ঢাকা ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

শিক্ষা নিয়ে রাজনীতি: রাজনীতির শিক্ষা

প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০৪:৪৯ পিএম
আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:১৩ এএম
শিক্ষা নিয়ে রাজনীতি: রাজনীতির শিক্ষা
হাসিবুল হাসান

কোনো জাতিকে যদি ধ্বংস করতে চাও তাহলে পারমাণবিক বা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রয়োজন নেই বরং সেই জাতির শিক্ষকদের পরীক্ষায় প্রতারণার সুযোগ দিলেই হবে, কারণ এভাবে পরীক্ষা দিয়ে তৈরি হওয়া ডাক্তারদের হাতে রোগীর মৃত্যু হবে, ইঞ্জিনিয়ারদের হাতে দালানকোঠা, ইমারত ভেঙে পড়বে, অর্থনীতিবিদদের দ্বারা দেশের আর্থিক খাত দেউলিয়া হবে, আইনজীবীদের হাতে বিচারব্যবস্থার কবর রচিত হবে, রাজনীতিবিদদের দ্বারা দেশ রসাতলে যাবে। এ প্রসঙ্গে এ পি জে আব্দুল কালাম বলেছেন, যদি সমাজের শিক্ষকদের মর্যাদাকে খাটো করে দেখাতে পারেন তাহলে আগামী প্রজন্ম শিক্ষকদের ঘৃণা করতে শিখবে আর এভাবে একটি দুর্বল জাতিসত্ত্বা নির্মাণের দিকে রাষ্ট্র এগিয়ে যাবে। আমরা কি তবে সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছি!

শিক্ষা নিয়ে রাজনীতি বাংলাদেশের নতুন কোনো অনুষঙ্গ নয়। বাংলাদেশ জন্মের পরপরই শিক্ষা নিয়ে সংস্কার, পরিবর্তনের পরিবর্তে চলছে রাজনীতি। যখনই যে দল ক্ষমতায় এসেছে কমবেশি সেই শাসন সংগঠন শিক্ষার ক্ষতির সম্ভাবনা তৈরি করেছে। রাজনীতিই সব সময় শিক্ষার ভালো-মন্দ নির্ধারণ করেছে। শিক্ষা চিন্তাবিদরা বিভিন্ন সময়ে পরামর্শ দিলেও সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই আমলে নেয়নি। শিক্ষা নিয়ে চলছে রাজনীতি, রাজনীতি থেকে কোনো শিক্ষা আমরা পাইনি। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে খতিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে আমাদের শিক্ষা ও শিক্ষকদের নিয়ে রাজনীতির আদ্যপান্ত।

শিক্ষক ও শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে মান বৃদ্ধির উদ্যোগ সব সময়ই উপেক্ষিত থেকেছে। প্রতিবেশী অন্য রাষ্ট্রগুলো যেখানে শিক্ষায় মোট জিডিপির ৩ থেকে ৮ শতাংশ ব্যয় করলেও বাংলাদেশ প্রায় দেড় দশক ধরে আটকে আছে ২ শতাংশের নিচে। শিক্ষায় এমন বিনিয়োগ সমাধান নয় সমস্যা তৈরি করে প্রতিনিয়ত।

বিভিন্ন সময়ে দেশের শিক্ষক সংগঠন ও অন্য চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলোর চাপে সরকার শিক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়ার কথা বললেও বাস্তবিক অর্থেই করেছে প্রবঞ্চনা। চালাকি করে শিক্ষা খাতের সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতকে সংযুক্ত করে স্বতন্ত্র শিক্ষা খাতের মোট বরাদ্দ অর্থ সরিয়ে নিয়েছে সুকৌশলে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালন ব্যয়বাবদ সেই অর্থ ব্যয়ের ফলে শিক্ষা খাতের জন্য বরাদ্দ বাজেট ভিন্ন খাতে ব্যয় হয়েছে, ফলে যে সমাধান সূত্রকে সামনে রেখে ব্যয় বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল সেটা সফল হয়নি। বই মুদ্রণ, নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন, বই নির্বাচন, যাচাই-বাছাই নিয়ে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত সার্বজনীন নয়। রাজনীতি, ধর্ম সংস্কৃতি নিয়েও পাঠ্যপুস্তকে দলীয় পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ রয়েছে নানা সময়ে। শিক্ষা নিয়ে এমন তালবাহানা, গড়িমসিকে আলাদাভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই। শিক্ষায় বহুমাত্রিক সংকট নিয়ে আছে সরকারের ভেতরে-বাইরে দ্বিমত, সমালোচনা, আস্থাহীনতা। তথাকথিত বহুল আলোচিত ২০১০ সালের নতুন শিক্ষানীতি দেশের জন্য কতটা প্রায়োগিক সুফল বয়ে আনবে সেটা অস্পষ্ট। বিগত অর্ধযুগে সরকার বহুমাত্রিক যাচাই-বাছাই গবেষণা করে পরীক্ষাবিহীন নতুন এক গায়েবি পড়াশোনা চালু করার উদ্যোগের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন। করোনাকালের শিক্ষাক্ষতি কাটিয়ে ওঠার কোনো উদ্যোগ এখনো নেই, বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো নতুন করে নানা শর্তে অর্থ সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, পরিকল্পনা এবং নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে সেই অর্থ বিনিয়োগও ফলপ্রসূ হবে কি না সেটা বলবে সময়।

