গত দুই বছর থেকে ডিম ও মুরগির বাজার অস্থির হলে মামলা করে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। তার পরও বাজার ঠেকানো যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে সরকার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। এতে দাম কিছুটা কমে ১৪২ টাকা ডজনে বিক্রি হচ্ছে ডিম। কিন্তু মুরগির দাম এখনো বাড়তি।
বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখনো ভোক্তাদের নির্ধারিত দর ১৮০ টাকার ব্রয়লার ২০০-২১০ টাকা ও ২৭০ টাকার সোনালি মুরগি ৩০০-৩৩০ টাকা কেজি কিনতে হচ্ছে। তবে খামারিরা বলছেন, সরকার রাজধানীর ২০টি বাজারে মুরগি বিক্রি করতে জায়গা দিলে খুচরা পর্যায়ে নির্ধারিত দরে মুরগি বিক্রি করা সম্ভব। এতে ভোক্তারা কম দরে পাবেন মুরগি, স্থিতিশীল হবে বাজার। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
গত দুই বছর থেকে জুলাই মাস এলেই ডিম ও মুরগির বাজার অস্থির হয়ে যাচ্ছে। কমতে চায় না দাম। কারসাজি করার অভিযোগে কাজী ফার্মসসহ বিভিন্ন কোম্পানির বিরুদ্ধে ২০২২ সাল এমনকি গত বছরও বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন মামলা করে। এ বছরেও একই দশা। বেড়েই যাচ্ছে ডিম ও মুরগির দাম। বাধ্য হয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গত ১৫ সেপ্টেম্বর ফার্মের মুরগির ডিম, ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ রেয়াজুল হকের স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর পোলট্রি খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের মতামতের ভিত্তিতে ২০২৪ সালের জন্য ডিম ও মুরগির ‘যৌক্তিক মূল্য’ নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন দর অনুসারে, খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম রাখা হবে ১১ টাকা ৮৭ পয়সা বা প্রতি ডজন ১৪২ টাকা ৪৪ পয়সা। উৎপাদন পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম পড়বে ১০ টাকা ৫৮ পয়সা, পাইকারিতে হবে ১১ টাকা শূন্য ১ পয়সা।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের চিঠিতে আরও বলা হয়, প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি খুচরা পর্যায়ে ১৭৯ টাকা ৫৯ পয়সা দরে বিক্রি করা হবে। উৎপাদন পর্যায়ে ১৬৮ টাকা ৯১ পয়সা ও পাইকারি পর্যায়ে ১৭২ টাকা ৬১ পয়সা দরে বিক্রি হবে। অন্যদিকে সোনালি মুরগি উৎপাদন পর্যায়ে ২৬০ টাকা ৭৮ পয়সা ও পাইকারিতে ২৬৪ টাকা ৫৭ পয়সা কেজি ও খুচরা পর্যায়ে ২৬৯ টাকা ৬৪ পয়সা দরে বিক্রি হবে।
পোলট্রি খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঠানো ওই চিঠিতে চলতি ২০২৪ সালের জন্য মুরগি (সোনালি ও ব্রয়লার) এবং ডিমের নির্ধারিত যৌক্তিক মূল্য সঠিকভাবে বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে।
তার পরও ডিমের দাম না কমায় ভোক্তা অধিদপ্তরের অনুরোধে করপোরেট প্রতিষ্ঠান দিনে ১০ লাখ করে কাপ্তান বাজার ও তেজগাঁও বাজারে ২০ লাখ ডিম সরবরাহ করলে পাইকারি বিক্রেতারা নির্ধারিত দরে ১৩২ টাকা ডজন বিক্রি করছে। এ জন্য খুচরা বাজারেও আগের চেয়ে দাম কমেছে। নির্ধারিত দরের কাছাকাছা ১৪৫-১৫০ টাকা ডজনে নেমেছে।
কিন্তু এখনো বেশি দামে ভোক্তাদের মুরগি কিনতে হচ্ছে। কারণ খামারেই দাম বেশি। পাইকারি বিক্রেতাদের নির্ধারিত ১৬৯ টাকা দরের মুরগি এখনো বেশি দামে ১৭৫ টাকা পর্যন্ত কেজি কিনতে হচ্ছে। এর সঙ্গে পরিবহন ভাড়া ও ওয়েট লসও রয়েছে কেজিতে ১৫-১৭ টাকা। অর্থাৎ পাইকারি বিক্রেতারা ১৯০ টাকার কম ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করতে পারছে না। এ জন্য খুচরা বাজারেও বেশি। বিভিন্ন বাজারের খুচরা বিক্রেতারা বলেন, ‘২০০-২১০ টাকা কেজি। খুচরা পর্যায়ে সোনালি মুরগির দামও বেশি। বিভিন্ন বাজারে ৩০০-৩৩০ টাকা পর্যন্ত কেজি বিক্রি করা হচ্ছে।’
