পয়লা বৈশাখ থেকে অর্থবছর গণনা প্রসঙ্গে । খবরের কাগজ
ঢাকা ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪

পয়লা বৈশাখ থেকে অর্থবছর গণনা প্রসঙ্গে

প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৫০ এএম
পয়লা বৈশাখ থেকে অর্থবছর গণনা প্রসঙ্গে
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ, প্রশাসনিক কর্মযোজনা, উন্নয়ন অভীপ্সা প্রভৃতিতে গুণগত পরিবর্তন সূচনায় অর্থবছরের মেয়াদ মেরূকরণের প্রসঙ্গটি জাতীয় ভাবনার অংশ হওয়ার অবকাশ দেখা দিয়েছে।

পয়লা বৈশাখ থেকে অর্থবর্ষ গণনার প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন মোগল সম্রাট আকবর মূলত রাজস্ব আহরণ তথা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই। ইতিপূর্বেকার চান্দ্র মাসের ভিত্তিতে প্রচলিত হিজরি সন এবং সৌরবর্ষ গণনার পদ্ধতি প্রক্রিয়ার মধ্যে সমন্বয় ও সাযুজ্য সাধনের তাৎপর্য ও যৌক্তিকতাকে বিচার-বিশ্লেষণের ভার তার নবরত্ন সভার সবচেয়ে বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ সদস্য মশহুর ইতিহাসবেত্তা আবুল ফজল (১৫৫১-১৬০২ খ্রিষ্টাব্দ) এবং অর্থ ও রাজস্ববিষয়ক সদস্য রাজা টোডরমলকে তিনি অর্পণ করেছিলেন এ বিবেচনায় যে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডই রাজ্য কিংবা সরকারের অন্যান্য সব কর্মকাণ্ডের ওপরে অধিষ্ঠান, নিয়ন্ত্রক ও প্রভাবক ভূমিকায় থাকে। তাদের নির্দেশনায় ফতেহ উল্লা সিরাজী যে সমন্বিত প্রস্তাব প্রণয়ন করেন, সেই ভিত্তিতে ফসলি সন নামে নতুন বর্ষ গণনার রীতি প্রবর্তিত হয় ৫৯৪ হিজরি সনের জুলিয়ান ক্যালেন্ডার মোতাবেক ১২ এপ্রিল, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মোতাবেক ১৪ এপ্রিল, সোমবার। 

প্রবর্তনের খ্রিষ্টীয় সনটি ১৫৮৪ হলেও ফসলি সনের প্রবর্তক সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের সন ১৫৫৬ থেকে এর ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা প্রদান করা হয়। প্রজাদের উৎপাদিত ফসলের ওপর সেস বা কর রাজস্ব আরোপ, হিসাবায়ন এবং যথামৌসুমে তা সংগ্রহের সুবিধার্থে মূলত ফসলি সনের প্রবর্তন। এই ফসলি সনই পঞ্জিকা তথা অর্থবছর হিসেবে বিবেচিত হতো। ভারতের দিল্লিতে বসে প্রবর্তিত রাজস্ব আয় ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নির্দেশক এই ফসলি সনই পরবর্তীকালে সুবা বাংলায় (বর্তমানে বাংলাদেশ) বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন হিসেবে অব্যাহতভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। 

মোগলদের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে রাজস্ব আহরণের উদ্দেশ্য, অভিপ্রায় ও প্রক্রিয়া ছিল মূলত বেনিয়া বাণিজ্য বোধ-বিশ্বাসের ভিত্তিতে। সে সময় আর্থ-প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে ফসলি সনের ব্যবহারিক গুরুত্ব হ্রাস পায়। তৎকালীন ব্রিটিশ ভাবধারায় অর্থবছর পৃথকভাবে গণনার রেওয়াজ চালু হয়। বাংলার প্রজাদের শস্য উৎপাদনের মৌসুমের সঙ্গে মিলিয়ে রাজস্ব আহরণের দৃষ্টিভঙ্গিতে আসে পরিবর্তন। মুনাফা ও রাজস্বলোভী মুৎসুদ্দি মানসিকতার কাছে বাঙালির আবহমান কালের শাশ্বত সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে অর্থবছর হিসেবে বাংলা সন অনুসরণে চিড় ধরে। গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকাবর্ষের বিপুল ব্যবহার ফসলি সনের কদরকে ফিকে করে দেয় আর পুরো আর্থ-প্রশাসনিক অবস্থা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রা দান করে। কোম্পানি বাংলার মৌসুমি জলবায়ু তো দূরের কথা, ফসল উৎপাদনের সময়সূচিকে রীতিমতো অবজ্ঞাভরে দেখতে শুরু করে।

 ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতের রাজদণ্ড কোম্পানির হাত থেকে খোদ ব্রিটিশ সরকারের হাতে চলে যায়। ওয়েস্ট মিনস্টার পদ্ধতিতে পরিচালিত ভারতে ব্রিটিশ সরকারের প্রথম বাজেট আনুষ্ঠানিকভাবে আইনসভায় পেশ করা হয় ৭ এপ্রিল ১৮৬০। অর্থবছরের ধারণাটা বাংলা সনের অনুগামী রাখার পক্ষপাতী ছিলেন ভারতবর্ষে প্রথম অর্থমন্ত্রী জেমস উইলসন (১৮০৫-১৮৬০)। স্বনামধন্য ‘ইকোনমিস্ট’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা, স্টান্ডার্ড চার্টাড ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বিভাগের সচিব, অর্থসচিব, ব্রিটিশ আইনসভার প্রভাবশালী সদস্য, ফ্রি ট্রেড আন্দোলনের কর্মী, পেপার কারেন্সির প্রবর্তন প্রবক্তা জেমস উইলসন ভারতে ভাইসরয়ের কাউন্সিলে অর্থ সদস্য (মন্ত্রী সমতুল্য) হিসেবে নিযুক্তি পেয়ে কলকাতায় যোগদান করেন ১৮৫৯ সালের ২৯ নভেম্বর। সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতে নতুন ব্রিটিশ সরকারের আর্থিক সংকটের মোকাবিলায় উইলসনকেই উপযুক্ত ভেবেছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী Lord Palmerston। 

ইতিহাস-সচেতন বিচক্ষণ অর্থনীতিবিদ উইলসন ভারতের আর্থ-সংস্কৃতি ঐতিহ্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিয়ে ১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল উপস্থাপিত ভারত সরকারের প্রথম বাজেট বক্তৃতাতেই ভারতে আধুনিক আয়কর প্রবর্তনের প্রস্তাব করেন। প্রাচীন ভারতের মনুসংহিতা থেকে রাজস্ব আদায়ের সূত্র উল্লেখ করলেও তিনি মূলত ব্রিটেনের আয়কর আইনের কাঠামোয় এ দেশে আয়কর আরোপের রূপরেখা দেন। এপ্রিল মাস থেকেই তার বাজেটটির বাস্তবায়ন শুরু হয়ে যায়, প্রচলিত বাংলা সনের সঙ্গে ছিল যার যৌক্তিক সাযুজ্য। পরিতাপের বিষয়, ভারতে ব্রিটিশ সরকারের প্রথম অর্থমন্ত্রী, ভারতে আধুনিক আয়কর প্রবর্তনের মাত্র তিন মাসের মাথায় ডিসেন্ট্রিতে ভুগে মারা যান আগস্ট মাসের ১১ তারিখে, কলকাতাতেই। পরবর্তী চার বছর বাজেট এপ্রিল-মে, এমনকি জুন মাসে উপস্থাপিত হলেও ১৮৬৫ সাল থেকে স্থায়ীভাবে ১ এপ্রিল থেকে অর্থবছর শুরুর বিধানটি কার্যকর হয়।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ভারতীয় প্রজাতন্ত্র ১ এপ্রিল-৩১ মার্চকে অর্থবছর অনুসরণ অব্যাহত রাখে, কিন্তু পাকিস্তান সরকার জুলাই-জুনকে অর্থবছর সাব্যস্ত করে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাধান্য থাকায় পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমানের বাংলাদেশ প্রাদেশিক বা আঞ্চলিকতায় পর্যবসিত হয়। সুতরাং বাংলার কৃষি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মৌসুম অনুগামী বাংলা সন অর্থবছরের সাযুজ্যতায় মর্যাদার প্রশ্নে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানের কৃষি বা উৎপাদন মৌসুম অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সবকিছুই ছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভিন্ন। সে কারণে এপ্রিল মার্চ-এর স্থলে জুলাই-জুনকে অর্থবছর সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সিদ্ধান্তই একচ্ছত্র হয়ে যায়। 