সরকারের ভেতর থেকেই এর আগে খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক শিক্ষা নিয়ে সীমাহীন অনিশ্চয়তার কথা গণমাধ্যমে বলেছেন বহুবার। শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা নিয়ে যে স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত নিতে সিদ্ধ হস্ত সেটা আবারও নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে। বিভিন্ন সময় শিক্ষা গবেষণাতে প্রকাশিত হয়েছে উচ্চশিক্ষা স্তরে নেই গবেষণা, আছে একটা ধ্বংসের চক্রান্ত। মাধ্যমিকে বিজ্ঞান ও গণিতকে নিরুৎসাহিত করার চক্রান্ত বহুদিনের, এবার সেটা ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছে। ভাষা শিক্ষার মতো জটিল বিষয়ও প্রাথমিকের ওপর চাপিয়ে ভিন্ন পথে পরিচালনা করার পাঁয়তারা চলছে। শিক্ষা খাতে বিগত এক দশকে চোখের সামনে যে ক্ষতি হয়েছে সেটা মেরামত, পুনরুদ্ধারের কোনো চেষ্টা সরকার করেনি। অবশ্য সরকার সমর্থিত মিডিয়াকে দেখেছি শিক্ষা নিয়ে সরকারের ঢাকঢোল পিটাতে। শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতকে নিয়েও সরকারের রাজনীতি থেমে নেই। সীমাহীন রাজনীতিকীকরণ করে সরকার বুঝিয়ে দিয়েছে তারা আছে জলে-স্থলে অন্তরিক্ষে। সরকার সব সময়ই দেশের শিক্ষায় উন্নতির গ্রাফ দেখলেও প্রতিপক্ষ দেখে অন্য চোখে। অতিরিক্ত মুদ্রানীতির বা মুদ্রাস্ফীতির টালমাটাল অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে শিক্ষক সংগঠক ও প্রতিনিধিরা তাদের বেতন বৃদ্ধির জন্য সরকারের কাছে একাধিক স্মারকলিপি, মিটিং, মিছিল, লবিং করলেও সরকার যুগোপযোগী বিষয়টি আমলে না নিয়ে দেশের শিক্ষক সমাজকে চরম অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমরা বিদেশ থেকে সুবিধামতো কত প্রযুক্তি ধার করি। সাঁতার শেখা, খিচুড়ি রান্না, মাছ চাষ শিখতে, শিক্ষা কারিকুলাম দেখতে আমরা বিদেশ যায়, টাকা লুটপাট করি কিন্তু আদতে আমাদের ফলটা হয় শূন্য। তারা অনেক কিছুর পাশাপাশি শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কি দেখেন না! উল্টো সরকার শিক্ষকদের একে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে।

নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষকদের জানানো হয়েছে, নির্বাচনের ফলাফল তাদের অনুকূলে গেলে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একযোগে জাতীয়করণ করা হবে, এটাও যে শিক্ষকদের সঙ্গে নতুন কোনো প্রবঞ্চনা নয় সেটা বলার সময় এখনো না আসলেও সেটা খানিকটা আঁচ করা যায়। দেশের আর্থিক খাত ও স্বাস্থ্য খাতের মতো শিক্ষা খাতেও সমস্যা পর্বত সমান। গত নির্বাচনের আগেও সরকার চলমান এসব সমস্যা সমাধানের কথা বেশ জোরেশোরেই বলেছিল কিন্তু মোড়লের গরুর মতো সেটাও সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ ২০১০ সালের শিক্ষানীতির ছিটেফোঁটাও বাস্তবায়ন হয়নি যেটা সরকারের সদিচ্ছার অভাবেই হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি অনার্সসহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় হাজারো সমস্যা। সরকার ইচ্ছা করেই এসব সমস্যার সমাধানে আন্তরিক নয়, বিষয়টি ঝুলে আছে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের ওপর। 

আল আজহার, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ গুণে মানে নামে বিশ্বসেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেখানে জেলায় জেলায় ছাগলের বাচ্চা বিয়ানোর মতো করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষার মানকে টেনে নিচে নামানোর ষড়যন্ত্র ছাড়া বিকল্প কিছু সরকার ভাবছে কি না অন্তত সাধারণের বোধগম্য নয়। শিক্ষা নিয়ে সরকারের রাজনীতি ধোঁয়াশায় মোড়ানো। কারিকুলাম পদ্ধতি পরিবর্তন নিয়ে গবেষণার শেষ নেই ফলাফল শূন্য প্রাথমিকে পাইলট প্রকল্প কেন তার গবেষণা শেষ করে এগোতে পারছে না সেটা কেবলই অনিশ্চয়তা ছড়াচ্ছে সে কারণ অজানা। সময়োপযোগী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই যেখানে সব বদলে দিতে পারে উল্টো সেটার অভাবেই করোনা-পরবর্তী সময়ে শিক্ষার পুনঃজাগরণের নামে শুধুই ফাঁকা বুলি ছাড়া কিছুই দেখেনি দেশের জনগণ। শিক্ষাকে রাজনীতিকীকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার অব্যাহত প্রচেষ্টা শিক্ষার ক্ষতির মূল কারণ।

স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থার যে দিবাস্বপ্ন দেখার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি সরকার দিচ্ছে সেটা অলৌকিক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তৃণমূলে পাহাড় সমান সমস্যা রেখে সমাধানের চেষ্টা করাটাও রাষ্ট্রীয় বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। করোনাকালে বাংলাদেশে স্মরণকালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হলেও এটা কাটিয়ে ওঠার নামে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। কাগজে কলমে সংখ্যাতাত্ত্বিক অগ্রগতি একটা দেশের শিক্ষা পরিবর্তনের মাপকাঠি হতে পারে না। কাঠামো ঠিক না করে চরিত্র বদলানোর চেষ্টা অবাস্তব কল্পনাপ্রসূত পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। রয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি সংস্কার নিয়ে নানা প্রশ্ন। গবেষণা বলছে কোটা পদ্ধতি ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতায় শিক্ষায় ক্রমবর্ধমান অগ্রগতির চেয়ে এক দশক ধরে অধোগতি লক্ষণীয়। এখনো এই প্রক্রিয়া চলমান। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কথা বলছি আমরা কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবেছি প্রচলিত এই শিক্ষাব্যবস্থা দ্বারা সেটা সম্ভব নয়। শিক্ষার এই অপূরণীয় ক্ষতির কারণ সাধারণও বোঝে, শিক্ষার অধোগতির মূল কারণ শুধু বোঝে না সরকার। শিক্ষাকে মেরামত না করে সরকার এমন মেরামতহীনতার ভেতর দিয়ে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ সময়টা ক্ষেপণ করলে রাষ্ট্রের জন্যই কেবল শুধু এই ক্ষতির কারণ তৈরি হবে, যা আগামী প্রজন্মের জন্যও এটা খুব বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দেবে। তাহলে কি সক্রেটিসের সেই কথাই সত্য তারা যে কিছুই বোঝে না সে কথাই তারা বোঝে না কলিকালে এ কথায় এখন সবচেয়ে বড় প্রাসঙ্গিক।

