
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা এখনো অনেকটাই অবহেলিত। উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। এ ছাড়া ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এর পরও তৃণমূল পর্যায়ের জনগণ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। এখন বেশির ভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৫০ শয্যার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ৪৯৫টি উপজেলার মধ্যে ৪৩২টিতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। এগুলো ৩১, ৫০ ও ১০০ শয্যার। ৩১ শয্যার রয়েছে ১৩টি, ৫০ শয্যার ৩৯৯টি এবং ১০০ শয্যার ১৯টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। শয্যা বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই তুলনায় বাড়েনি স্বাস্থ্যসেবার মান।
খবরের কাগজের সরেজমিন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলার স্বাস্থ্যসেবা-সংকটের নানা তথ্য। রোগীরা হাসপাতালের বারান্দায় ছটফট করলেও দেখা মেলে না চিকিৎসকের। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের খোলা স্থানে চিকিৎসাবর্জ্য ফেলার কারণে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ এবং ছড়াচ্ছে জীবাণু। অনেক সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে যায়। নির্ধারিত ডাস্টবিন থাকলেও তার পাশেই খোলা স্থানে ফেলা হচ্ছে চিকিৎসাবর্জ্য। জনবলসংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কার্যক্রম।
প্রতিদিন রোগীদের দীর্ঘ লাইন সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎকরা। নারায়ণগঞ্জ সদর হাসপাতালের মূল ফটক থেকে শুরু করে পুরো এলাকাই দিনভর ঘিরে রাখে দালাল চক্রের সদস্যরা। তারা নানা ধরনের প্রতারণা করে রোগীদের সঙ্গে। তাও আবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সামনেই। অভিযোগ রয়েছে, এ হাসপাতালের চিকিৎসক নিজেই ভাড়ায় দালাল রাখেন। সেই সঙ্গে আবার অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের বাড়তি ভাড়ার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ রোগী ও তাদের স্বজনরা। লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেই পর্যাপ্ত কনসালট্যান্ট, মেডিকেল অফিসার, নার্সসহ তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী।
নানা সংকট নিয়ে এ হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জোড়াতালি দিয়ে কোনোভাবে উপজেলাবাসীকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। ১০ বছর আগে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৩১ থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও বাড়েনি জনবল। প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ১১ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের বিপরীতে আছেন মাত্র চারজন। চিকিৎসকসংকটে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না সাধারণ রোগীরা।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের অস্থায়ী কর্মীরা প্রকাশ্যেই জোরপূর্বক স্ট্রেচার ভাড়া আদায় করছেন। এতে রোগী ও তাদের স্বজনরা সেবার নামে অস্থায়ী কর্মীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন রোগী আসেন এক থেকে দেড় হাজার। পাঁচজন চিকিৎসকের পক্ষে এতজনকে যথাযথভাবে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না। ১৭ মাস আগে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৫০ থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করতে ভবন নির্মাণ হলেও চালুর অনুমোদন মেলেনি।
এতে অব্যবহৃত থাকার কারণে চুরি হয়েছে নতুন ভবনের টিভি, পানির ট্যাবসহ নানা সামগ্রী। ভোলায় খায়েরহাট হাসপাতালে তিন মাস ধরে রোগী ভর্তি বন্ধ রয়েছে চিকিৎসক ও নার্সসংকটে। এতে বেড়েছে ভোগান্তি। চরাঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামের ২ লক্ষাধিক সুবিধাবঞ্চিত মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার পরানগঞ্জে ২০ শয্যার চরাঞ্চল হাসপাতাল স্থাপিত হয় দেড় যুগ আগে। অথচ এত বছরেও হাসপাতালটি পুরোপুরি চালু না হওয়ায় ৪৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ছুটতে হয় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটি বৃহৎ অংশ চিকিৎসাসেবায় পিছিয়ে রয়েছে। চিকিৎসাসেবার নানামুখী সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকার চেষ্টা করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
অনেক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবাদাতাদের মধ্যে নেই কোনো সমন্বয়। সেই সঙ্গে রয়েছে অপর্যাপ্ত চিকিৎসাসামগ্রী। স্বল্প চিকিৎসা যন্ত্রপাতি থাকলেও তা চালানোর মতো দক্ষ জনবলও নেই। এতে বছরের পর বছর বিকল হয়ে পড়ে আছে যন্ত্রপাতি। এ ছাড়া অপ্রয়োজনেও চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার অভিযোগ রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অপারেশন প্ল্যান (ওপি) অনুমোদন না হওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে পরিচ্ছন্নতাসহ কিছু কার্যক্রম। এ পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন চিন্তা করছে উপজেলা স্বাস্থ্য উন্নয়ন কমিটি শক্তিশালী করার। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সেবার মান নিশ্চিত করতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাসংকট দূর করতে চিকিৎসাসেবাকে আরও আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা সময়ের দাবি।