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে অর্থবছরকে বাংলার আবহমান সংস্কৃতির প্রতিফলক বাংলা সনের অনুগামীকরণের বিষয়টি যৌক্তিক বিবেচনায় এসেও যেন আসেনি। দুঃখজনকভাবে পাকিস্তান আমলে প্রবর্তিত জুলাই-জুন এখনো বাংলাদেশের অর্থবছর হয়ে আছে। উপযুক্ত কারণ পরীক্ষা পর্যালোচনা করে এটি পরিবর্তনের আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্যোগ গ্রহণের আবশ্যকতা অনুভূত হয়। 

বাংলাদেশের মৌসুমি আবহাওয়া ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বার্ষিক কর্মযোজনার নিরিখে এটা খুবই স্পষ্ট যে, জুলাই-জুন অর্থবছর হিসেবে যোগ্যতর নয়, হতে পারে না। আমাদের দেশে মূলত মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর অবধি বর্ষাকাল। বিদ্যমান অর্থবছর শুরু হয়েই প্রথম তিন চার মাস বর্ষাজনিত কারণে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড শুরু করা যায় না। আয়কর আইন অনুযায়ী আগের অর্থবছর শেষ হওয়ার তিন মাসের মাথায় ঠিক এ সময়টাতে আয়কর প্রদানের বাধ্যবাধকতা চলে আসে, আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে প্রায়শ বড় বন্যা তথা প্রাকৃতিক দুর্যোগ অর্থনৈতিক জীবনযাত্রায় দুর্গতি বয়ে আনে এবং এ সময়টা ফসল বপনের, ফসল তোলার নয়; ফলে আয়কর হিসাবায়ন, পরিশোধ তথা রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতায় বিব্রত বোধ করে রাজস্ব প্রদানকারীরা, নানান কারণে প্রায় প্রতিবছর আয়কর প্রদানের সময় বাড়ানোর দাবি উঠে আসে। 

অর্থবছরের প্রথম তিন চার মাস একধরনের কর্মহীন অতিবাহিত হওয়ার পর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ হাতে নেওয়া হয়। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে কার্য কিংবা সরবরাহের আদেশ দিতে দিতে এপ্রিল-মে। সরবরাহ সেবা কিংবা ভৌত কর্মকাণ্ড শুরু যখন হয়, তখন বর্ষা শুরু হয়ে যায়। কাজের, সরবরাহের, সম্পাদনের গুণগত মান বজায় রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশের বর্ষাকালে। এ সময় মেরামত সংস্কারকাজে জনভোগান্তি যেমন বাড়ে, কাজের গুণগত মান পরিবীক্ষণেও ঘটে বিপত্তি। অর্থবছরের শেষে বরাদ্দ অনুযায়ী কাজ শেষ করার তাগিদে কিংবা প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখানোর তাগিদে নানান অনিয়ম ও অনৈতিকতার আশ্রয় নেওয়াটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এ সময়টাতে অপব্যয় অপচয়ের অবকাশ হয় অবারিত। শুধু কৌশলগত অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের অর্থবছরের পাঁচ-ছয়টি মাস অর্থনীতির জন্য অনুকূল না হয়ে প্রতিকূল হয়ে ওঠে। 

অথচ অর্থবছরের এই ব্যাপ্তিটা জুলাই-জুনের পরিবর্তে যদি এপ্রিল-মার্চ (বাংলা সনের কাছাকাছি) হয় তাহলে প্রথম মাসেই কাজ শুরু করে পরবর্তী তিন-চার মাস বর্ষাকালে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে অক্টোবর-মার্চে এই ছয় মাস পুরোটাই নিরবচ্ছিন্নভাবে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজে পরিপূর্ণ ব্যবহার সম্ভব হতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এই সময়টিই সব কাজের জন্য অনুকূল, সহনশীল ও উৎপাদনমুখী। ব্যক্তি ও ব্যবসা উভয় শ্রেণির করদাতার জন্যও মে-জুন মাসে করের হিসাবায়ন, কর প্রদান তথা রিটার্ন দাখিলে বিড়ম্বনা স্বাভাবিকভাবে হবে কম। 

আমাদের প্রতিবেশী বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের অর্থবছর মোগল যুগ ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই এপ্রিল-মার্চ হলেও পাকিস্তানি আমলে প্রবর্তিত জুলাই-জুন অর্থবছর বিগত চার দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে বিদ্যমান। প্রধান দেশওয়ারি পর্যালোচনায় দেখা যায়, মার্কিন মুলুকের দেশসমূহে (তবে থাইল্যান্ডসহ) অক্টোবর-সেপ্টেম্বর, কমনওয়েলথভুক্ত দেশসমূহে জুলাই-জুনের (তবে ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, হংকং ব্যতিক্রম) মৌসুমি বলয় ও এশীয় দেশসমূহে (ভারত, জাপান, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, হংকংসহ) এপ্রিল-মার্চের প্রাধান্য। 

সার্কভুক্ত সাতটি দেশের চারটি (বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটান) দেশে জুলাই-জুন, দুটি (শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ) দেশে পঞ্জিকাবর্ষ (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) এবং একমাত্র ভারত এপ্রিল-মার্চকে অর্থবছর হিসেবে ব্যবহার করে। উদীয়মান বিশ্বশক্তি চীন এবং মালয়েশিয়া উভয়ই পঞ্জিকা বর্ষকে অর্থবছর মানে। কোনো কোনো দেশ যেমন- নেপাল (১৬ জুলাই-১৫ জুলাই), ইরান (২১ মার্চ-২০ মার্চ), ইথিওপিয়া (৮ জুলাই-৭ জুলাই) মাসের মধ্যবর্তী তারিখ থেকে অর্থবছর শুরু করে। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। বাংলা সনকে হুবহু সাযুজ্যকরণে বাংলাদেশের অর্থবছর ১৪ এপ্রিল-১৩ এপ্রিল সাব্যস্ত হতে পারে। এর সঙ্গে জানুয়ারি-ডিসেম্বর অর্থাৎ গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকাবর্ষকে বাংলাদেশের অর্থবছর করার প্রস্তাবটি তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে। বাংলাদেশের জলবায়ু, জীবনযাপনের সময়চক্র, আর্থ-প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের আবহমান সংস্কৃতিকে যথাবিচেনায় আনলে অর্থবছর এপ্রিল-মার্চ হওয়াটা অধিকতর যুক্তিযুক্ত প্রতীয়মান হয়। 

লেখক: সাবেক সচিব ও এনবিআরের 
সাবেক চেয়ারম্যান

ভারসাম্য রক্ষায় মূল্যস্ফীতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২৪, ১০:২৯ এএম
ভারসাম্য রক্ষায় মূল্যস্ফীতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে
ড. মোস্তাফিজুর রহমান

বেশ কয়েক বছর ধরেই মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখিতা লক্ষণীয়। এটা যদি নিম্নমুখীও হয় মূল্যস্তর কিন্তু ওপরে উঠে গেছে- এ কথা আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন। নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত সবারই ক্রয়ক্ষমতার একটা অবনমন ঘটছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ পুষ্টি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তাহলে দারিদ্র্যসীমার সঙ্গে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, জীবনযাত্রার মানের একটা বৈপরীত্য রয়ে যাচ্ছে। এখন থেকে ১৫ বছর আগে মূল্যস্তর আরও অনেক কম ছিল, কিন্তু জীবনযাত্রার মান নিম্ন ছিল না। কারণ আয় ছিল ঊর্ধ্বমুখী। অর্থাৎ মূল্যস্তর বা মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আয় বাড়লে ক্রয়ক্ষমতার অবনমন হয় না।

সুতরাং এটা সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত। আমাদের অর্থনীতি যে কিছুটা ঝুঁকির মুখে পড়ে গেছে সেটা স্পষ্ট। আমাদের অর্থনীতির যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং নিম্ন মূল্যস্ফীতির ব্যাপারটা ছিল তা এখন আর আমাদের মধ্যে নেই। মূল্যস্ফীতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, নতুন ভারসাম্য আনতে হবে। এ জন্য প্রবৃদ্ধি কিছুটা নিচের স্তরে হলেও তা আমাদের মেনে নিতে হবে। এখানে সংকোচনমূলক যে মনিটরি পলিসি নেওয়া হয়েছে সেটা আমার কাছে ঠিক মনে হয়েছে। সুদহার বাড়ানো হয়েছে, স্মার্ট রেট চালু করা হয়েছে, রিভার্স রেপো চেঞ্জ করা হয়েছে, পলিসি রেটকে বাড়ানো হয়েছে, যেন বাজারে মানি সাপ্লাই কমানো যায়।

