনো কথা প্রসঙ্গে জুউজুৎসুর কথা জেনেছিলেন, নাকি জাপানি কোনো গ্রন্থাদি থেকে তিনি জেনেছিলেন সে-সম্পর্কেও তথ্যাদি অপর্যাপ্ত। ওকাকুরাকে তিনি একজন জুউজুৎসু প্রশিক্ষককে শান্তিনিকেতনে প্রেরণ করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন বলে কোনো কোনো উৎস থেকে জানা যায়। ওকাকুরা স্বনামধন্য কেইও গিজুকু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সানো জিননোসুকেকে ভারতে পাঠান। সানো তিন বছর শান্তিনিকেতনে অবস্থান করেছিলেন। বেশ কয়েক বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয় প্রশিক্ষক হিসেবে যান শিনজোও তাকাগাকি। তাতে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ কতখানি আগ্রহী ছিলেন জুউজুৎসুর বিষয়ে! এই গুরুত্বটাই অনুধাবন করেছিলেন জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক বাঙালিপ্রেমী অধ্যাপক কাজুও আজুমা (১৯৩১-২০১১), তাই ‘রবীন্দ্রনাথের চোখে জুউজুৎসু’ নামে একটি তথ্যবহুল অসাধারণ প্রবন্ধ লিখেছিলেন কলকাতার ‘বইয়ের দেশ’ ম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যায় ২০০৬ সালে।
প্রাগুক্ত দুজন জুউদোও প্রশিক্ষক শান্তিনিকেতনে গেলেও রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই জুউজুৎসু দীর্ঘদিন চালু রাখা যায়নি। অন্যান্য প্রদেশের ছাত্রদের আগ্রহ থাকলেও বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের ছিল না। ফলে ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়েছিল। তবে জুউজুৎসুর কল্যাণে প্রশিক্ষক সানো শান্তিনিকেতনে জাপানি ভাষাও শিখিয়েছেন, নিজেও বাংলা ভাষা শিখতে পেরেছিলেন, রবীন্দ্রসাহিত্যসহ ভারতের ইতিহাস, সংস্কৃতিও পাঠ করেছিলেন। জাপানে ফিরে আসার অনেক বছর পর ১৯২৪ সালে গুরুদেবের দীর্ঘ উপন্যাস ‘গোরা’ বাংলা থেকে জাপানি ভাষায় অনুবাদ করে অসামান্য একটি কাজ সম্পাদন করেছেন। শুধু তাই নয়, ভারত ও ভারতীয়দের সম্পর্কে একাধিক গ্রন্থও লিখে গেছেন।
পরিশেষে বলা যায়, ‘জুউজুৎসু’ তথা ‘জুউদোও’ খেলার মধ্যে যে অপূর্ব এক পুরুষালী সৌন্দর্য ও শৃঙ্খলা আছে সেটা রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। আর শক্তিশালী জাতিগঠনের ক্ষেত্রে ‘শৃঙ্খলা’ যে প্রথম ও প্রধান শর্ত সেটা তিনি ভালো করেই জানতেন। যা আছে ‘জউজুৎসু’র মধ্যে। শান্তিনিকেতনে সেই সময় যেসব ছাত্রছাত্রী জুউদোও শিক্ষালাভ করেছিলেন তাদের মধ্যে অমিতা সেন উল্লেখযোগ্য। তিনি বিশ্বভারতীর অধ্যাপক ও লোকগবেষক ক্ষিতিমোহন সেনের কন্যা এবং অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের মাতা।