শেষ করব ইউনির্ভাসিটি অব সাউথ আফ্রিকার মূল ফটকে লেখা উদ্ধৃতি দিয়ে ‘কোনো জাতিকে যদি ধ্বংস করতে চাও তাহলে পারমাণবিক বা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রয়োজন নেই বরং সেই জাতির শিক্ষকদের পরীক্ষায় প্রতারণার সুযোগ দিলেই হবে, কারণ এভাবে পরীক্ষা দিয়ে তৈরি হওয়া ডাক্তারদের হাতে রোগীর মৃত্যু হবে, ইঞ্জিনিয়ারদের হাতে দালানকোঠা, ইমারত ভেঙে পড়বে, অর্থনীতিবিদদের দ্বারা দেশের আর্থিক খাত দেউলিয়া হবে, আইনজীবীদের হাতে বিচারব্যবস্থার কবর রচিত হবে, রাজনীতিবিদদের দ্বারা দেশ রসাতলে যাবে।’ এ প্রসঙ্গে এ পি জে আবুল কালাম বলেছেন, যদি সমাজের শিক্ষকদের মর্যাদাকে খাটো করে দেখাতে পারেন তাহলে আগামী প্রজন্ম শিক্ষকদের ঘৃণা করতে শিখবে আর এভাবে একটি দুর্বল জাতিসত্ত্বা নির্মাণের দিকে রাষ্ট্র এগিয়ে যাবে। আমরা কি তবে সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছি!

লেখক: শিক্ষা গবেষক ও প্রাবন্ধিক
[email protected]

দেশাত্মবোধ ও আন্দোলনের মৌলিকতা

প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৪, ০১:৫৮ পিএম
আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৪, ০১:৫৮ পিএম
দেশাত্মবোধ ও আন্দোলনের মৌলিকতা
এম আর লিটন

বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে দেশাত্মবোধ চেতনা একটি অপরিহার্য মৌলিক উপাদান। স্বাধীনতার সংগ্রাম থেকে শুরু করে বিভিন্ন অধিকার আদায়ের আন্দোলন পর্যন্ত, দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধের ভূমিকা অতুলনীয়। তবে বর্তমান সময়ে কিছু আন্দোলন ও স্লোগান এমন দিকনির্দেশনার অভাবে সংকটে পড়েছে। যা আমাদের ঐতিহ্য ও দেশাত্মবোধের মূলগত বিষয়গুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

দেশাত্মবোধ চেতনা হলো একটি জাতির আত্মপরিচয়ের মূল ভিত্তি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের স্লোগান ‘তুমি কে, আমি কে, বাঙালি বাঙালি’ দেশপ্রেম ও মুক্তির অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। এ স্লোগান আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, এবং জাতীয় গর্বের বহিঃপ্রকাশ ছিল। দেশে যেকোনো সংকট ও আন্দোলনের সময় ওই দেশাত্মবোধ চেতনা আমাদেরকে একত্রিত করে। আমাদের জাতীয় পরিচয়ের প্রতি দায়বদ্ধ করে তোলে।

আন্দোলনের সফলতা নির্ভর করে তার মৌলিক উদ্দেশ্য ও চেতনায়। একটি আন্দোলনের উদ্দেশ্য যতই যৌক্তিক হোক না কেন, যদি তা দেশাত্মবোধ চেতনায় সমৃদ্ধ না হয়, তাহলে সেই আন্দোলনের মৌলিক মূল্য কমে যায়। সাম্প্রতিক কোটাব্যবস্থা বাতিলের আন্দোলনে ‘রাজাকার’ স্লোগানের ব্যবহার উদ্বেগজনক ছিল। যদিও কিছু সময় পর আন্দোলনকারীরা ওই স্লোগান পরিবর্তন করেছিলেন। যাইহোক, রাজাকার শব্দটি স্বাধীনতার বিরোধী শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অবজ্ঞা করা হয়। এই ধরনের স্লোগান আন্দোলনের আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। জাতীয় ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান অনেকেই অপরিপক্কভাবে বা প্ররোচনার প্রভাবে আন্দোলনকারীরা ব্যবহার করেছেন। যদিও এটি আন্দোলনের গতি বা কর্মসূচির অংশ হয়, তবে এর মাধ্যমে জাতির মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি অমর্যাদা প্রকাশ পায়। যারা আন্দোলন স্লোগান হিসেবে রাজাকার শব্দ ব্যবহার করেছেন, তাদের উচিত ওই স্লোগানের জন্য অনুতপ্ত হওয়া এবং জাতীয় চেতনাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে কাজ করা।

যেকোনো আন্দোলনের বিজয় তখনই স্থায়ী হবে, যখন তা দেশাত্মবোধ চেতনায় শাণিত হবে। দেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতীয় পরিচয়কে সম্মানিত করার মাধ্যমে আন্দোলনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও মূল্য সংরক্ষিত থাকবে। তাই, আন্দোলনের সফলতা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার জন্য আমাদের উচিত দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সম্মান জানানো। এসব চেতনাবিরোধী স্লোগানের বিরুদ্ধে সবার কঠোর অবস্থান নেওয়া উচিত। 
দেশাত্মবোধ চেতনা ও আন্দোলনের মৌলিকতা আমাদের জাতীয় সত্তার মূল ভিত্তি। কোনো আন্দোলন যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ না হয়, তাহলে বিজয় অর্জন করলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। আমাদের উচিত দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আন্দোলন পরিচালনা করা এবং জাতীয় ঐক্য ও সম্মানকে প্রাধান্য দেওয়া। এইভাবে, আমাদের আন্দোলনগুলো সঠিক দিশা ও প্রভাব রাখতে সক্ষম হবে এবং জাতির কল্যাণে অবদান রাখবে।

লেখক: সাংবাদিক

জাতীয় শিক্ষাক্রম ফ্রেমওয়ার্ক-২০২১ প্রণয়নে স্টেকহোল্ডারদের মতামত কতটা গুরুত্ব পেল?

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২৪, ০৪:২৭ পিএম
আপডেট: ১৮ জুলাই ২০২৪, ০৫:০৫ পিএম
জাতীয় শিক্ষাক্রম ফ্রেমওয়ার্ক-২০২১ প্রণয়নে স্টেকহোল্ডারদের মতামত কতটা গুরুত্ব পেল?
মো. হাবিবুর রহমান

গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য একটি কার্যকরী শিক্ষাক্রম (কারিকুলাম) প্রণয়ন অপরিহার্য। কারিকুলাম প্রণয়নে স্টেকহোল্ডারদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন জাতীয় কারিকুলাম প্রণয়নে শিক্ষক, শিক্ষার্থী বা অভিভাবকদের অংশগ্রহণ কতটা নিশ্চিত করা হয়েছে? বা কীভাবে করা হয়েছে? প্রণীত জাতীয় কারিকুলাম এখন বাস্তবায়ন পর্যায়ে রয়েছে, এ বিষয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রতিক্রিয়া কী বার্তা দেয়? 