খেয়াল রাখতে হবে যে এখানে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে হবে না, রাজস্বনীতির ব্যাপার আছে। শুল্ক কমানো হলে ভোক্তারা সাশ্রয়ী মূল্যে কিনতে পারে। সেখানে আমি যদি শুল্ক কমাই এবং ভোক্তারা যেন সে সুফলটা পেতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। সাপ্লাই চেইনের যে অ্যাক্টররা (প্রভাবক) আছে তাদের ওপর তদারক করতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের যে বৈদেশিক বিনিময় হার তা যদি স্থিতিশীল করতে পারি, তবে তা আমদানি করা মূল্যস্ফীতির ওপর একটা ইতিবাচক প্রভাব রাখবে। সুতরাং অনেক ফ্যাক্টর আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার উৎকর্ষ,
আমাদের অর্থনীতিতে একটি নতুন ভারসাম্য নিয়ে আসার ওপর নির্ভর করবে যে, আমরা মূল্যস্ফীতি কমাতে পারব কি না।

আমাদের বিনিয়োগ বাড়ানো, কস্ট অব ডুইং বিজনেস কমানো, উদ্যোক্তারা যাতে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে পারে ইত্যাদি বিষয়ের দিকেও নজর দিতে হবে। কারণ মূল্যস্ফীতির কারণে মূল্যস্তর অনেক বেড়ে গেছে। এখন যদি মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমেও স্তরটা ওপরের দিকেই থেকে যাবে। সুতরাং সেখানে আয়বর্ধক বিভিন্ন কর্মসূচি নিতে হবে। গড় আয় যেটা বছরে বাড়ে, মূল্যস্ফীতি তার দ্বিগুণ, যেমন তৈরি পোশাক খাতের একজন কর্মীর কথা যদি চিন্তা করি তাহলে দেখব, তার বেসিক স্যালারি ৫ শতাংশ করে বাড়ছে, কিন্তু তার খাদ্যের মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি।

ফলে আয় কিছুটা বাড়লেও তার ক্রয়ক্ষমতার কিন্তু অবনমন ঘটছে। অর্থাৎ আমাদের এসব ক্ষেত্রে যে আনুষঙ্গিক উদ্যোগগুলো রয়েছে- দক্ষতা বাড়ানো, প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানো ইত্যাদির দিকে নজর দিতে হবে। বৈদেশিক ঋণের পরিষেবা নিয়ে আমাদের গুরুত্বসহকারে চিন্তা করা দরকার। কেননা এটা আরও বাড়বে। বিগত কয়েক বছরে যেসব ঋণ আমরা নিয়েছি সেগুলোর ম্যাচিউরিটি পিরিয়ড চলে এসেছে। গ্রেস পিরিয়ড, যখন আমাদের কোনো ঋণ পরিষেবার দরকার হবে না, সে পিরিয়ড শেষ হয়ে গেছে। এখন আমরা যে ঋণগুলো নিচ্ছি সেগুলোর অনেকগুলোরই গ্রেস পিরিয়ড কম, ম্যাচুরিটি পিরিয়ড কম, সুতরাং দায়ভারটা বেশি। আমরা মিনিস্ট্রি অব ফাইন্যান্সের যেসব প্রাক্কলন পাচ্ছি তাতে দেখা যাচ্ছে, ১০ বছর আগে আমাদের যদি ২ বিলিয়ন ডলারের মতো পরিষেবা হতো (সুদাসলে) বৈদেশিক ঋণের, যা এখন ৪-৫ বিলিয়ন ডলারের দিকে চলে যাচ্ছে।

এমন একটা সময়ে যাচ্ছে যখন আমাদের রিজার্ভ কমের দিকে। যখন রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ছিল তখন ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিষেবা থাকলে এক কথা, কিন্তু এখন রিজার্ভ ২১ বিলিয়ন ডলার এবং ঋণ পরিষেবা করতে হচ্ছে ৪-৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন! নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে কিছুটা রাশ টেনে ধরা। পুরোনো বিনিয়োগ যেগুলো পাইপলাইনে আছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা। এ ছাড়া ঋণ আলোচনাগুলো এমনভাবে করা, যাতে করে আমরা যে শর্তে ঋণ নিচ্ছি তা যেন আমাদের অনুকূলে হয়। ২০১৫ সালে আমাদের যখন মধ্যম আয়ের দেশে গ্র্যাজুয়েশন হলো, তখন কিন্তু কনসেশনাল লোন অনেক কমে গেল। আমাদের নন-কনসেশনাল লোনই এখন বেশি। আমাদের ঋণের দায়ভার আগের তুলনায় আগামীতে বাড়বে।

আমাদের বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। যাতে করে আমাদের পরিষেবায় কোনো সমস্যা না হয়। জিডিপির সঙ্গে তুলনা করলে বৈদেশিক ঋণ অত বেশি নয়, তুলনামূলকভাবে অনেক কম (আমাদের জিডিপির ১৮ বা ১৯ শতাংশ)। তবে খেয়াল রাখতে হবে আমাদের রেভিনিউ (রাজস্ব) কত হলো। কারণ এই রেভিনিউ দিয়েই ঋণ পরিষেবা করতে হবে। অথচ আমাদের রেভিনিউ-জিডিপি হার এখন ৯ শতাংশেরও কম! এর একটা বড় অংশ তো ঋণ পরিষেবাতেই তাহলে চলে যাবে। তখন যেন ঋণ এনে ঋণ পরিশোধ করা না লাগে- এমন অবস্থা এড়াতে আমাদের রেভিনিউ বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে।

আমাদের বিনিময় হারকে স্থিতিশীল করতে হবে। যেহেতু অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, যার রিটার্ন আসবে টাকায় কিন্তু ফেরত দিতে হবে ডলারে। একসময় আমরা ৮৬ টাকায় ১ ডলার হিসাব করলেও এখন ১১০ টাকায় ১ ডলার হিসাব করা হচ্ছে। অর্থাৎ সেখানে একটা দায়ভার তুলনামূলকভাবে বেড়েই চলেছে। অর্থাৎ প্রকল্পগুলো যেন সাশ্রয়ীভাবে, সময়মতো ও সুশাসনের সঙ্গে বাস্তবায়ন হয়- এর প্রয়োজনীয়তা এখন তুলনামূলকভাবে অন্য অনেক কিছুর চেয়ে বেশি। এখন এটি যদি বাস্তবায়ন করতে পারি তবে আমরা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব। তবে যদি তা করতে ব্যর্থ হই তাহলে আমাদের চাপ ক্রমান্বয়ে বাড়বে। কেননা আমাদের রিজার্ভ অনেকটাই কমে এসেছে।

আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার হতে পারে রাজস্ব, জিডিপি রেশিও; যা আমরা বাড়াতে পারি। এটা করা যাবে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর মাধ্যমে। বাংলাদেশে আমরা কিন্তু দেখছি যে, আয়বৈষম্য বা সম্পদবৈষম্য বাড়ছে, যেটা ইতিবাচক নয়। বাংলাদেশে আমরা একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ চাই, কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়! বিবিএসের হিসাব বলছে, আয় কেন্দ্রীভূতকরণের যে সুযোগ তা ১৯৯০ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে এবং তা শহরে ও গ্রামে বেড়ে চলেছে (৫ শতাংশ বেড়েছে)। এটা আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। আমরা কিন্তু ইন্টারজেনারেশনাল গ্যাপ বা আন্ত-প্রজন্মের মধ্যকার পার্থক্য কমিয়ে আনতে পেরেছিলাম।

আমাদের পাঁচ দশক ধরে আর্থসামাজিক সূচকে যে উন্নয়ন হয়েছে (গত দুই দশকে আরও দ্রুত হারে হয়েছে), এ ইতিবাচক প্রবণতাও কিন্তু একটা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এ ক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই চেষ্টা করব কীভাবে রাজস্ব, জিডিপি প্রত্যক্ষ কর আহরণের মাধ্যমে বাড়াতে পারি। অনেকেই দুর্নীতি করে, ঋণখেলাপি করে দেশের টাকা বাইরে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে। আগে এই পাচারকৃত টাকা দেশে বিনিয়োগ করা হলেও এখন তা দেশের মধ্যে থাকছে না। এ টাকা তারা বাইরের দেশে বিনিয়োগ করছে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক সিস্টেমের মধ্যেই টাকাটা আর আসছে না। এ নেতিবাচক প্রবণতাগুলো আমাদের প্রশাসনকে শক্তিশালী করে মোকাবিলা করতে হবে।

