![শিক্ষা নিয়ে রাজনীতি: রাজনীতির শিক্ষা](uploads/2024/01/18/1705574947.Bolte-Chai-hasibul-hasan.jpg)
কোনো জাতিকে যদি ধ্বংস করতে চাও তাহলে পারমাণবিক বা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রয়োজন নেই বরং সেই জাতির শিক্ষকদের পরীক্ষায় প্রতারণার সুযোগ দিলেই হবে, কারণ এভাবে পরীক্ষা দিয়ে তৈরি হওয়া ডাক্তারদের হাতে রোগীর মৃত্যু হবে, ইঞ্জিনিয়ারদের হাতে দালানকোঠা, ইমারত ভেঙে পড়বে, অর্থনীতিবিদদের দ্বারা দেশের আর্থিক খাত দেউলিয়া হবে, আইনজীবীদের হাতে বিচারব্যবস্থার কবর রচিত হবে, রাজনীতিবিদদের দ্বারা দেশ রসাতলে যাবে। এ প্রসঙ্গে এ পি জে আব্দুল কালাম বলেছেন, যদি সমাজের শিক্ষকদের মর্যাদাকে খাটো করে দেখাতে পারেন তাহলে আগামী প্রজন্ম শিক্ষকদের ঘৃণা করতে শিখবে আর এভাবে একটি দুর্বল জাতিসত্ত্বা নির্মাণের দিকে রাষ্ট্র এগিয়ে যাবে। আমরা কি তবে সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছি!
শিক্ষা নিয়ে রাজনীতি বাংলাদেশের নতুন কোনো অনুষঙ্গ নয়। বাংলাদেশ জন্মের পরপরই শিক্ষা নিয়ে সংস্কার, পরিবর্তনের পরিবর্তে চলছে রাজনীতি। যখনই যে দল ক্ষমতায় এসেছে কমবেশি সেই শাসন সংগঠন শিক্ষার ক্ষতির সম্ভাবনা তৈরি করেছে। রাজনীতিই সব সময় শিক্ষার ভালো-মন্দ নির্ধারণ করেছে। শিক্ষা চিন্তাবিদরা বিভিন্ন সময়ে পরামর্শ দিলেও সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই আমলে নেয়নি। শিক্ষা নিয়ে চলছে রাজনীতি, রাজনীতি থেকে কোনো শিক্ষা আমরা পাইনি। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে খতিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে আমাদের শিক্ষা ও শিক্ষকদের নিয়ে রাজনীতির আদ্যপান্ত।
শিক্ষক ও শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে মান বৃদ্ধির উদ্যোগ সব সময়ই উপেক্ষিত থেকেছে। প্রতিবেশী অন্য রাষ্ট্রগুলো যেখানে শিক্ষায় মোট জিডিপির ৩ থেকে ৮ শতাংশ ব্যয় করলেও বাংলাদেশ প্রায় দেড় দশক ধরে আটকে আছে ২ শতাংশের নিচে। শিক্ষায় এমন বিনিয়োগ সমাধান নয় সমস্যা তৈরি করে প্রতিনিয়ত।
বিভিন্ন সময়ে দেশের শিক্ষক সংগঠন ও অন্য চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলোর চাপে সরকার শিক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়ার কথা বললেও বাস্তবিক অর্থেই করেছে প্রবঞ্চনা। চালাকি করে শিক্ষা খাতের সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতকে সংযুক্ত করে স্বতন্ত্র শিক্ষা খাতের মোট বরাদ্দ অর্থ সরিয়ে নিয়েছে সুকৌশলে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালন ব্যয়বাবদ সেই অর্থ ব্যয়ের ফলে শিক্ষা খাতের জন্য বরাদ্দ বাজেট ভিন্ন খাতে ব্যয় হয়েছে, ফলে যে সমাধান সূত্রকে সামনে রেখে ব্যয় বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল সেটা সফল হয়নি। বই মুদ্রণ, নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন, বই নির্বাচন, যাচাই-বাছাই নিয়ে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত সার্বজনীন নয়। রাজনীতি, ধর্ম সংস্কৃতি নিয়েও পাঠ্যপুস্তকে দলীয় পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ রয়েছে নানা সময়ে। শিক্ষা নিয়ে এমন তালবাহানা, গড়িমসিকে আলাদাভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই। শিক্ষায় বহুমাত্রিক সংকট নিয়ে আছে সরকারের ভেতরে-বাইরে দ্বিমত, সমালোচনা, আস্থাহীনতা। তথাকথিত বহুল আলোচিত ২০১০ সালের নতুন শিক্ষানীতি দেশের জন্য কতটা প্রায়োগিক সুফল বয়ে আনবে সেটা অস্পষ্ট। বিগত অর্ধযুগে সরকার বহুমাত্রিক যাচাই-বাছাই গবেষণা করে পরীক্ষাবিহীন নতুন এক গায়েবি পড়াশোনা চালু করার উদ্যোগের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন। করোনাকালের শিক্ষাক্ষতি কাটিয়ে ওঠার কোনো উদ্যোগ এখনো নেই, বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো নতুন করে নানা শর্তে অর্থ সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, পরিকল্পনা এবং নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে সেই অর্থ বিনিয়োগও ফলপ্রসূ হবে কি না সেটা বলবে সময়।