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সুবাদে স্নাতক পর্যায়ে দুটি ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে একটি কারিকুলাম প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে। টারসিয়ারি পর্যায়ে বর্তমানে ওবিই (OBE, Outcome Based Education) পদ্ধতিতে কারিকুলাম প্রণয়নের জন্য ইউজিসি কর্তৃক নির্দেশনা রয়েছে। এই পদ্ধতিতে কারিকুলাম প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্টেকহোল্ডারদের মতামত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার কথা বলা হয়েছে। মোটাদাগে এই স্টেইকহোল্ডাররা হলেন: বিষয় বিশেষজ্ঞ (Subject Experts); প্রাক্তন শিক্ষার্থী (Alumni); শিক্ষার্থীদের বা যাদের জন্য কারিকুলাম প্রণয়ন করা হচ্ছে তাদের প্রয়োজন  (Target Population's Needs); অভিভাবক  (Guardians); চাকরিদাতা (Employers); এডভাইজরি প্যানেল (বিভিন্ন পেশাজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত) এবং সমাজের সদস্য (Community Members)। আমি ও আমার সহকর্মীরা কারিকুলাম প্রণয়নের সময় উল্লিখিত এই স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলাদা করে বসেছি, আলোচনায় তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছি এবং তাদের মতামতগুলো লিপিবদ্ধ করেছি। প্রণীত কারিকুলামেও এর যথাযথ প্রতিফলন ঘটেছে। 

জাতীয় শিক্ষাক্রম (কারিকুলাম) প্রনয়নের  ক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রণয়ন কমিটি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছেন। জাতীয় শিক্ষাক্রমের প্রভাব/ফলাফল জাতির জীবনে সুদূরপ্রসারী। সুতরাং শিক্ষাক্রম প্রণয়নের প্রক্রিয়াও যথাযথ ও সময়োপযোগী হওয়া বাঞ্চনীয়। কারিকুলাম প্রণয়নের ধাপসমুহ সঠিকভাবে অনুসরণ করলেই যে, প্রণীত কারিকুলাম ত্রুটিমুক্ত হবে একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কারিকুলামের কার্যকারিতা ভালো বোঝা যাবে এর বাস্তবায়ন পর্যায়ে। তবে, কারিকুলামের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। কেন গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না? বা দুর্বলতাগুলো কোথায়? তা চিহ্নিত করা জরুরি। কেননা এর মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে অভিভাবকদের সাথে কথা বলেছি ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করেছি। এই আলোকে অভিভাবকদের কাছ থেকে আমি অনেক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। এই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ভালো নয়। অভিভাবকদের মাধ্যমে এই নেতিবাচক মনোভাব শিক্ষার্থীদের মধ্যেও সংক্রমিত হতে পারে এবং তাদের মানসপটেও নতুন কারিকুলামের প্রতি তথা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা তৈরি হতে পারে। যা আদতে নতুন প্রজন্মের জন্য এক অশনিসংকেত। সুতরাং শুরুতেই এই অনাস্থা দূর করা জরুরী। মোটাদাগে যে বিষয়গুলো অভিভাবকগণ, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের সাথে আমার আলোচনায় উঠে এসেছে, সেগুলো হল: ক। নতুন কারিকুলাম প্রণীত সিলেবাস, বই-পুস্তক, শ্রেণী-শিখন পদ্ধতি ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় আস্থাহীনতা; খ। মূল্যায়ন প্রক্রিয়া স্পষ্ট ও চূড়ান্ত না হওয়া (অতিমাত্রায় পরীক্ষামূলক বা এক্সপেরিমেন্টাল); গ। নতুন কারিকুলাম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের (দেশে ও বিদেশে) উচ্চ শিক্ষা পদ্ধতির বা কারিকুলামের সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ? এবং এ ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণার অভাব; ঘ। সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। 

নতুন কারিকুলামের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মতামত, প্রতিক্রিয়া ও যৌক্তিক সমালোচনাকে গুরুত্ব দেওয়া অতীব জরুরি। কারিকুলাম প্রণয়নের প্রাইমারি স্টেইকহোল্ডারদের একদম বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সুবিবেচনাপ্রসূত হবে না এবং কোনো ভালো ফলাফলও বয়ে নিয়ে আসবে না। কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং একে ফলপ্রসূ করতে হলে স্টেইকহোল্ডারদের যৌক্তিক মতামত গ্রহণ ও তাদের সহযোগিতা অনস্বীকার্য।  

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, কুমিল্লা
[email protected]

একেই বলে ছাগলধরা!

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২৪, ১২:৪৪ পিএম
আপডেট: ১৮ জুলাই ২০২৪, ০৫:০৪ পিএম
একেই বলে ছাগলধরা!
ড. মো. আসাদুজ্জামান মিয়া (মুন্না)

আগের দিনে ছাগল নিয়ে যত প্রবাদ ছিল তা বর্তমান সময়ের একটি ছাগল পরিবর্তন করে দিয়েছে। ছাগলে কিনা খায়, পাগলে কিনা বলে? হাজার টাকার বাগান খাইল পাঁচ সিকার ছাগলে! এসব প্রবাদ এখন উল্টে গেছে। এখনকার ছাগলরা উচ্চবংশীয়! যা তা খায় না। তথাকথিত ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা ইমরান হোসেনের প্রচেষ্টায় এবার বিরল কিছু গরু ও ছাগল কোরবানির বাজারে এসেছে। আমাদের সৌভাগ্য হয়েছে এসব বিরল গরু ও ছাগলের বিষয়ে জানার ও দেখার। সরাসরি নয়, ফেসবুকের কল্যাণে।