এখন বাংলাদেশের অর্থনীতি ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের, পারচেজিং পাওয়ার হিসাব করলে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের একটা অর্থনীতি। এগুলো ম্যানেজ করা অত্যন্ত কঠিন একটা কাজ। এ ক্ষেত্রে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সুশাসন, জবাবদিহি, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, সরকারি পরিষেবা যেসব প্রতিষ্ঠান করে তাদের জবাবদিহি ও সক্ষমতা বাড়িয়ে আমাদের বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে।

লেখক: সম্মানীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) 

সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ড: দায়ী মিথেন গ্যাস নাকি নাশকতা

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২৪, ১০:২৫ এএম
সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ড: দায়ী মিথেন গ্যাস নাকি নাশকতা
আলম শাইন

সুন্দরবন বিশ্বের অন্যতম দুর্গম অরণ্যের মধ্যে একটি। শ্বাপদসংকুল এই অরণ্য দুই বাংলার অহংকারও। সুন্দরবনের বিস্তৃতি মোট ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার নিয়ে। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত অংশের আয়তন ৩ হাজার ৯৮৩ বর্গকিলোমিটার। বিশাল আয়তনের এই বন ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘের বিবেচনায় বিশ্বের অন্যতম ‘ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ’ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। এই দুর্গম অরণ্যটি যুগ যুগ ধরে মানুষের কাছে এক রোমাঞ্চকর জঙ্গল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আর রোমাঞ্চকর বলেই হয়তো এ জঙ্গলের গুরুত্ব অপরিসীম পর্যটকদের কাছে।

প্রকৃতির এ লীলাভূমি দর্শনের উদ্দেশ্যে প্রতিবছর হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক ছুটে আসেন সুন্দরবন এলাকায়। তার মধ্যে ৮৭.৬ শতাংশ দেশি, বাকি ১২.৪ শতাংশ বিদেশি পর্যটকের আগমন ঘটে। ফলে পর্যটন খাতেও আমরা বছরে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে প্রায় ৪১৪ কোটি টাকা অর্জনের সুযোগ পেয়ে থাকি। শুধু পর্যটন খাতেই নয়, মৎস্য, মধু, গোলপাতা ও জ্বালানি কাঠ থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় বহুবিধ জিনিসের মাধ্যমে সরকার প্রচুর রাজস্ব আয় করে সুন্দরবন থেকে। সে প্রাপ্তিও বিরাট অঙ্কের। সর্বশেষ ২০১৭ সালের (শেষ জরিপ) সমীক্ষা মোতাবেক সুন্দরবনের বার্ষিক আয় প্রায় ৫ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে বন বিভাগের এক গবেষণায় জানা যায়, সুন্দরবন বছরে প্রায় ১৬ কোটি মেট্রিক টন কার্বন ধরে রাখতে সক্ষম; যার আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য প্রায় ৫-৬ বিলিয়ন ডলার।

এ ছাড়া সুন্দরবনের পেশাজীবীদের মধ্যে ৩১ শতাংশ জ্বালানি কাঠ, ৬.৩ শতাংশ মধু ও মোম, ৯.৪ শতাংশ গোলপাতা, ৫৪.৮ শতাংশ মাছ, ১৮ শতাংশ চিড়িং, ২৯ শতাংশ কাঁকড়ার মাধ্যমে বছরে ১ হাজার ১৬১ কোটি টাকা সরকারের রাজস্ব আদায় হয়। এতে করে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। অপরদিকে দেশি-বিদেশি পর্যটন খাত থেকেও বিপুল অঙ্কের রাজস্ব সরকারের ভাণ্ডারে জমা হচ্ছে বছর বছর।

সুন্দরবন থেকে আহরিত রাজস্বের পরিমাণ এবং জীববৈচিত্র্যের বিষয়টি বিবেচনা করে সরকার ২০১৬ সালের দিকে উদ্যোগ নিয়েছে এই বনকে আগামী ১০ বছরের জন্য সংরক্ষণ করার। যদিও এ উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল ঘূর্ণিঝড় সিডর বয়ে যাওয়ার পরপরই। তাতে হয়তো জীববৈচিত্র্য বিপর্যয়ের হাত থেকে তুলনামূলক বেশি রক্ষা পেত। তারপরও সরকারের এ উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা না করে পারা যায় না।

সত্যি কথা হচ্ছে, সরকার সচেষ্ট হলেও সুন্দরবনের ওপর বিষফোঁড়ার আবির্ভাব থেমে থাকেনি। বরং একের পর এক বিভিন্নভাবে সুন্দরবন আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীগুলো বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে খুব বেশি। বারবার জাহাজডুবির কারণে নদ-নদীর জল যেমন দূষিত হচ্ছে, অপরদিকে ধ্বংস হচ্ছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে অগ্নিকাণ্ডের মতো জঘন্য ঘটনাও। যে ঘটনাটা দুই দশকের মধ্যে ২৫ বার ঘটেছে।

ধারণা করা হচ্ছে, এতে প্রায় দেড় শ একর বনভূমি পুড়ে ছারখার হয়েছে এ পর্যন্ত। সর্বশেষ ২০২৪ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া টহল ফাঁড়ি-সংলগ্ন লতিফের ছিলা এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। একই ঘটনা ২০২১ সালের মে মাসেও ঘটেছিল সুন্দরবনে। তা-ও পরপর দুবার তখন অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি টহল ফাঁড়ির বনে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই ওখানে প্রায় ২ একর বনের লতাগুল্ম, গাছগাছালি পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল। আরও পরিতাপের বিষয়, প্রথম দফার আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পরের দিনই পুনরায় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল দাসের ভারানিতে।

চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়ার অগ্নিকাণ্ড ৩০ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে এলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিরূপণ করা যায়নি। বারবার অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকা খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক বলেন, ‘সুন্দরবন লোকালয়সংলগ্ন নদী এবং খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় নিয়মিত জোয়ারের পানিতে বনভূমি প্লাবিত না হওয়ায় এর আগেও বিভিন্ন সময় এই এলাকায় আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এখানে মাটির ওপর কয়েক ইঞ্চি পুরু জৈব পদার্থ (লতাপাতা ও ডাল-পালা) মজুত হয়ে আছে। কাজেই এই তীব্র গরমে সেখানে নিচের দিকে মিথেন গ্যাস মজুত হয়ে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।’

অপরদিকে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সুন্দরবনে আগুন লাগানোর ঘটনার প্রথম দায়ী ব্যক্তিরা হচ্ছে মৌয়াল। তারা মধু আহরণ করতে গিয়ে মৌচাকে আগুন বা ধোঁয়া লাগিয়ে এ সর্বনাশটি করে থাকে। চোরা শিকারি, মৎস্যজীবীরা রান্নাবান্না এবং ধূমপান করেও আগুনের সূত্রপাত ঘটিয়ে থাকে। এ ছাড়া দখলদারত্বের বিষয়টিও এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। তাই এবারের বিষয়টিও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড হিসেবে ধরে নিয়েছেন পরিবেশবিদরা। এর কারণ হচ্ছে অতীতের সব অগ্নিকাণ্ডের নাশকতার প্রমাণ মিলেছে।

এবারের অগ্নিকাণ্ড তারই ধারাবাহিকতা কি না, সেটি খতিয়ে দেখতে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো জোর দাবি জানাচ্ছে। কারণ যেকোনো ধরনের অগ্নিকাণ্ডই বন-জঙ্গলের বিপর্যয় ডেকে আনে। সুন্দরবনের ক্ষেত্রে বিষয়টা আরও মর্মাহত। কারণ এখানে রয়েছে জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক সমাহার। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য দুর্লভও। এখানে প্রায় ৪২৫ প্রজাতির প্রাণী, ৩০০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। প্রাণীদের মধ্যে ৩০০ প্রজাতির পাখি, ৩২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটলে উদ্ভিদের সঙ্গে পোকামাকড়ও ছারখার হয়ে যায়; ফলে জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকিতে পড়ে।

সুন্দরবন ছাড়াও বনবনানী কিংবা পাহাড়-পর্বতের জঙ্গল পরিষ্কারের উদ্দেশ্যে আগুন লাগানো হচ্ছে। সাধারণত তিনটি কারণে এসব করা হচ্ছে। প্রথমত, নাশকতা। দ্বিতীয়, আর্থিক সাশ্রয় ও সময়ের তাগিদ। তৃতীয়, দুর্গম-দুর্ভেদ্যতার কারণ। বিশেষ করে বাংলাদেশের জুমচাষিরা এ কাজ বেশি বেশি করছে। মাঝেমধ্যে দুর্বৃত্তরাও ঝোপ-জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।

মূলত যারা এ ধরনের কাজ করছে, তারা জঙ্গলে আগুন লাগানোর ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে মোটেও জ্ঞান রাখেনি বলে আমাদের ধারণা। তারা জানে না, এতে করে পরিবেশের কতটা সর্বনাশ হচ্ছে। জানে না চরমভাবে হুমকির মুখে পড়ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য। বন্য প্রাণীরা আবাসস্থল হারাচ্ছে আর বিভিন্ন প্রজাতির সরীসৃপ ও পোকামাকড় পুড়ে ছারখার হচ্ছে। এত সব জানলে বোধকরি তারা সজ্ঞানে আগুন লাগিয়ে এমন ধ্বংসাত্মক কাজ করার সাহস পেত না।

আবার অনেকে নিজের জঙ্গলে নিজেও আগুন লাগিয়ে থাকে। তাদের ধারণা, তাতে অন্যের ক্ষতির কারণ কোথায়। আসলে যে ওই ব্যক্তি নিজেই নিজের সর্বনাশ ডেকে আনছেন জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে, তা তিনি অবগত নন বিধায় এসব ভাবছেন। বিষয়টি অনেকেই জানে না। তাই আমাদের উচিত এ ব্যাপারে সবাইকে বিশদভাবে জানানো। জানানো উচিত এটি একটি অন্যায় কাজও। বিষয়টি লোকের দ্বারে দ্বারে গিয়ে জানানো সম্ভব নয় বিধায় প্রয়োজন ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা।

বিশেষ করে বাংলাদেশের জুমচাষিদের আগুন লাগানোর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে স্পষ্ট করে জানাতে হবে এবং সুন্দরবনের আশপাশের এলাকায় ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে জানাতে হবে যে, বনে আগুন লাগানো থেকে বিরত থাকতে। তাতে যেমন সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে, তেমনি রক্ষা পাবে জীববৈচিত্র্য। তাই আমাদের পরামর্শ প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি নাশকতাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তবেই রক্ষা হবে বনবনানী তথা আমাদের প্রিয় সুন্দরবনও।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট
[email protected] 

বাঙালির আত্মপরিচয়ের উৎস যিনি

প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৪, ০১:৪৫ পিএম
বাঙালির আত্মপরিচয়ের উৎস যিনি
ড. পবিত্র সরকার

বাঙালির ধর্মমুক্ত উৎসবের একটি হলো নববর্ষ। কিংবা বলতে পারি এই উৎসব ক্রমশ ধর্মের খোলস ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসছে। এই লেখক ব্যক্তিগতভাবে ‘মানুষের ধর্ম’ ছাড়া আর কোনো ধর্মের রাস্তায় হাঁটেন না। তবু ধর্ম যতক্ষণ না নিজের বা অন্য ধর্মের মানুষকে আঘাত করছে বা মানুষের ক্ষতি করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ধর্মের সঙ্গে এই লেখকের কোনো বিরোধ নেই।

ধর্ম মানুষের জন্য অজস্র উৎসব সৃষ্টি করেছে, তাতে আড়ম্বর ও জাঁকজমকের অভাবও নেই। এই উৎসবগুলো আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। মানুষ এখনো এই উৎসবগুলোতে আনন্দের সঙ্গে যোগ দেয় এবং কিছুটা বেহিসেবি অপচয়ের দ্বারা নিজের উল্লাসকে চিহ্নিত করে। তাতে কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু প্রায়ই লক্ষ করা যায় যে, এই প্রাচীন উৎসবগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে বিশেষ একটি শ্রেণি, যাদের সংস্কৃতে ‘পুরোহিত’ বলা হয়। তারা না হলে এসব উৎসব অচল, তাদের হাতে কিছু না পৌঁছে দিলে সে উৎসব সিদ্ধ হয় না। অর্থাৎ এ উৎসবগুলো আরোপিত, জনসাধারণের নিজের ভেতরকার চাহিদা থেকে উদ্ভূত নয়। তবু মানুষ যদি এ থেকে আনন্দ সঞ্চয় করে, সবার সঙ্গে সেই আনন্দ ভাগ করে নিতে চায়, তাতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।

কিন্তু ধর্মের বাইরেও উৎসবের একটি চাহিদা আছে। গ্রাম-গ্রামান্তরে নৌকাবাইচ, গরু-মহিষের দৌড়, মেলা, ফুটবল খেলার ফাইনাল ইত্যাদি প্রায় উৎসবের চেহারা নেয়। তবে তা নেহাতই স্থানীয় উৎসব, দেশের সব জনগোষ্ঠীকে তা উত্তেজিত বা উদ্বেলিত করে না, নববর্ষ যেমন করে। এই উৎসব বিশেষত বাংলাদেশের এক সাংস্কৃতিক সৃষ্টি, যা পশ্চিমবঙ্গে, বিচ্ছিন্ন চেষ্টা সত্ত্বেও এখনো তেমন ব্যাপ্তি বা উজ্জ্বলতা পায়নি।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে আর একটি দিন এই এক ‘জাতীয়’ সাংস্কৃতিক উৎসবের আকৃতি ধারণ করতে চলেছে। সেটি পঁচিশে বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। কয়েক বছর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকার সুবাদে এই লেখক সেই উৎসবের অন্দরমহলের সঙ্গে কিছুটা যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন, তারই স্মৃতি থেকে কিছু সংগ্রহ পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি।

আগে কলকাতায় এই উৎসবের প্রধান কেন্দ্র ছিল জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথের বাড়ি। আমি যৌবনে ভোরবেলায় উঠে সেখানে গেছি, সেখানে বিশ্বভারতী ও রবীন্দ্রভারতী আগে একসঙ্গে এই জন্মদিনের অনুষ্ঠান করত। এখানে বলা দরকার যে, আগে শান্তিনিকেতনে পঁচিশে বৈশাখ গ্রীষ্মের ছুটির মধ্যে পড়ত বলে সেখানে ১ বৈশাখই রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন করা হতো। পরবর্তীকালে এই ব্যবস্থা পরিত্যক্ত হয়েছে। এখন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ কলকাতাতেও একটি অনুষ্ঠান করে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে, রবীন্দ্রভারতীর সঙ্গে একযোগে নয়, পৃথকভাবে।

অনেক দিন পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের বাড়ির অনুষ্ঠান ছিল কলকাতায় প্রধান অনুষ্ঠান। পরে মধ্য কলকাতায় রবীন্দ্রসদনে একটি অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়েছে। এই দুটি ছিল ভোরবেলার প্রধান অনুষ্ঠান, কিন্তু পরে সম্ভবত বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে রবীন্দ্রসদনে বেলা ২টা থেকে অনুষ্ঠান আরম্ভ হতে শুরু করেছে।

কালক্রমে এ ধরনের রবীন্দ্র-জন্মদিন অনুষ্ঠান কলকাতার আরও নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। দক্ষিণ কলকাতার নজরুল মঞ্চে একটি বড় অনুষ্ঠান হয়, একটি অনুষ্ঠান হয় সল্টলেকে মেলা প্রাঙ্গণে। শিল্পীদের নানা প্রান্তে দৌড়ে গলদ্‌ঘর্ম হতে হয় বলে কখনো এক দিন আগ-পিছ করে এই অনুষ্ঠানগুলো সাজানো হয়। কলকাতার সব অঞ্চলেই ছোট-বড় নানা উৎসব চলে। ওই দিন এবং তার পরে প্রায় ১৫ দিন ধরে। ‘কবি-পক্ষ’ কথাটা কে চালু করেছিলেন জানি না, বোধহয় প্রয়াত প্রেমেন্দ্র মিত্র। পুরো এক পক্ষ বা তার বেশি সময় ধরে এই উদ্‌যাপন চলে। স্কুল-কলেজ, ক্লাব, অফিসে, ক্যাসেট কোম্পানি, রেডিও, টেলিভিশন- কেউ রবীন্দ্রনাথকে ভুলে থাকবেন তার উপায় নেই। পুরো পশ্চিম বাংলায় এই সময়টা রবীন্দ্রজয়ন্তীর উচ্ছল বন্যার ঢেউ উঠতে থাকে।

তার বৈচিত্র্যই-বা কত! ট্রেনের কামরায় নিত্যযাত্রীরা আয়োজন করেন রবীন্দ্র-জন্মোৎসবের, গঙ্গাবক্ষে নৌকার ওপর হয় রবীন্দ্র-জন্মদিন, ছেলেমেয়েদের রবীন্দ্রনাথের নাটকের চরিত্র সাজিয়ে, এমনকি কাউকে রবীন্দ্রনাথ সাজিয়ে, কেউ নিয়ে আসেন জোড়াসাঁকো বা রবীন্দ্রসদনে, ট্রাকের ওপরে গানের দল রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে অঞ্চল পরিক্রমা করে, বাসের মধ্যে চলে রবীন্দ্রজয়ন্তী- সে এক কাণ্ডই বটে! আমার সময়ে ছাত্র পঙ্কজ সাহার উদ্যোগে রবীন্দ্রভারতী থেকে অনুষ্ঠানের টেলিভিশন প্রচার শুরু হয়। এখন তা কলকাতার সব প্রধান অনুষ্ঠানকে ধরার চেষ্টা করে এবং যারা ঘরের বাইরে বেরোতে পারেন না, তাদের কাছে এই সম্প্রচার এক আশীর্বাদের মতো হয়ে উঠেছে।

এই দিন এখানকার বাঙালি যেন ওই মানুষটির কাছে নিজেদের সমর্পণ করে। কত কত দূর থেকে যে বাঙালি ওদিন জোড়াসাঁকোয় এসে পৌঁছায়, তার হিসাব নেই। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত আমার কাছে চিঠি লিখতেন পুরুলিয়ার আদ্রা শহরের এক ইঞ্জিনিয়ার বুধন ভট্টাচার্য, তিনি চব্বিশে বৈশাখ রাত ১০টা না ১২টার পুরুলিয়া এক্সপ্রেস ধরে ভোরবেলায় হাওড়া এসে পৌঁছাতেন। প্রথমেই জোড়াসাঁকো। সেখানে শেষ পর্যন্ত কাটিয়ে কোথাও কিছু একটা মুখে দিয়ে অন্য কোনো রবীন্দ্র-অনুষ্ঠানে। তার পর রাতের ট্রেন ধরে আবার আদ্রায় ফেরা, পরদিন ভোরবেলায়। জীবনের বেশ কয়েকটা বছর পঁচিশে বৈশাখ ওই ছিল তার রুটিন। জানি না বয়সের কারণে এখন তা বজায় রাখতে পেরেছেন কি না। বুধন ভট্টাচার্য একা নন। দুই বাংলায় নিশ্চয়ই এ রকম রবীন্দ্র-উন্মাদ একাধিক মানুষ আছেন, যারা রবীন্দ্রনাথ থেকে বাঁচার রসদ জোগাড় করেন, রবীন্দ্রনাথ, তার ভাষাতেই বলি, তাদের দিনরাত্রির দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।

আমরা রবীন্দ্রনাথের কাছে কী এত পাই যে তাকে শুধু ওই দিনটি নয়, আমাদের অনেক মুহূর্ত উৎসর্গ করি, উৎসর্গ করে কৃতার্থ বোধ করি। তার উত্তর বহু দেশে বহু মানুষ দিয়েছেন, সাধারণ অখ্যাত মানুষ থেকে মহামনীষী পর্যন্ত, ফলে তা নিয়ে আর বেশি বাগ্‌বিস্তারের দরকার নেই। পিতৃহীন একটি ছেলের কথা জানি, যে তার পরীক্ষার আগে রবীন্দ্রনাথের ছবিতে নমস্কার করে বেরোত। বলত, তার ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই, কিন্তু ঈশ্বরের বিকল্প যদি কিছু থাকে তবে তার কাছে তিনি রবীন্দ্রনাথ- তাই জীবনের সংকটে, সন্ধিতে তাকে প্রণাম করতে তার ইচ্ছে হয়।

যাকে নিয়ে এত সব কাণ্ড, তিনি নিজে কিন্তু ঈশ্বর হওয়ার কথা ভাবেননি কখনো। এমনকি ‘গুরুদেব’-এর ভূমিকাও তার অস্বস্তি বাড়িয়েছে, বলতে চেয়েছেন- তিনি শুধুই কবি, আর কিছু নন। কিন্তু কবিরা তো যেকোনো পথচলতি মানুষ নন, তার ওপর রবীন্দ্রনাথের মতো কবি। তিনি আমাদের জীবনের সবকিছুর মধ্য থেকে, বিশ্বচরাচর থেকে, ছয় ঋতুর আবর্তন থেকে, এই মানবজীবনের এমন সুন্দর, এমন মহৎ, এমন অভাবনীয় অর্থ আমাদের জন্য তুলে এনেছেন যে আমরা অনেকে তাকেও একই সঙ্গে বন্ধু আর নাথ ভাবতে শুরু করেছি।

কখনো তারও অবশ্য একজন ঈশ্বরের প্রয়োজন হয়েছে। কিন্তু তিনি কোনো প্রচলিত ধর্মের ঈশ্বর নন, এমনকি তার কৌলিক ব্রাহ্মধর্মের ঈশ্বরও নন। তিনি এক ব্যক্তিগত নির্মাণ, তার নিজস্ব ঈশ্বর। তিনি তার বন্ধু, তার নাথ। কোনো কাতর মুহূর্তে তিনি বলতে চেয়েছেন, ‘তুমি এবার আমায় লহো হে নাথ, লহো।’ এই উপলব্ধি বহন করেছেন কখনো যে তিনি তার প্রভু, প্রিয়, পরম ধন; তিনি তার চিরপথের সঙ্গী, তিনি তার চিরজীবন। কিন্তু আবার লক্ষ করি, জীবনসায়াহ্নে গিয়ে সদ্য-আবির্ভূত সত্তাকে তিনি বুঝতে পারেননি, ‘কে তুমি’ প্রশ্নের উত্তর তিনি পাননি, প্রথম দিনের বা দিবসের শেষ সূর্যের মতো। তাই হয়তো পৃথিবীর মানুষের কাছে তার শেষ আবেদন, শেষ আর্তি উচ্চারণের সময়, ‘সভ্যতার সংকট’-এ, তিনি কোনো ঈশ্বরের ওপর নির্ভর করেননি, বলেছেন, ‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ।’ তিনি কি আর সবকিছুর ওপর বিশ্বাস হারিয়েছিলেন? কে জানে! কিন্তু আমাদের বিশ্বাসের সব দিগন্ত তিনি অধিকার করে আছেন। তার সঙ্গে আমাদের এক জটিল সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তাকে আমরা কখনো সমালোচনা করি, কিন্তু তার হাত ছাড়তে চাই না।

তাই তার জন্মদিন এক অর্থে আমাদের নিজেদেরই জন্মদিন। তিনি বাঙালির আত্মপরিচয়ের মহৎ অংশ, কখনো তার সংগত বা অসংগত অহংকারের উৎস। তার জন্মদিনে বাঙালি, যে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় জন্ম নেওয়ার অভাবনীয় সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছে, নিজেকে আরও বেশি করে পাওয়ার সাধনা করে। তাই তাকে নিয়েই হয়তো গড়ে উঠেছে বাঙালির আর এক ধর্মমুক্ত উৎসব।

লেখক: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

জবাবদিহিমূলক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো নির্মাণ করতে হবে

প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৪, ১০:৪৮ এএম
জবাবদিহিমূলক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো নির্মাণ করতে হবে
ড. বদিউল আলম মজুমদার

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জনগণের ভোটাধিকার। কিন্তু সেই অধিকার আজ সর্বজনীন নেই। আমাদের নিম্নমুখী দায়বদ্ধতা যতটুকু ছিল, তাও লোপ পেয়েছে। সমান্তরাল দায়বদ্ধতা সৃষ্টির জন্য জাতীয় সংসদ কাজ করে। কিন্তু বর্তমান জাতীয় সংসদ একমুখী- একটি দলের। ফলে গণতন্ত্রের সব বৈশিষ্ট্য লোপ পেয়েছে। এর ফলে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন চলছে। এমন অবস্থা অব্যাহত থাকলে তা আরও ভয়াবহ আকার নিতে পারে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমাদের উচিত এই ব্যবস্থাকে রোধ করে একটি জবাবদিহিমূলক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো নির্মাণে সবার সক্রিয় ভূমিকা রাখা। দেশে গণতন্ত্র, সুশাসন, জবাবদিহিমূলক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্য সুজন কাজ করছে। আমরা মানুষের পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে।

কোনো দলের পক্ষে নই, আমরা নিরপেক্ষ। কিন্তু আমরা সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের যা করণীয় রয়েছে, এখনো তা করতে পারিনি। এই স্বাধীনতার জন্য রক্ত, জীবন, মা-বোনেরা সম্ভ্রম দিয়েছেন। স্বাধীনতা পেয়েছি বলেই আমরা স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার পেয়েছি। দেশ অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরও দেশমাতার বদনখানি এখনো মলিন। কারণ, এখনো স্বাধীনতার অনেক স্বপ্ন পূরণ হয়নি। মানুষ ভোট দিতে চায়। কিন্তু ভোট দিতে গিয়ে বিকল্প থাকতে হবে। নিজেদের মধ্যে ভোট হলে তো সেই বিকল্প থাকে না। তাই মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় না। পছন্দমতো প্রার্থী বাছাই করতে নির্বাচন সবার জন্য অংশগ্রহণমূলক হওয়া প্রয়োজন। তারা বলেন, দেশকে এগিয়ে নিতে হলে শুধু ক্ষমতা পরিবর্তন হলেই চলবে না। গণতন্ত্র, জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, ভোটাধিকারসহ সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে। আর এতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনের সচেতন ব্যক্তিরা।

একটি কার্যকর ও শক্তিশালী নাগরিক সমাজ গঠনের পথের প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করা দরকার। যাতে রাষ্ট্রবহির্ভূত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি সব সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি করার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে কার্যকর ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করতে পারে। অযাচিত নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটানোর মাধ্যমে নাগরিক সমাজের কাজের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা। মানবাধিকার সংরক্ষণ ও নাগরিকের মৌলিক অধিকার বলবৎ করার লক্ষ্যে নিবর্তনমূলক আইনগুলোর সংস্কার ও বাতিল করা এবং নিবর্তনমূলক নতুন আইন প্রণয়ন থেকে বিরত থাকা। গুম, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অবসানের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংস্কৃতির অবসান করা। রাষ্ট্রে ক্রমবর্ধমান আয় ও সুযোগের বৈষম্য নিরসনে একটি নতুন সামাজিক চুক্তি প্রণয়ন করা, যাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত হয়, তারা মানসম্মত সেবা সুলভ মূল্যে ও দায়বদ্ধতার ভিত্তিতে পান এবং সত্যিকারভাবেই রাষ্ট্রের মালিকে পরিণত হন।

প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর প্রতি সব বৈষম্যের অবসান করা। জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে মুক্তির লক্ষ্যে একটি যুগোপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর পুনর্মূল্যায়ন করে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্রকল্পগুলো বাতিল করা। ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ বা জনসংখ্যাজনিত বিশেষ সুবিধা অর্জনের লক্ষ্যে তরুণদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তা নিশ্চিত ও সুযোগ সৃষ্টি এবং তাদের নেতৃত্ব বিকাশের লক্ষ্যে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা। গ্রামীণ শিক্ষার মানোন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। নারী ও কন্যাশিশুদের প্রতি সব নির্যাতনের অবসান ঘটিয়ে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সব ক্ষেত্রে নারীদের জন্য সমসুযোগের ব্যবস্থা করা।

বাংলাদেশকে উন্নত দেশ করতে হলে চারটি প্রাতিষ্ঠানিক স্তম্ভের ওপর নির্ভর করতে হবে। এগুলো হচ্ছে সুশাসন, গণতন্ত্রায়ন, বিকেন্দ্রীকরণ এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি। বস্তুত, সুশাসন ও গণতন্ত্র নিশ্চিত না হলে কোনো উন্নয়নের সুফলই জনগণের কাছে পৌঁছায় না। বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্যও প্রাতিষ্ঠানিক এই স্তম্ভগুলোর বিকাশ জরুরি। বিনিয়োগকারীরা এ অঞ্চলে ব্যবসা প্রসারিত করতে চাইলেও বিনিয়োগের আগে তারা দেশে শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল পরিবেশ আছে কি না, তা যাচাই করেন। পাশাপাশি শ্রমের মানোন্নয়ন, পরিবেশ, গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা, সহনশীলতা, সুশাসন ও মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো নিয়েও বিনিয়োগকারীরা চিন্তিত থাকেন। তাই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে সামনের দিনগুলোতে নীতিনির্ধারকদের এই প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে। যেখানে গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা, বহুত্ববাদ, সহনশীলতা, সুশাসন ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল পরিবেশ বজায় থাকবে এবং এর সঙ্গে সামাজিক ও পরিবেশগতভাবে সহনশীল পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে।

আমাদের বর্তমান সংকটের সঙ্গে দুটি রাজনৈতিক বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি হলো কার্যকর গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি তথা ‘ডেমোক্রেটিক ডেফিসিট’। অপরটি সুশাসনের অভাব বা ‘গভর্ন্যান্স ফেইলিওর’। এ দুইয়ের মধ্যে গভীর যোগসূত্র আছে। বস্তুত এগুলো একই সূত্রে গাঁথা এবং একে অন্যের পরিপূরকও বটে। প্রথমত, গণতন্ত্রের প্রধানতম অনুষঙ্গ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলেও একতরফা ও ব্যর্থ জাতীয় নির্বাচনের কারণে সরকারকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করার অন্যতম প্রধান একটি মাধ্যম ভেঙে পড়েছে। যার কারণে আন্তর্জাতিক থিংকট্যাংকগুলো বাংলাদেশকে এখন আর গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বিবেচনা করছে না।

আজকের এ অবস্থার জন্য দ্বিতীয় যে বিষয়টি প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে, তা হলো গভর্ন্যান্স ফেইলিওর বা সুশাসনের অভাব। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানবাধিকার ও আইনের শাসনের অভাব থেকে শুরু করে ন্যায়পরায়ণতার অনুপস্থিতি, স্বচ্ছ-জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ ও জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের অভাব। সরকারের আশীর্বাদপুষ্টরা যে যেখানে পারছেন, গোষ্ঠীতন্ত্র কায়েম করে দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতায় লুটপাটের আয়োজন এবং বিদেশে অর্থ ও সম্পদ পাচারের ঘটনার স্বরূপ উন্মোচিত হলেও তারা বহাল তবিয়তেই রয়েছেন।

লেখক: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) 

রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিক: মানবতা থেকে বিশ্বমানবতায়

প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৪, ১০:৪৪ এএম
রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিক: মানবতা থেকে বিশ্বমানবতায়
শেলী সেনগুপ্তা

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন মিলনের গান গেয়েছেন। এ মিলন ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির, সীমার সঙ্গে অসীমের। তিনি সব সময়ই মানবতা থেকে বিশ্বমানবতায় উত্তরণের প্রচেষ্টায় রত ছিলেন। তাই তিনি যখনই সময় পেয়েছেন বিশ্বপরিক্রমা করেছেন। মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রেম, ছড়িয়ে দিয়েছেন শান্তি ও মিলনের বারতা। মানবপ্রেমকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বমানবের কাছে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু বাঙালির কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের এবং মানবতাবাদী অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি। তার চিন্তাচেতনা, অন্তর্নিহিত ভাব ও দর্শন আমাদের জাতীয় ও ব্যক্তিজীবনে প্রতিনিয়ত প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারলে সামগ্রিক উন্নয়ন ও কল্যাণ সাধিত হবে। এই সময়ের সংঘাতময় বিশ্বে রবীন্দ্রভাবনা ও চেতনা একান্ত প্রয়োজন। তাহলে বিশ্বে বয়ে যাবে শান্তির ঝরনাধারা।
আমরা জানি, অসাম্প্রদায়িক রবীন্দ্রমানসের একটি বিশাল অংশের প্রত্যাশা ছিল বিশ্বে সব মানুষের পরিচয় হোক তারা কেবল মানুষ, কোনো জাতি কিংবা ধর্মের মাধ্যমে নয়। তাহলেই বিশ্ব হবে শান্তিময়।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল পরিচ্ছন্ন মানস এবং শুভচেতনা। সাম্প্রদায়িকতা কখনোই তার চেতনাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তাই তিনি ‘গোরা’ উপন্যাসে বলতে পেরেছিলেন, ‘আপনি আজ আমাকে সেই দেবতার মন্ত্রে দীক্ষা দিন যিনি হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, ব্রাহ্ম সকলেরই। যার মন্দিরের দ্বার কোন জাতির কাছে, কোন ব্যক্তির কাছে কোন দিন অবরুদ্ধ হয় না, যিনি কেবলই হিন্দুর দেবতা নয়, গোটা ভারতবর্ষের দেবতা।’ বিশ্বসাহিত্যের এমন অবিনাশী বাণী অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনে চিরকালই সহায়ক হয়ে থাকবে।

