বাংলাদেশের অন্যতম পুরাতন দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাকের প্রথম নারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করাটা আমাদের জন্য একই সঙ্গে গর্বের ও চ্যালেঞ্জের। সাংবাদিকতা তো আমার সাবজেক্ট ছিল না। তবে ছোটবেলা থেকে আমাদের বাড়িতে পূর্বদেশ এবং অবজারভার রাখা হতো। আমার জন্ম পঞ্চশের দশকে। বিয়ে হয় ষাটের দশকের শেষে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ইত্তেফাকের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। বহু বছর আগে আমেরিকার এক সাংবাদিক মঞ্জুকে প্রশ্ন করেছিলেন, সম্পাদক হওয়ার কী অভিজ্ঞতা তার আছে? মঞ্জু উত্তরে বলেছিল, ‘আমার জন্মই হয়েছে সংবাদপত্রের মেশিনের নিচে।’
আমার অবস্থাও অনেকটা তা-ই। গত ৫৫ বছর ধরে আমি ইত্তেফাকের অন্দরে অলিন্দে নিলয়ে অন্তরযাপন করেছি। ইত্তেফাকে এত বড় দায়িত্ব নেওয়ার আগে প্রায় তিন যুগের অভিজ্ঞতা ছিল পাক্ষিক অনন্যায় সম্পাদক হিসেবে কাজ করার। আর দশটা বাঙালি মধ্যবিত্তের পরিবারের মানুষ হয়ে আশির দশকে ‘অনন্যা’ নামে আমি নিজে একটি কাগজ বের করেছিলাম। এখন এর অনলাইন ভার্সন চলমান। আজকে আমি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা ইত্তেফাকের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি, তাও দেখতে দেখতে প্রায় এক যুগ হয়ে গেল। সম্পাদক হিসেবে পত্রিকার প্রশাসনের দিকটি দেখার পাশাপাশি সংবাদ বা লেখা এডিটের কলাকৌশল ক্রমশ আত্মস্থ করে নিতে চেষ্টা করেছি। কোন সংবাদটা লিড হতে পারে, কেমন হতে পারে তার মেকআপ কিংবা শিরোনাম- সেগুলো আমি বিবেচনা করি পাঠকের চোখ দিয়ে। একদম স্কুলজীবন থেকে পারিবারিকভাবে আমার পাঠাভ্যাস ছিল। আমার সৌভাগ্য যে, জীবনের এই রকেটব্যস্ত সময়ে এসেও সেই পাঠাভ্যাস আমি নষ্ট হতে দিইনি। আমার পছন্দসই সব ধরনের বই-পত্রপত্রিকা পড়ি- যা আমাকে চিন্তার অক্সিজেন দেয়, ভালো লেখা মন্দ লেখা বোঝার শক্তি দেয়। সে কারণে আমার মনে হয়, বই পড়ার বিকল্প নেই।
সম্প্রতি দেশে একটি ঐতিহাসিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। এটা একটা অন্য রকমের পরিবর্তন। এটা একটা নতুন জেনারেশনের রেভুলেশন। এই জেনারেশনকে জেন-জি বলা হয়, আর আমি যে জেনারেশনের মানুষ সেটাকে বলা হয় ‘বেবি বুমারস’ জেনারেশন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে শিশুজন্মের হার খুব বেড়ে গিয়েছিল, আমি সেই প্রজন্মের। আমার আগের প্রজন্ম ছিল সাইলেন্ট জেনারেশন। আমার স্বামী এই প্রজন্মের। আর আমার পরের তিনটি জেনারেশন এক্স, ওয়াই এবং জেড- এই তিনটি জেনারেশনেরই কোনো না কোনো প্রতিনিধি আমার পরিবারের মধ্যে রয়েছে। আমার চার মেয়ে এবং নয় নাতিনাতনি- এরা পর্যায়ক্রমে এক্স, ওয়াই এবং জেড জেনারেশনের প্রতিনিধি। ফলে আমাকে সব জেনারেশনের সঙ্গেই চলাফেরা করতে হয়। আর তাতে করে প্রতিটি জেনারেশনের মানুষের বৈশিষ্ট্যগুলো আমি বুঝতে পারি বা বুঝতে চেষ্টা করি। আমার বেশির ভাগ নাতিনাতনি জেন-জির প্রতিনিধি। আমার