একটি গরুর দাম ১ কোটি আর একটি ছাগলের দাম ১৫ লাখ। শুনতে গল্প মনে হলেও এটাই বাস্তব। এগুলো সাধারণ কোনো গরু ও ছাগল নয় বরং এরা উচ্চবংশীয়, এদের পূর্বপুরুষরা এলিট শ্রেণির। এদের বিশেষ কেরামতি আছে। সত্যিই তাই। এরা এমন ভাইরাল গরু ও ছাগল যে এদের লালন-পালনকারী, ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই ইতোমধ্যে সুপার ভাইরাল হয়ে গেছে। যদিও এখন পর্যন্ত আমরা শুধু একটি ছাগলের কেরামতি দেখছি, কোটি টাকার গরুর কেরামতি দেখার অপেক্ষায় আছি।

বাংলাদেশের সর্বত্র এখন এই ভাইরাল ছাগল নিয়ে বেশ তুলকালাম চলছে। মজার বিষয় হলো ছাগলটি আমাদের সমাজের তথাকথিত ওপর শ্রেণির কিছু মানুষের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছে। যে কাজ কোনো দিন কেউ করতে পারত কি না সন্দেহ রয়েছে, তা একটি ছাগল অনায়েসে করে দেখিয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে, এই ছাগলের ভয়ে এখন সবাই তটস্থ। রীতিমতো কারও কারও ঘুম হারাম করে দিয়েছে এই ছাগল। ছাগলকাণ্ডে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে এর ক্রেতা ইফাত। আবার ছাগলকাণ্ডে ক্রেতা ইফাতকে অস্বীকার করেছে তার জন্মদাতা বাবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মো. মতিউর রহমান (সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত)। পর্দার আড়ালে চলে গেছে পুরো মতিউর পরিবার। কী নিদারুণ পরিস্থিতি? যে ছাগল কাঁঠাল পাতা খায়, সে এখন আমাদের মানুষ চেনাচ্ছে। এই ছাগলকাণ্ডে আমরা মতিউর রহমান নামক একজন অতি ক্ষমতাধর, বিশাল সম্পদশালী অসৎ সরকারি অফিসার সম্পর্কে জানতে পেরেছি। তার ঠিকুজিকুষ্ঠি পুরোপুরি উদ্ধার হয়েছে। তার স্ত্রীরা, পুত্র ও কন্যারা কোথায় কী করছেন, কী কী অবৈধ সম্পদ ভোগদখল করছেন তা গোটা পৃথিবীর মানুষ জানতে পেরেছে।

আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, যে মতিউর রহমানকে ইতিপূর্বে কেউ থামাতে পারেনি একটি ছাগল তা করে দেখিয়েছে। এই ছাগলের কল্যাণেই জানতে পারলাম যে, এই মতিউর রহমান ছিলেন রাজনৈতিক, প্রশাসনিক সব ক্ষমতার ওপরে। বাংলাদেশের সব স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ছিল মতিউর রহমানের শক্ত নেটওয়ার্ক। বাংলাদেশের যে কাউকে তিনি ম্যানেজ করার স্বক্ষমতা রাখতেন। তার দাপটে ভালো ও সৎ অফিসাররা ছিলেন অসহায়। মনে হচ্ছে মতিউর রহমান বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে খুব ছোট করে ফেলেছিলেন, যেখানে চাইলেই যা ইচ্ছে তা করা যায়। কীসের আইন, কীসের নিয়ম, কীসের শৃঙ্খলা। একটি দেশকে পিছিয়ে দিতে এরকম দু-একজন মতিউর রহমানই কি যথেষ্ট নয়? রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে মতিউর রহমানের মতো মানুষেরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেবে না, তা তো হতে পারে না। তাই তো একটি ছাগলের মাধ্যমে মতিউর রহমানকে বধ করা হয়েছে। এটা কি নিছক কাকতালীয়? নাকি দুর্ভ্যাগ্যবশত? নাকি অ্যাক্সিডেন্ট? সৃষ্টিকর্তার লীলাখেলা ধরা বড় দায়। 

উদ্বেগের বিষয় হলো, ছাগলটা কিন্তু এখনো আছে। ইমরান হোসেনের খামারে, গলার কাঁটা হয়ে! এই ছাগল দিয়ে সে কী করবে? বিক্রি করবে, কে কিনবে? ১৫ লাখ টাকার ছাগল নিজে জবাই করে খাবে, এই রকম ব্যবসায়ী তো সে নয়! তবে এই ছাগল নিয়ে সে যা করবে তাতেই কিন্তু নিউজ বের হবে। 

সাংবাদিকরা এই ছাগলের সংবাদ প্রকাশের জন্য রীতিমতো অপেক্ষা করছেন। তবে বাংলাদেশে প্রধান ধর্মীয় উৎসব কোরবানিতে ১ কোটি টাকার একটি গরু আর ১৫ লাখ টাকার একটি ছাগল বিক্রি করে যে ব্রেক-থ্রো ঘটিয়েছে উদ্যোক্তা ইমরান হোসেন, তার বিড়ম্বনা তো তাকে পেতেই হবে। কোরবানি তো আর লোক দেখানোর বিষয় নয়। উচ্চবংশীয় গরু/ছাগল, এদের পূর্বপুরুষরা এলিট শ্রেণির সাধারণ মানুষের কাছে এসব বিষয়ের কি আদৌ কোনো গুরুত্ব আছে? ইমরান হোসেন বিভিন্ন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে যতই সাফাই গাক না কেন সাধারণ মানুষ বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। তবে একটি কাজের জন্য ইমরান হোসেনকে ধন্যবাদ জানাতেই হয় যে, তার অতিদামি এসব গরু ও ছাগল অবৈধ টাকার মালিকদের ধরতে একটা টোপ হিসেবে কাজ করেছে। যে টোপে ধরাশায়ী হয়েছেন মতিউর রহমানের মতো অতি কৌশলী ও প্রতাপশালী অসৎ অফিসার। কে জানে এরকম উচ্চবংশীয় গরু/ছাগল আবার কোনো এক নতুন মতিউরকে ধরার জন্য বসে আছে কিনা?

বাংলাদেশে সরকারি চাকরি করে বড় চেয়ারে বসার সুযোগে চতুরতার সঙ্গে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে যারা অবৈধ টাকার পাহাড় বানিয়েছেন, হাজার হাজার কোটি টাকা চুষেছেন বা চুষে যাচ্ছেন, তারা দয়া করে থামুন। সাবধান হোন। আপনাদের অবৈধ টাকা দিয়ে আপনারা সর্বোচ্চ কী করতে পারেন তা দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেন, বিদেশে বাড়ি কেনেন, দেশে অভিজাত এলাকায় নামে-বেনামে ফ্ল্যাট/বাড়ি ক্রয় করেন, কয়েক শ বিঘা জায়গার ওপর রিসোর্ট নির্মাণ করেন আর ছেলেমেয়েদেরে এসব অবৈধ টাকা অবাধে খরচ করতে দেন, এই তো? তাই সরকারি চাকুরে, যাদের কাছে এরকম হাজার হাজার কোটি টাকা রয়েছে তাদের জন্য একটা পরামর্শ- টাকাগুলো বিদেশে প্রাচার না করে বরং তা দিয়ে বঞ্চিত মানুষের জন্য কিছু করুন, দেশের টাকা দেশেই রাখুন, বাংলাদেশের হাজার হাজার বেকার তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করুন, অনুন্নত গ্রামের উন্নয়নে ও প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়ান। ভালো কাজে ব্যবহার করেন। তা না হলে আপনিও একদিন নিশ্চিত এরকম ছাগলবধ হবেন। যাদের সহযোগিতায় অপকর্ম করেছেন, স্বার্থ বিনিময় করেছেন তারা কেউ কিন্তু আপনার দায় নেবে না। আপনাকে ছিছি করবে গোটা জাতি। আপনার অর্থই হবে অনর্থের মূল। এরকমই এক ছাগলকাণ্ডে উন্মোচিত হবে আপনার সব কুকর্ম, তাসের ঘরের মতো ধ্বংস হবে আপনার অবৈধ টাকার পাহাড়।

লেখক: অধ্যাপক, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

প্রশ্নফাঁস: মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কোথায়?

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৪, ০৪:৪১ পিএম
আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২৪, ০৪:৪১ পিএম
প্রশ্নফাঁস: মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কোথায়?
তৌহিদ-উল বারী

পড়াশোনা মানে যেন লাভ-ক্ষতির ব্যবসা। এমনটাই পরিলক্ষিত হয়, যখন ক’টা টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন মিলে যায়। তাহলে তো আর কথা নেই। ব্যাস! এখন শুধু খাতায় গিয়ে লিখে দেওয়াটা বাকি। কি বা দরকার এত লেখাপড়া করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে। যেখানে টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন পাওয়া যায় আর পরে মিলে যায় লোভনীয় সার্টিফিকেট। এভাবেই যেন গেঁথে দেওয়া হয়েছে বর্তমান শিক্ষার্থী আর অভিভাবকের মাথায়। একটি স্বল্প শিক্ষিত মানুষ নামের কুচক্রী মহল তাদের এই প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ের মধ্য দিয়েই পড়াশোনাকে বানিয়ে ফেলেছে একটি লাভ-ক্ষতির ব্যবসা।

প্রশ্নফাঁস একটি সভ্য জাতির জন্য কলঙ্ক বয়ে আনে নিঃসন্দেহে। যা আমরা শুনে এসেছি নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ‘If you want to destroy a nation, first destroy it’s education’ যদি তুমি একটি জাতিকে ধ্বংস করতে চাও তাহলে প্রথমেই ওই জাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস কর।

এই উক্তি থেকে বোঝা যায়, এ যেন শত্রুপক্ষ বাঙালি জাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার এক মহোৎসবে মেতে ওঠেছে। একটি স্বল্পশিক্ষিত মহল যেন শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত করছে।

এসব স্বল্পশিক্ষিত মানুষের মাথায় বিন্দুমাত্র কাজ করে না, প্রশ্ন ফাঁসের কারণে জাতির কত বড় সর্বনাশ হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগী হচ্ছে না বরং এরা তার থেকে বিমুখ হচ্ছে। যে সমস্ত শিক্ষার্থীরা কোনোরকমে টেনেটুনে পাসের চিন্তা রাখে তাদের দলেই ধাবিত হচ্ছে মেধাবী শিক্ষার্থীরা। কারণ একটাই, এসব শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে পাশ করার চেষ্টা। যার প্রেক্ষিতে মেধাবীরা আজ পড়াশোনার প্রতি, মেধাচর্চার প্রতি বিমুখ হচ্ছে। 

কেমন জানি, প্রশ্নফাঁস করে অবৈধ টাকা কামানোর নেশায় নেমেছে সংঘবদ্ধ একাধিক চক্র। ফলে গত ছয় বছরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এসব চক্রের প্রায় তিন শতাধিক সদস্য। এর মধ্যে রয়েছে ডাক্তার, শিক্ষক, ছাত্র, বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের পরিচালকসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। কেউ কেউ একাধিকবার গ্রেপ্তার হলেও জামিনে মুক্ত হয়ে ফের একই অপরাধ করছে। বিচার কার্যক্রমের ধীরগতির সুবিধাও নিচ্ছে এসব চক্রের সদস্যরা।

তবে এত এত গ্রেপ্তারের পরও কেমন জানি এই প্রশ্নফাঁস ঠেকানোই যায় না। কোনো না কোনো ভাবে এসব প্রশ্ন ফাঁস হয়েই যায়। কেন বারবার এমনটা হচ্ছে? এর পিছনে কারা দায়ী? কিসের ঘাটতি রয়েছে এই কুচক্রী মহলকে ঠেকানোর পেছনে? নাকি এভাবেই চলতে থাকবে ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো। প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে, পরীক্ষা দেবে, অপরাধীও শনাক্ত হবে। কিন্তু বিচারের কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা থাকবে না। তাহলে এরকম হলে কেমন হবে মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবন? এটা নিয়ে কি আমরা মোটেও ভাবার বিষয় মনে করছি না! 

তবে আমরা এটা নিশ্চিত ভাবে জানি প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকার শাস্তি ন্যূনতম তিন বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। পাবলিক পরীক্ষার (অপরাধ) আইন, ১৯৮০ এবং সংশোধনী ১৯৯২-এর ৪ নম্বর ধারায় এই শাস্তির বিধান আছে। প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হওয়া অধিকাংশ আসামিদের অপরাধের শাস্তির রায় হয়নি। তাহলে কি এটাই হতে পারে একই ঘটনা পুনরাবৃত্তির কারণ? নাকি আরও কোনো অদৃশ্য কারণ রয়েছে এ প্রশ্নফাঁসের পেছনে। খতিয়ে দেখা হোক, চিরতরে বন্ধ হোক প্রশ্নফাঁসের এই দুর্নীতি-অনিয়ম। দিনশেষে মেধাবীরাই তাদের মেধার মেধার স্বাক্ষর রাখুক।

লেখক: শিক্ষার্থী ও কলামিস্ট 
[email protected]

মহুয়া পালায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র: সেকাল ও একাল

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৪, ০৪:৫৫ পিএম
আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৪, ০৪:৫৭ পিএম
মহুয়া পালায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র: সেকাল ও একাল
মো. রেজাউল করিম

‘মহুয়া’ পালা মৈমনসিংহ গীতিকার অন্যতম আলোচিত গীতিকাব্য। সাহিত্য সর্বদাই সমাজের ব্যক্তি-মানুষ ও সমাজের উপরিস্থিত ও অন্তস্থ আন্তসম্পর্কের বর্ণনাচিত্র। মৈমনসিংহ গীতিকায় কবিরা সরল লোকজ ভাষায় মানবজীবনের গান গেয়েছেন। চরিত্র-চিত্রণের নৈপুণ্যে নর-নারীর প্রেম অনুভূতির স্তর অতিক্রম করে স্পষ্ট বাস্তবতায় কাহিনিসমূহ অমরত্ব লাভ করেছে। মহুয়া পালা এমনই এক আখ্যানচিত্র যে পালা বা গাথায় বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র বিধৃত হলেও তা গোটা বাংলার, বিশেষত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র হিসেবেই গণ্য করা যায়। মহুয়া পালায় বর্ণীত আখ্যানের সমাজচিত্র পৌনে চার শ বছর পরও চলমান বঙ্গীয় সমাজে অনেকাংশেই বিদ্যমান বলে প্রতীয়মান হয়।

মৈমনসিংহ গীতিকার প্রায় সব কাব্যই মানব-মানবীর প্রেমাখ্যানের মনোস্তত্ত্বকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। মহুয়া পালাও তার ব্যতিক্রম নয়। এই পালার প্রধান দুই চরিত্র- নদের ছাঁদ ও মহুয়া সামাজিক অবস্থানের দুই মেরুতে অবস্থানকারী দুই যুবক-যুবতী। শুধু যে সামাজিক অবস্থান পৃথক তা-ই নয়, তাদের ধর্মও পৃথক। অথচ তারা একে অপরের প্রতি প্রেমাসক্ত হয়। প্রেম, পরিবার ও সমাজসৃষ্ট ঘাত-প্রতিঘাত, মানোস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, প্রেমের প্রতি অকুণ্ঠ প্রতিশ্রুতি ও ত্যাগ- ফলে পরিবার ও সমাজসৃষ্ট আরোপিত নিগ্রহ এবং আরোপতি নিগ্রহের বিরুদ্ধে মনোস্তাত্ত্বিক দ্বৈরথের আখ্যান এই পালার উপজীব্য। পরিশেষে যার সমাপ্তি ঘটে ট্র্যাজিক পরিণতির মধ্য দিয়ে। 

নদের চাঁদ ও মহুয়া পালার চিত্রায়ন শুরু হয় গারো পাহাড়ের ওপারে হিমানী পর্বতে, যা কিনা ছয় মাসের দূরত্ব।  হিমানী পর্বতের ওপারে ঘন জঙ্গল যেখানে চন্দ্র কিংবা সূর্যের আলো পৌঁছে না- এমন ঘন জঙ্গলে বাস করে ডাকাত সর্দার হুমরা, তার বাহ্যিক পেশা সাপুড়ে তথা বেদে- ডাকাত সর্দার হুমরা ‘হুমরা বাইদ্যা’ নামেই পরিচিত। ষোলো বছর আগের ঘটনা- হুমরা বাইদ্যা কাঞ্চনপুর গ্রামের এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে ডাকাতি শেষে অপরূপ রূপ-মাধুর্যের অধিকারী ছয় মাসের এক কন্যাকে দেখে চুরি করে নিয়ে আসে। এই ঘটনা শুধু যে তৎকালীন সমাজচিত্র তা-ই নয়, পৌনে চার শ বছর পরও বর্তমান বেদে জনগোষ্ঠী কর্তৃক শিশু, বিশেষত শিশুকন্যা চুরির কথা শোনা যায়। 

চুরি করে আনা শিশুকন্য মহুয়া অন্তজ বেদে সমাজে বেড়ে উঠতে থাকে আরও দশটি মেয়ের মতো। সাপের খেলা, নাটকীয় সংলাপ, নদী থেকে জল আনা, এমনকি ঘোড়ায় চড়া- সব কাজেই সে পারদর্শী হয়ে ওঠে। ভাগ্য অন্বেষণে নদী, জলাশয়, পাহাড় অথবা গ্রামীণ লোকালয়ে মৌসুমভেদে ঘুরে বেড়ায় তারই পালক-পিতা বেদেসমাজের দলপতির সঙ্গে। যাযাবর শ্রেণির বেদেসমাজ দলপতির ‘বৈদেশেতে’ যেত- সেই পর্বের বর্ণনা পাওয়া যায় পালায় এভাবে: ‘ঘোড়া লইল গাধা লইল, কত কইবো আর- সঙ্গেতে করিয়া লইল রাও চণ্ডালের হাড়- শিকারি কুকুর লইল শিয়াল হেজে ধরে- মনের সুখেতে চলে বৈদেশ নগরে।’ উপরিউক্ত স্তবক থেকে জীবিকার সন্ধানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেদে সমাজের পরিভ্রমণের চিত্র জানা যায়, যা এখনো বিরাজমান। তবে বর্ণনায় আতিশয়োক্তি রয়েছে বলে মনে হয়। একই নৌকায় কুকুর আর শেয়াল বহনের ঘটনা বর্ণনার আতিশয়োক্তি বলেই প্রতীয়মান হয়।

এই স্তবকে সনাতন বাঙালি সমাজের আতিথেয়তার প্রমাণও পুরিস্ফুট। জমিদারের নায়েব প্রথম দর্শনেই মহুয়ার প্রেমে পড়ে। মহুয়াও তার প্রতি সমভাবে আকৃষ্ট হয়। সে নিজেদের আলয়ে নদেরকে নিমন্ত্রণ জানায়, যা পালায় এভাবে বর্ণীত হয়েছে: ‘আমার বাড়িত যাইওরে বন্ধু বইতে দিয়াম পিরা- জল পান করিতে দিয়াম সালি ধানের চিরা- সালি ধানের চিরা দিয়াম আরও সবরি কলা- ঘরে আছে মইষের দইরে বন্ধু খাইবা তিনো বেলা।’ পালার এই স্তবক এ দেশের সনাতন সমাজের লোকজ খাদ্য দিয়ে হাজার বছরের আতিথেয়তা প্রকাশ করে, যা আজও গ্রামীণ সমাজে বিদ্যমান।

তৎকালীন বেদে সমাজের নারীরা তাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বিষ অথবা ধারালো অস্ত্র সঙ্গে রাখত। পালার বিভিন্ন পর্বে তার বিবরণ পাওয়ায়। এ ছাড়া বিষের বিশেষ ব্যবহার লক্ষ্যণীয়, যা বেদে সমাজে সে-সময়ে ছিল, এখনো আছে এমন তথ্য প্রমাণিত। এই পালায় তক্ষকের বিষ অস্ত্র হিসেবে বিবৃত হয়েছে যখন মহুয়া তাকে অপহরণকারী সওদাগরের মাঝি-মাল্লাদের বানিয়ে দেওয়া পানের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেয়। এখানে দুটি দৃশ্যকল্প অবলোকন করা যায়। প্রথমত, বেদেকন্যা নিজের কাছে গোপনে বিষ রাখত। দ্বিতীয়ত, তারা সেই যুগে, এমনকি বর্তমানেও কথার জাদুতে মানুষকে মোহাবিষ্ট করতে পারে। তাই তো দেখা যায়- যারা তাকে অপহরণ করেছে, তার নাটকীয় কথার মাধুর্যে মোহাবিষ্ট হয়ে তারই সাজিয়ে দেওয়া পান খেয়ে সবাই অচেতন হয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, বেদে সমাজে বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়া মাত্রই বিশেষত নারীরা পান খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, যা এখনো বিদ্যমান। 

গোটা পালা নিবিড় অধ্যয়ন করলে দেখা যায় যে, এই পালার পরতে পরতে ফুটে উঠেছে তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজচিত্র, যা পৌনে চার শ বছর পর আজও শুধু বেদে সমাজ নয়, বাংলার গ্রামীণ সমাজে বিদ্যমান। রক্ষণশীল সমাজের বেদেকন্যা মহুয়া সুন্দরী ও জমিদারের দেওয়ান সুদর্শন পুরুষ নদের চাঁদের ভালোবাসায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভিন্ন ধর্ম এবং বিবাহ তথা সম্প্রদানের ব্যাপারে অভিভাবকের সিদ্ধান্তের প্রাধান্য। সে-যুগেও অভিভাবকের সিদ্ধান্তের বাইরে যুবক-যুবতী প্রণয়াসক্ত হতো, যা এই পালায় বিবৃত হয়েছে। তবে কোনো বাধাই দুজনের মধ্যে আত্মিক দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত দুজনে আত্মাহুতির মাধ্যমে প্রমাণ করেছে ভালোবাসা শাশ্বত। এমন চিত্র বাংলার গ্রামীণ সমাজই শুধু নয়, শহুরে সমাজেও এখন কদাচিৎ হলেও জানা যায়।  

হুমরা বাইদ্যা নদের চাঁদের প্রতি তার আদরের পালিত কন্যা মহুয়ার আসক্তি টের পেয়ে যায়। এই পর্যায়ে দেখা যায়, হুমরা বাইদ্যা ভাবে- কিছুদিনের মধ্যেই দেশের বাড়ির জমিতে ফসল উঠবে; ফসল তোলার টান, বাড়ির পুকুরের মাছ ধরার মৌসুম, অন্যদিকে ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে মহুয়ার গোপন প্রণয়ের আশঙ্কা- তাকে কিছু একটা করতেই হবে। বেদে দলে মহুয়ার সখা পালঙ্ক হুমরা বাইদ্যার নিষ্ঠুরতার আশঙ্কায় মহুয়াকে পরামর্শ দেয় এক সপ্তাহ বাইরে বের না হওয়ার জন্য। ঠাকুরবাড়িতে সে পৌঁছে দেবে মহুয়ার মৃত্যুর খবর। মহুয়া রাজি হয় না, উল্টো ঠাকুরবাড়ির পানে চেয়ে চন্দ্র-সূর্য আর পালঙ্ক সখাকে সাক্ষী মেনে নদের চাঁদকে স্বামী বলে ঘোষণা করে। পালঙ্ককে বলে সে নদের চাঁদকে নিয়ে পালিয়ে যাবে, অন্যথায় বিষপানে আত্মহত্যা করবে। হুমরা বেদে মহুয়ার অজান্তে দলবল নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ করে দলের অন্যদের সঙ্গে। হুমরা বাইদ্যা নদের চাঁদকে তক্ষকের বিষ প্রয়োগে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। সে মহুয়ার হাতে বিষলক্ষার ছুরি দিয়ে নদের চাঁদকে হত্যা করতে বললে মহুয়া নদের চাঁদকে ঘোড়ায় তুলে নিয়ে পালিয়ে যায়। পালায় যা বলা হয়েছে: ‘আরে করে ঝিলিমিলি নদীর কূলে দিয়া, দুজনে চলিল ভালা ঘোড়া সুয়ার হইয়া’। 

ধর্মীয় বিশ্বাস, বাদ-মতবাদ গীতিকা-রচয়িতাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আচ্ছন্ন করেনি। জীবনবিরোধী সবকিছুই অস্বীকৃত হয়েছে এ কাব্যমালায়। মৈমনসিংহ গীতিকায় মূলত মুক্ত প্রেমের জয়গান বিবৃত হয়েছে। এ গীতিকার নারীরা ধর্মীয় কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করেছে কখনো বা অভিভাবকের অভিমতের বিরুদ্ধেও জীবনসাথী বেছে নেওয়ার লক্ষ্যে ঝুঁকি নিয়েছে, গৃহত্যাগ করেছে। এটা কোনোকালেই অলৌকিক, অসম্ভব বা অবাস্তব ছিল না। যে কারণে বলা যায়, মৈমনসিংহ গীতিকায় নারীর শক্তি, উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক মূল্যবোধের জয়গান বিবৃত হয়েছে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক
[email protected]