মুরগির বাজারে অস্থিরতার ব্যাপারে মোহাম্মদপুরের টাউন হল বাজারের ব্রয়লার হাউসের স্বত্বাধিকারী মো. বিল্লাল হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমানে খুচরা পর্যায়ে ব্রয়লার ২০০ টাকা ও সোনালি মুরগি ৩০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। তবে হাতিরপুলসহ অন্য বাজারের খুচরা বিক্রেতারা বলেন, ব্রয়লার ২১০ টাকা ও সোনালি ৩২০-৩৩০ টাকা কেজি।
মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘মুরগির বাচ্চা ও খাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় উৎপাদন খরচ বেশি। কাজেই করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে এ ক্ষেত্রে দাম কমাতে হবে। তাহলে খামারিরা কম দামে ডিম ও মুরগি বিক্রি করতে পারবেন। এটা কার্যকর হলে ভোক্তারাও নির্ধারিত দরে খেতে পারবেন। এ ছাড়া করপোরেট ও প্রান্তিক খামারিরা সরাসরি আমাদের কাছে মুরগি বিক্রি করলে দাম কমবেই। কারণ মাঝপথে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী থাকবে না। তিন-চার হাতবদল হবে না। এভাবে তারা আমাদের মুরগি দিলে পাইকারিতে ৪-৬ টাকা ও খুচরায় ১৫ টাকা লাভ থাকবে।’
এ ব্যাপারে নাজিফা পোলট্রি ফার্মের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘মুরগির বাচ্চা ও খাদ্যের দাম বেশি নিচ্ছে করপোরেটরা। এ জন্য উৎপাদন খরচ বেশি। বর্তমানে ব্রয়লারের উৎপাদন খরচ পড়ছে কেজিতে ১৫৫-১৭০ টাকা। এটা কয়েক হাতবদল, পরিবহন খরচ ও ওয়েট লসের কারণে খুচরা বিক্রেতার কাছে যেতে ২০ টাকা খরচ আছে। তারা কেজিতে ১০ টাকা লাভ করবে। সব মিলে ভোক্তা পর্যায়ে ২০০ টাকা কেজি, এটা যৌক্তিক দাম বলা যায়। আর সোনালি মুরগির উৎপাদন খরচ ২২০-২৪০ টাকা। সব মিলে কেজিতে বাড়তি ২০ টাকা খরচ আছে। খুচরা বিক্রেতারা ১০-১৫ টাকা লাভ করবে। এ জন্য ২৮০ টাকা হতে পারে। কিন্তু ৩০০ টাকা কেজি ভোক্তাদের কিনতে হচ্ছে। এটা বেশি।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে এই খামারি বলেন, ‘প্রান্তিক খামারিরা চাহিদার ৮০ শতাংশ ডিম ও মুরগি উৎপাদন করলেও কৌশল করে করপোরেটরা বাজারটা নিয়ন্ত্রণ করছে। এ জন্য বাজার অস্থির হয়ে থাকছে। সরকার আমাদের কারওয়ান বাজার, শান্তিনগর, মোহাম্মদপুরসহ ১৫-২০টি বাজারে মুরগি বিক্রির সুযোগ দিলে খুচরা পর্যায়ে ব্রয়লার ১৮০ টাকা কেজি ও সোনালি মুরগি ২৭০ টাকা নির্ধারিত দরে মুরগি বিক্রি করা সম্ভব। এতে বাজার অস্থির হবে না। স্থিতিশীলতা আসবে। কারণ আমরা প্রাপ্তিক খামারিরা ৮০ শতাংশ ডিম ও মুরগি উৎপাদন করছি। খুচরা বিক্রেতারা সরাসরি আমাদের কাছ থেকে মুরগি কিনতে পারবেন।’
খুচরা বিক্রেতা ও খামারিদের অভিযোগের ব্যাপারে ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ সভাপতি মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ডলারের কারণে খাদ্যের দাম বেশি। এ জন্য উৎপাদন খরচ বেশি। তাই ব্রয়লার মুরগির কেজি ২০০ টাকার বেশি নয় ‘সরকার তো খুচরা পর্যায়ে ব্রয়লার ১৮০ ও সোনালি ২৭০ টাকা কেজি নির্ধারণ করে দিয়েছে।’ এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এই রেট অনেক আগের। সরকার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে দেরিতে প্রকাশ করা হয়েছে। এটা পর্যালোচনা করে নতুন দর নির্ধারণ করা দরকার।’
ডিমের মতো বাজারে মুরগি সরবরাহ করার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘ফার্ম থেকে ডিম বাজারে পৌঁছা যতটা সহজ মুরগি অত সহজ না। আমাদের ভ্যান তেমন নেই। তবে সরকার উদ্যোগ নিলে প্রসেসিং করা মুরগি বাজারে বিক্রি করা সম্ভব। বিশ্বে এটা হচ্ছে। আমাদের দেশে স্বপ্ন, আগোরা শপিং শপে শুরু করেছে। তাহলে কম দামে ভোক্তারা মুরগির মাংস খেতে পাবেন।’