যেসব বন্ধুস্বজন আছে, তাদের নাতিনাতনিদেরও দেখি। এদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে চেষ্টা করি ভেতর ও বাহির থেকে। এরা সেই জেনারেশন, যারা প্রযুক্তি আর অবাধ তথ্যপ্রবাহের ভেতরে নিজেদের বিকশিত করার সুযোগ পেয়েছে। এদের সঙ্গে আমি যখন কথা বলি তখন বুঝতে পারি প্রত্যেকেরই ভিন্ন রকম ভাবনা বা ভিউজ আছে। এদের ভাবনা বা মতামতটা আলাদা, দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটা আলাদা, কথা বলার ধরনও আলাদা। আমাদের সময় বয়োজ্যেষ্ঠদের যেভাবে সম্মান ও সমীহ করতাম, আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে এর অভাব দেখতে পাই। কারণ হিসেবে আমার মনে হয়, এই ছোট্ট দেশটিতে যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার তুলনায় আমাদের শিক্ষার মান বৃদ্ধি পায়নি। হয়তো অ্যাকাডেমিক ডিগ্রি অনেকেরই আছে, কিন্তু অনেকেরই পারিবারিকভাবে শিক্ষাচর্চার অভাব প্রকট বলে মনে হয়েছে। আমি যদি আমার দাদি বা মায়ের কথা বলি, যিনি সেই সময় মাত্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন কিন্তু বাড়িতে সমসময় বিদ্যাচর্চা করতেন, বিভিন্ন ধরনের বইপত্র পড়তেন। সেই সময়কার এমন অনেক নারী আছেন, যারা স্কুলে না গিয়েও বাড়িতে বসেই লেখাপড়া শিখেছেন, এমনকি লেখালেখিরও চর্চা করেছেন। কিন্তু সেখানে আজকালকার নারীর মধ্যে, বিশেষ করে উচ্চবিত্তের নারীদের মধ্যে প্রতিনিয়ত বিদ্যাচর্চা ও সাংস্কৃতিক চর্চার অভাব দেখতে পাই। হয়তো তারা শহরের নামি স্কুলে পড়ালেখা করেছেন কিন্তু অ্যাকাডেমিক শিক্ষা-পরবর্তী পাঠাভ্যাস নেই বললেই চলে। সংবাদপত্রকে বলা হয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। কিন্তু মানুষের যদি পাঠের অভ্যাস কমে যায়, তাহলে সেই মানুষটি সচেতন হবেন কী করে? মানুষের হাতে এখন খুব কম সময়।
এই সময়ে অনেকের জীবনের চাওয়াটা কিংবা আকাঙ্ক্ষাটা এত বেশি বেড়ে যাচ্ছে, যেটা হয়তো কয়েক যুগ আগে কল্পনাও করা যেত না। তার কারণটাও মনস্তাত্ত্বিক। মোবাইল ফোনের ভেতরে বিভিন্ন জিনিস দেখতে দেখতে আমাদের বাসনা ও আকাঙ্ক্ষা বেড়ে যায়। আকাঙ্ক্ষা খারাপ কিছু নয়। কিন্তু সেটা যদি আমাদের যোগ্যতা ও সীমার মধ্যে না হয়, তখন বিপত্তি বাধে। কারণ, আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য কেউ ঠিক পথে যান, কেউ বেপথে যান। বেপথে গিয়ে যারা আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেন, তারা বেপথে পা রাখার জন্যই ভবিষ্যতে বিপদে পড়েন। অন্যদিকে যাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়, তারা হয়ে পড়েন অসুখী এবং হতাশাগ্রস্ত। দেখা যাচ্ছে, সত্য বলা, কোনো কিছু অর্জনের জন্য পরিশ্রম করা এবং একজন ব্যক্তি যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুর মধ্যে থাকার যে প্রাজ্ঞবোধ, তা আমাদের মধ্যে কমে যাচ্ছে। এই সমস্যাটা সব শ্রেণির মধ্যেই প্রকট হয়ে উঠছে। এখন বাড়ির পরিচারকরাও নতুন একটা স্মার্ট ফোন পেতে চান। বিগত সরকার