সরকারের ভেতর থেকেই এর আগে খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক শিক্ষা নিয়ে সীমাহীন অনিশ্চয়তার কথা গণমাধ্যমে বলেছেন বহুবার। শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা নিয়ে যে স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত নিতে সিদ্ধ হস্ত সেটা আবারও নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে। বিভিন্ন সময় শিক্ষা গবেষণাতে প্রকাশিত হয়েছে উচ্চশিক্ষা স্তরে নেই গবেষণা, আছে একটা ধ্বংসের চক্রান্ত। মাধ্যমিকে বিজ্ঞান ও গণিতকে নিরুৎসাহিত করার চক্রান্ত বহুদিনের, এবার সেটা ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছে। ভাষা শিক্ষার মতো জটিল বিষয়ও প্রাথমিকের ওপর চাপিয়ে ভিন্ন পথে পরিচালনা করার পাঁয়তারা চলছে। শিক্ষা খাতে বিগত এক দশকে চোখের সামনে যে ক্ষতি হয়েছে সেটা মেরামত, পুনরুদ্ধারের কোনো চেষ্টা সরকার করেনি। অবশ্য সরকার সমর্থিত মিডিয়াকে দেখেছি শিক্ষা নিয়ে সরকারের ঢাকঢোল পিটাতে। শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতকে নিয়েও সরকারের রাজনীতি থেমে নেই। সীমাহীন রাজনীতিকীকরণ করে সরকার বুঝিয়ে দিয়েছে তারা আছে জলে-স্থলে অন্তরিক্ষে। সরকার সব সময়ই দেশের শিক্ষায় উন্নতির গ্রাফ দেখলেও প্রতিপক্ষ দেখে অন্য চোখে। অতিরিক্ত মুদ্রানীতির বা মুদ্রাস্ফীতির টালমাটাল অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে শিক্ষক সংগঠক ও প্রতিনিধিরা তাদের বেতন বৃদ্ধির জন্য সরকারের কাছে একাধিক স্মারকলিপি, মিটিং, মিছিল, লবিং করলেও সরকার যুগোপযোগী বিষয়টি আমলে না নিয়ে দেশের শিক্ষক সমাজকে চরম অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমরা বিদেশ থেকে সুবিধামতো কত প্রযুক্তি ধার করি। সাঁতার শেখা, খিচুড়ি রান্না, মাছ চাষ শিখতে, শিক্ষা কারিকুলাম দেখতে আমরা বিদেশ যায়, টাকা লুটপাট করি কিন্তু আদতে আমাদের ফলটা হয় শূন্য। তারা অনেক কিছুর পাশাপাশি শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কি দেখেন না! উল্টো সরকার শিক্ষকদের একে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষকদের জানানো হয়েছে, নির্বাচনের ফলাফল তাদের অনুকূলে গেলে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একযোগে জাতীয়করণ করা হবে, এটাও যে শিক্ষকদের সঙ্গে নতুন কোনো প্রবঞ্চনা নয় সেটা বলার সময় এখনো না আসলেও সেটা খানিকটা আঁচ করা যায়। দেশের আর্থিক খাত ও স্বাস্থ্য খাতের মতো শিক্ষা খাতেও সমস্যা পর্বত সমান। গত নির্বাচনের আগেও সরকার চলমান এসব সমস্যা সমাধানের কথা বেশ জোরেশোরেই বলেছিল কিন্তু মোড়লের গরুর মতো সেটাও সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ ২০১০ সালের শিক্ষানীতির ছিটেফোঁটাও বাস্তবায়ন হয়নি যেটা সরকারের সদিচ্ছার অভাবেই হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি অনার্সসহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় হাজারো সমস্যা। সরকার ইচ্ছা করেই এসব সমস্যার সমাধানে আন্তরিক নয়, বিষয়টি ঝুলে আছে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের ওপর।
