অন্তর্বর্তী সরকার এমন একসময় দায়িত্ব নিয়েছে, যখন দেশের অর্থনীতি গভীর সংকটে। আড়াই বছর ধরে অর্থনীতি চাপের মুখে রয়েছে।
ডলারসংকটে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩০ শতাংশের বেশি। দুই বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষের জীবনযাত্রাকে অসহনীয় করে তুলেছে। খেলাপি ঋণ বেড়েছে লাফিয়ে। এসব সমস্যা অনেক দিন ধরেই বিষফোঁড়ার মতো হয়ে আছে।
এমন বাস্তবতায় একটি ভঙ্গুর অর্থনীতি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে এই সরকার। বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া বর্তমান সরকারের প্রধান কাজ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
এরই মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার। ড. ইউনূসের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, সব খাতেই সংস্কার আনা হচ্ছে। টাকা ও ডলারের বিপরীতে পলিসি রেট বা নীতি সুদহার (যে রেটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধার দেয় বাণিজ্যিক ব্যাংককে) বাড়ানো হয়েছে।
অন্যদিকে ব্যাংক খাতের জন্য কঠোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে একটি কমিশন গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে সহায়তা চাওয়া হয়েছে। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি ৯০ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে। শ্বেতপত্রে ছয়টি বিষয় থাকবে। এগুলো হচ্ছে সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা, মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা, বাহ্যিক ভারসাম্য, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, বেসরকারি বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান।
কমিটি গঠনের পর ড. দেবপ্রিয় সম্প্রতি রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের পরিকল্পনা কমিশনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, শ্বেতপত্রে অর্থনীতির অনিয়মগুলো তুলে ধরা হবে। অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা আনতে নীতি প্রণয়ন করা হবে। চ্যালেঞ্জ বা সমস্যা চিহ্নিত করে তা মোকাবিলায় সুপারিশ করা হবে। এতে এমন বিষয় তুলে ধরা হবে, যাতে এই সরকারের সংস্কারের কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
যোগাযোগ করা হলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘এক মাসের মধ্যে প্রথম সপ্তাহে শূন্যতার মধ্য দিয়ে গেছে আর্থিক খাত। কাজেই মূল্যায়ন যদি করতে হয় তার পর থেকে করতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে শূন্যতা এখনো পূরণ হয়নি। তবে প্রথম যে কাজ ছিল এই সরকারের, তা হলো গভর্নর নিয়োগ দেওয়া, ডেপুটি গভর্নর খুঁজে বের করা, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মাথা ঠিক করা, এসব কাজ ঠিকমতো করতে পেরেছে। কাজেই আমি বলব, আর্থিক খাতে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল সেটি তারা (বর্তমান সরকার) বন্ধ করতে পেরেছে সফলভাবেই।’
তিনি বলেন, ‘আরও অনেক কিছু পরিবর্তন করতে হবে। তবে এগুলো রাতারাতি করা যাবে না। সময় লাগবে। কিছু দুর্বল আইন রয়েছে। সেগুলো সবল করতে হবে। আমি মনে করি, রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য যেসব উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল, সেগুলো এ সময়ে নেওয়া হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, সেটি পূরণ করতে পেরেছে অন্তর্বর্তী সরকার। আমি মনে করি, এটি একটি বড় অর্জন।’
আধুনিক আর্থিক ব্যবস্থাপনায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতিকে কার্যকরভাবে ব্যবহারের বিকল্প কোনো নীতি এখনো কেউ দিতে পারেননি। এ কারণেই দুই বছর ধরে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ মূল্যস্ফীতি কমাতে মুদ্রানীতিকে আগ্রাসীভাবে ব্যবহার করে সফল হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক এখানে কোনো পরিবর্তন আনেনি। সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার শেষ সময়ে এসে মুদ্রানীতিতে বদল এনে নীতি সুদহার কিছুটা বাড়িয়েছিলেন ঠিকই। তবে তা আইএমএফের শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে। অনেক দেরিতে নেওয়া এসব সিদ্ধান্তে মূল্যস্ফীতি আদৌ কমেনি; বরং বেড়েছে।
এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। মূল্যস্ফীতিই যে অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ, সে কথা অকপটে স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তাই তিনি দায়িত্ব নিয়ে প্রথমেই পলিসি রেট বা সুদহার বাড়িয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রেপো হার ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। এর ফলে বাড়বে ঋণ করার খরচ। যদিও আমানতকারীরাও এর ফলে লাভবান হবেন। তারা গচ্ছিত অর্থে আগের চেয়ে বেশি মুনাফা পাবেন- এটা আশা করা যায়। নীতি সুদহার বাড়ানোর মূল উদ্দেশ্য বেড়ে চলা মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা। সরকারি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ১৩ বছরের বেশি সময় পরে জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘর ছাড়িয়েছে- ১২ শতাংশের অনেকটা কাছে পৌঁছে গেছে।
অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করেন। সেখানে তিনি বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উৎপাদন ও সরবরাহব্যবস্থাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। তবে তিনি এও বলেন, মূল্যস্ফীতি চট জলদি কমানো সম্ভব নয়। একটু সময় লাগবে। আগামী ছয়-সাত মাসের মধ্যে এটি সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে ডলারের দাম ১২০ টাকার বেশি না দেওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছেন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের কোষাগারপ্রধানরা। সম্প্রতি দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বা কোষাগারপ্রধানদের এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। এর ফলে প্রবাসী আয় আরও বাড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত এক মাসের মধ্যে বড় পরিবর্তন বা সংস্কার হয়েছে ব্যাংকিং খাতে। ইসলামি ধারার মূল ব্যাংকগুলোকে পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন নতুন গভর্নর ড. মনসুর। বেসরকারি কিছু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন মুখ এনেছেন। ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে দীর্ঘ মেয়াদে সংস্কারের একটি রোডম্যাপ তৈরির কথা বলেন তিনি।
আর্থিক খাতে নীতি সংস্কারের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ পদে যোগ্য, দক্ষ ও পেশাদার লোকদের বসিয়েছে সরকার। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শীর্ষ পদে পেশাদার কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ-প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। সরকার আশা করছে, এসব প্রতিষ্ঠানে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার ফলে কাজ গতিশীল হবে। বাড়বে সেবার মান। উপকৃত হবেন জনগণ।