চলতি বছরের শুরু থেকে অন্তত দশবার তামিলনাড়ু সফর করেছেন নরেন্দ্র মোদি। একই রকমভাবে বারবার ফিরে গেছেন দক্ষিণ ভারতের আরেক রাজ্য কেরালাতেও। মোদি সেখানে আসন পেতে এবং নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে উদগ্রীব। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তামিলনাড়ু বা কেরালার মতো রাজ্যে এই মুহূর্তে বিজেপির কোনো সংসদ সদস্যই নেই। অন্ধ্রপ্রদেশেও একই অবস্থা।
দক্ষিণ ভারতের পাঁচ রাজ্য- অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, কর্নাটক, তামিলনাড়ু ও কেরালা এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল পন্ডিচেরি মিলে যে মোট ১৩০টি সংসদীয় আসন রয়েছে, তার মধ্যে বিজেপির হাতে রয়েছে মাত্র ২৯টি।
ওই ২৯ আসনের ২৫টিই কর্নাটকের, আর বাকি চারটি তেলেঙ্গানার। কর্নাটকই দক্ষিণের একমাত্র রাজ্য, যেখানে বিজেপি এককভাবে কোনো সরকার গড়তে পেরেছে। তবে গত বছরের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস সেখানে জিতে আবার ক্ষমতায় ফিরেছে।
তামিলনাড়ুতে ভোট হয়েছে গত ১৯ এপ্রিল। গতকাল শুক্রবার ভোট হচ্ছে কেরালায় ও দক্ষিণ কর্নাটকে। কর্নাটকের উত্তরাঞ্চলে ভোট ৭ মে, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানায় ভোট ১৩ মে।
এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি জোটের জন্য চারশরও বেশি আসন পেতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। ওই লক্ষ্যের ধারে-কাছে যেতে হলে বিজেপির দক্ষিণ ভারতে বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি আসন পেতে হবে।
কারণ উত্তর, পশ্চিম বা পূর্ব ভারতে যেসব রাজ্য রয়েছে, সেগুলো প্রায় সর্বোচ্চসংখ্যক আসন তাদের ঝুলিতে আগে থেকেই আছে। সেগুলো আর নতুন করে বাড়ানোর কিছু নেই। ফলে বিজেপির আসন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে কেবল দক্ষিণেই।
ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে, দক্ষিণে চিরকালই বিজেপির রাজনৈতিক ভাবধারা ও দর্শন প্রত্যাখ্যান হয়ে এসেছে। শতকরা ভোটের হার বা আসনসংখ্যা– দুই দিক থেকেই ওই রাজ্যগুলোতে বিজেপির প্রভাব বরাবরই ছিল নগণ্য।
মাঝেসাঝে তামিলনাড়ু বা অবিভক্ত অন্ধ্রে দু-একটা আসন পেলেও কর্নাটক ছাড়া বিজেপি দক্ষিণের কোনো স্থানেই তেমন কোনো সাফল্য পায়নি।
বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে নানা ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক বা রাজনৈতিক কারণ আছে, যা অতিক্রম করার জন্য তারা এখন চেষ্টা চালাচ্ছে।
ব্লুমবার্গের কলামিস্ট ও বিশ্লেষক অ্যান্ডি মুখার্জি জানান, দক্ষিণ ভারতে সামাজিক সংস্কারের একটা দীর্ঘ পরম্পরা আছে। সেটাই তাদের উত্তর ভারতের রাজনীতি থেকে চিরকাল আলাদা করে রেখেছে।
তিনি বলেন, ‘তামিলনাড়ু হিন্দুদের জাতপাতের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন লড়াই করেছে। পাশের রাজ্য কেরালাতেও শিক্ষার হার প্রায় একশ ভাগ, আর সেটাই ছিল ভারতে প্রথম রাজ্য- যেখানে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় এসেছিল। ফলে বিজেপির ধর্মভিত্তিক রাজনীতি কখনো সেখানে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।’
দক্ষিণ ভারতের বেশ কয়েকটি স্থান মুসলিম বা খ্রিষ্টান অধ্যুষিত হলেও সার্বিকভাবে গোটা অঞ্চলটিই হিন্দুপ্রধান। সেখানকার হিন্দু জনগোষ্ঠী সাধারণভাবে খুবই ধর্মভীরু। হিন্দুদের খুব গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী মন্দিরগুলোর বেশির ভাগও দক্ষিণ ভারতে অবস্থিত। তা সত্ত্বেও বিজেপির মতো একটি হিন্দুত্ববাদী দল সুবিধা করতে পারেনি দক্ষিণ ভারতে।
তামিলভাষী প্রবীণ সাংবাদিক সুধা রামাচন্দ্রনের মতে, বিজেপির হিন্দুত্বের সংজ্ঞা, আর দক্ষিণের মানুষের হিন্দু জীবনচর্যার মধ্যে বিরাট পার্থক্য আছে। ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’ সাময়িকীর দক্ষিণ এশিয়া সংস্করণের সম্পাদক রামাচন্দ্রনের মতে, ‘দক্ষিণ ভারতে যে দ্রাবিড়িয়ান আদর্শবাদ প্রসার পেয়েছে, সেটা ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ফলে বিজেপিকে সেখানে দেখা হয় হিন্দি-হিন্দুত্ব-উচ্চবর্ণের আদর্শের প্রতীক হিসেবে। দুটোর মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত বিরোধ আছে।’
অন্যদিকে সিপিআইএমের পলিটব্যুরো সদস্য ও তামিলনাড়ুর রাজনীতিক জি রামাকৃষ্ণন বলেন, ‘দক্ষিণ ভারতের মানুষ কিন্তু হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে নন, তবে তারা হিন্দুত্বের বিরোধী।’
তিনি আরও বলেন, ‘হিন্দুত্ববাদীদের আইকন সাভারকর নিজেই বলেছিলেন হিন্দুত্ব আর হিন্দু ধর্ম এক জিনিস নয়। তাদের হিন্দুত্ব হলো একটা রাজনৈতিক প্রকল্প, যা দক্ষিণ ভারতের মানুষ সব সময় বর্জন করে এসেছে।’
দক্ষিণ ভারতের ‘রাজনৈতিক রহস্য’ যে বিজেপি দীর্ঘদিন ভেদ করতে পারেনি, তা দিল্লিতে শীর্ষস্থানীয় বিজেপি নেতারা খোলাখুলিই স্বীকার করেন। বিজেপির পলিসি রিসার্চ উইংয়ের প্রধান ড. বিনয় সহস্রবুদ্ধে বলেন, বিজেপিকে নিয়ে দক্ষিণ ভারতে নানা রকমের ‘ভুল ধারণা’ আছে।
পাশাপাশি তিনি দাবি করছেন, গত এক দশকে নরেন্দ্র মোদির শাসনে সেই ‘ভুল’গুলো অনেকটাই ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। তবে দক্ষিণে বিজেপির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা পাল্টা যুক্তি দিয়েছেন। তারা বলেছেন, কেন্দ্রে এক দশক ধরে নরেন্দ্র মোদির শাসন দক্ষিণ ভারতীয়দের বিজেপির প্রতি আরও ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। সূত্র: বিবিসি