আল আজহার, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ গুণে মানে নামে বিশ্বসেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেখানে জেলায় জেলায় ছাগলের বাচ্চা বিয়ানোর মতো করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষার মানকে টেনে নিচে নামানোর ষড়যন্ত্র ছাড়া বিকল্প কিছু সরকার ভাবছে কি না অন্তত সাধারণের বোধগম্য নয়। শিক্ষা নিয়ে সরকারের রাজনীতি ধোঁয়াশায় মোড়ানো। কারিকুলাম পদ্ধতি পরিবর্তন নিয়ে গবেষণার শেষ নেই ফলাফল শূন্য প্রাথমিকে পাইলট প্রকল্প কেন তার গবেষণা শেষ করে এগোতে পারছে না সেটা কেবলই অনিশ্চয়তা ছড়াচ্ছে সে কারণ অজানা। সময়োপযোগী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই যেখানে সব বদলে দিতে পারে উল্টো সেটার অভাবেই করোনা-পরবর্তী সময়ে শিক্ষার পুনঃজাগরণের নামে শুধুই ফাঁকা বুলি ছাড়া কিছুই দেখেনি দেশের জনগণ। শিক্ষাকে রাজনীতিকীকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার অব্যাহত প্রচেষ্টা শিক্ষার ক্ষতির মূল কারণ।
স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থার যে দিবাস্বপ্ন দেখার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি সরকার দিচ্ছে সেটা অলৌকিক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তৃণমূলে পাহাড় সমান সমস্যা রেখে সমাধানের চেষ্টা করাটাও রাষ্ট্রীয় বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। করোনাকালে বাংলাদেশে স্মরণকালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হলেও এটা কাটিয়ে ওঠার নামে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। কাগজে কলমে সংখ্যাতাত্ত্বিক অগ্রগতি একটা দেশের শিক্ষা পরিবর্তনের মাপকাঠি হতে পারে না। কাঠামো ঠিক না করে চরিত্র বদলানোর চেষ্টা অবাস্তব কল্পনাপ্রসূত পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। রয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি সংস্কার নিয়ে নানা প্রশ্ন। গবেষণা বলছে কোটা পদ্ধতি ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতায় শিক্ষায় ক্রমবর্ধমান অগ্রগতির চেয়ে এক দশক ধরে অধোগতি লক্ষণীয়। এখনো এই প্রক্রিয়া চলমান। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কথা বলছি আমরা কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবেছি প্রচলিত এই শিক্ষাব্যবস্থা দ্বারা সেটা সম্ভব নয়। শিক্ষার এই অপূরণীয় ক্ষতির কারণ সাধারণও বোঝে, শিক্ষার অধোগতির মূল কারণ শুধু বোঝে না সরকার। শিক্ষাকে মেরামত না করে সরকার এমন মেরামতহীনতার ভেতর দিয়ে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ সময়টা ক্ষেপণ করলে রাষ্ট্রের জন্যই কেবল শুধু এই ক্ষতির কারণ তৈরি হবে, যা আগামী প্রজন্মের জন্যও এটা খুব বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দেবে। তাহলে কি সক্রেটিসের সেই কথাই সত্য তারা যে কিছুই বোঝে না সে কথাই তারা বোঝে না কলিকালে এ কথায় এখন সবচেয়ে বড় প্রাসঙ্গিক।
শেষ করব ইউনির্ভাসিটি অব সাউথ আফ্রিকার মূল ফটকে লেখা উদ্ধৃতি দিয়ে ‘কোনো জাতিকে যদি ধ্বংস করতে চাও তাহলে পারমাণবিক বা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রয়োজন নেই বরং সেই জাতির শিক্ষকদের পরীক্ষায় প্রতারণার সুযোগ দিলেই হবে, কারণ এভাবে পরীক্ষা দিয়ে তৈরি হওয়া ডাক্তারদের হাতে রোগীর মৃত্যু হবে, ইঞ্জিনিয়ারদের হাতে দালানকোঠা, ইমারত ভেঙে পড়বে, অর্থনীতিবিদদের দ্বারা দেশের আর্থিক খাত দেউলিয়া হবে, আইনজীবীদের হাতে বিচারব্যবস্থার কবর রচিত হবে, রাজনীতিবিদদের দ্বারা দেশ রসাতলে যাবে।’ এ প্রসঙ্গে এ পি জে আবুল কালাম বলেছেন, যদি সমাজের শিক্ষকদের মর্যাদাকে খাটো করে দেখাতে পারেন তাহলে আগামী প্রজন্ম শিক্ষকদের ঘৃণা করতে শিখবে আর এভাবে একটি দুর্বল জাতিসত্ত্বা নির্মাণের দিকে রাষ্ট্র এগিয়ে যাবে। আমরা কি তবে সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছি!
লেখক: শিক্ষা গবেষক ও প্রাবন্ধিক
[email protected]