‘রবীন্দ্রস্মৃতি’ প্রবন্ধে পল্লিকবি জসীমউদদীন বলেছেন, ‘আমি তখন এম এ পড়তে কলিকাতা এমসিএ হোস্টেলে ছিলাম, সেই সময়ে আমি প্রায়ই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে যেতাম; আমাকে দেখলেই কবি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতেন।’
তিনি বুঝেছিলেন মানুষে মানুষে মিলনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা প্রভুত্ব-প্রবণতা। তিনি এই প্রভুত্বের বিরোধী ছিলেন। তাই জমিদারতনয় এবং নিজেই যখন জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব পেয়েছেন তখনো প্রভুত্ব করার প্রবণতামুক্ত ছিলেন। অন্য জমিদারদের দ্বারা নির্যাতিত প্রজার ব্যথাময় কাহিনি উঠে এসেছে তার রচনায়।

‘দীক্ষা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘এ আশ্রম, এখানে কোন দল নেই, সম্প্রদায় নেই। মানব সরোবরে যেমন পদ্ম বিকশিত হয়, তেমনি এই প্রান্তরের আকাশে এই আশ্রমটি জেগে উঠেছে; এক কোন সম্প্রদায়ের বলতে পারবে না।’ তিনি বারবার ধর্মের দীক্ষার অন্তরালে মনুষ্যত্বের দীক্ষার কথা বলেছেন।

জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। মহর্ষি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘অর্জনের দ্বারা তিনি যাহা আমাদিগকে দিয়াছেন, তাহা আমরা গ্রহণ করিয়াছি; বর্জনের দ্বারা যাহা তিনি আমাদিগকে দিয়াছেন, তাহাও যেন গৌরবের সহিত গ্রহণ করিবার যোগ্য আমরা হইতে পারি।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরও উল্লেখ করেছিলেন, ‘কত অনাথ পরিবারের তিনি আশ্রয় ছিলেন, কত দরিদ্র গুণীকে অভাবের পেষণ হইতে উদ্ধার করিয়াছেন, দেশের হিতকর্মে তিনি বিনা আড়ম্বরে গোপনে সাহায্য দিয়াছেন। এই দিকে কৃপণতা করিয়া তিনি কোনদিন বিলাসভোগ বা ধর্মাভিমানচর্চায় প্রশ্রয় দেন নাই।’

পিতার এই দিকগুলো তাকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে, যেসব সংকীর্ণ স্বার্থবোধ মানুষের মনের ভেতর ধর্মীয়, জাতিগত ও দেশগত বিভেদ সৃষ্টি করে তা থেকে তিনি মুক্ত ছিলেন।

শুধু মহর্ষি নন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং রামমোহন রায়ও রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বজনীন মানসিকতা গঠনে সহায়তা করেছেন। কারণ এই দুই মহান ব্যক্তিত্ব সমাজ থেকে সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার, অজ্ঞানতা, জাতিভেদ, জাত্যভিমান, নারীর অবমানতার মানসিকতাকে অপসারণ করতে চেয়েছিলেন। এই প্রচেষ্টা দ্বারা উভয়ই সমাজে যেমন ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন, তেমনি সমাজকে আধুনিক করে গড়ে তুলতেও চেষ্টা করেছেন।

এই দুই মহাপুরুষ দুভাবে রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করেছিলেন, রামমোহন রায়ের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন সাহস এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে আবেগ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আবেগ না থাকলে শক্তি-সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অনেক বৃহৎ কর্ম সম্পাদন করা যায় না। এই আবেগ দ্বারাই তিনি সেই সময় বিধবা বিবাহের মতো একটি কঠিন কর্ম সম্পাদন করতে পেরেছিলেন।

তিনি কখনোই ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ও জাতি গঠনের পরিকল্পনা ও চিন্তার পক্ষে ছিলেন না। তবে তাই বলে তিনি নাস্তিক ছিলেন না, আবার আদর্শগতভাবে তিনি বামপন্থিও ছিলেন না। কোনো না কোনোভাবে ঈশ্বর-বিশ্বাস তার গানে ও কবিতায় স্পষ্টভাবেই অভিব্যক্ত হয়েছে। ধর্মবিশ্বাসকে তিনি নিজের মতো করে গড়ে তুলেছেন, তার বিশ্বাসের একটি বড় জায়গা-অধিকৃত চিন্তাটি ছিল, ‘মানুষের চেয়ে বড়ো আর কিছুই নয়।’ তার মানস জগতে ধর্মান্ধতা, জাতীয়তা এবং সাম্প্রদায়িকতা কোনোভাবেই ঠাঁই করে নিতে পারেনি।

তিনি বিশ্বাস করতেন নাস্তিকের জীবন অত্যন্ত কঠিন। কারণ ঈশ্বর-বিশ্বাসীর জন্য কোনো একটা জায়গা থাকে যেখানে সে আশ্রয় নিতে পারে। কিন্তু নাস্তিককে নিজের অহংকারেই নিষ্কলঙ্ক ও সৎ থাকতে হয়, কারণ তার তো আশ্রয় নেই, যেখানে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাওয়া যায় কিংবা পাপ ধৌত করা যায়।

যেই তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাসী কিন্তু গোঁড়ামিতে আসক্ত নন, সেই তিনিই এককে নয় একান্নবর্তীতে ভরসা রেখেছেন।
তিনি বিশ্বাস করেন সব ধর্মের মানুষের মধ্যে মিলন অনিবার্য। যখন একের সঙ্গে অন্যজন মিলিত হয় তখনই পারস্পরিক ভুল ও মিথ্যাগুলো সামনে আসে এবং তা সংশোধনের সুযোগ থাকে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিরোধী ছিলেন। কারণ প্রতিষ্ঠানপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি নিজস্ব কায়েমি স্বার্থকে চরিতার্থ করার সুযোগ পায়। কিন্তু মানুষের স্বাভাবিক ধর্মবুদ্ধি জাগ্রত থাকলে তা কখনোই সম্ভব হয় না। এভাবেই ভাবতে ভাবতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘জীবন দেবতা’র সন্ধান করেছেন নিজের মধ্যে, কোনো দেবালয়ে নয়।

ধর্মের ভেদাভেদে তিনি কখনোই বিশ্বাসী ছিলেন না, তাই তার দৃষ্টিতে হিন্দু-মুসলমান উভয়ই ‘ভারতভাগ্যের শরিক’। তার সে সময়ের চেতনা আজ যদি নতুন করে ভাবা যেত, তাহলে সত্যি বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা অশান্তির সুরাহা হতো। আজ যখন সাম্প্রদায়িক শক্তি সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে, বিভক্ত করতে মরিয়া হয়ে উঠছে, তখন রবীন্দ্রনাথের প্রদর্শিত পথেই বিশ্বের সব সম্প্রদায়ের মানুষকে মিলিত হতে হবে। এই মিলন একান্তই প্রয়োজন বিচ্ছিন্নতাবাদ, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতার পক্ষের শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য।

আমরা যদি মনের গভীরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমি মানুষ’- এই মন্ত্রটি ধারণ করতে পারি তাহলে সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে পরম ভ্রাতৃত্ববোধে বিশ্বকে আলিঙ্গন করতে পারব। ভাইয়ের বুকে ঠাঁই পাবে ভাই। মিলনের জ্যোতিতে আলোকিত হবে পৃথিবী।
তাই বলতেই পারি, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিরদিনই প্রাসঙ্গিক।

লেখক: কবি, গল্পকার ও শিশু সাহিত্যিক