থেকে বলা হয়, স্মার্ট বাংলাদেশ বানানো হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ মানে তো সবার হাতে স্মার্ট ফোন নয়। স্মার্ট জাতি করতে প্রয়োজন প্রকৃত-শিক্ষা এবং তার সঙ্গে পারিবারিক শিক্ষা এবং নিজের বিবেকের শিক্ষা। একই সঙ্গে নিজের সুচিন্তার বিস্তৃতি এবং সেই সুচিন্তা কত সুদূরপ্রসারি হতে পারে- তার স্বপ্ন বুনন করা। এভাবে আমাদের দেশে কজন মানুষ অনুধাবন করেন? দুঃখজনকভাবে এখানেই আমাদের যত বিপত্তি।
এখন প্রায় সব শ্রেণির মধ্যেই বাড়িতে পত্রিকা রাখার চল কমে যাচ্ছে। কেউ আর এখন আট-দশ বা বারো টাকা দিয়ে সংবাদপত্র কিনে পড়তে চান না। তারা এখন ঘন ঘন ফেসবুক স্ক্রল করেন এবং সেখান থেকে সংবাদের উপাত্ত খুঁজে নিতে চান। নিশ্চয়ই কিছু সত্য খবর থাকে, কিন্তু আজকাল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ফেসবুক একটা গুজবের খনি। কিন্তু কোনটা গুজব আর কোনটা বাস্তবতাবিবর্জিত- সেটা বাছাই করার যোগ্যতাও বেশির ভাগ ফেসবুক-ব্যবহারকারীর নেই। এসব সংবাদ যারা পড়েন, তারা যেন এসব অবাস্তব ও গুজবের মধ্যেই এক ধরনের মনোরঞ্জন খুঁজে পান। আমার তো মনে হয় বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র কয়েক কোটি মানুষ বাস্তবতা বুঝতে পারেন, বাকিদের বুঝতে পারার ক্ষমতাও সীমিত।
আমার একটা সুবিধা হলো, আমি বাংলাদেশের সব শ্রেণির মধ্যেই চলতে-ফিরতে পারি, মিশতে পারি। আমার বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের যেসব চাকরিজীবী রয়েছেন, তাদের কথা যেমন আমি শুনি, তেমনি আমার সাধারণ ঘরের এবং উচ্চবিত্ত ঘরের কিছু বন্ধুবান্ধব রয়েছে, তাদের কথাও শুনি। আমি দেখেছি, আমাদের শ্রেণিবৃত্তের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে চিন্তাভাবনা এবং মতাদর্শগত বিপুল পাথর্ক্য রয়েছে। এই যে বৈষম্যবিরোধী এত বড় একটা আন্দোলন হয়ে গেল, এত মানুষ মারা গেল, এটা নিয়েও উপলব্ধিগত জায়গায় অনেক পাথর্ক্য রয়েছে। এটাকে বলা যায় ভাবনার জগতের বৈষম্য।
এই বৈষম্যটাকে দূর করতে হলে কী করা যায়? এ ব্যাপারে খুব বেশি ভাবনাচিন্তা আছে বলে আমার মনে হয় না। ইত্তেফাক পরিবারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর গত অর্ধশতকে যতগুলো পরিবর্তন দেখেছি, আমার কাছে এবারের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর মনে হয়েছে, দেশটাকে নতুন করে কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার এক অপূর্ব মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। মানুষ চায় একটি নিরাপদ নিরুপদ্রব শান্তিপূর্ণ জীবন। মানুষ এই সভ্যতা, রাষ্ট্র, সমাজ গঠন করেছে ভয়ভীতিশূন্য, নিরাপদ ও স্বস্তিময় জীবনযাপনের জন্য। আমাদের এখন সময় এসেছে তেমনই একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র গঠন করার। আমি কামনা করি, আমাদের বিভিন্ন স্তরে বিদ্যমান ভাবনার দৈন্য ও বৈষম্য দূর হোক। জয় হোক নতুন বাংলাদেশের।
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক