
দেশ ও জাতি এখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দেশে চলছে অন্তর্বর্তী সরকারের শাসন। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকারের পরিবর্তন হয়েছে। সবাই অপেক্ষা করছেন গণতান্ত্রিক ইতিবাচক রূপান্তরের। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার সেদিকেই এগিয়ে চলেছে। কিন্তু রূপান্তরের এই প্রক্রিয়াটি সহজে ঘটছে বলা যাবে না। কী সেই সংকট, কীভাবে সেই সংকট অতিক্রম করে দেশের মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারেন, এই বিষয়গুলো সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গত মঙ্গলবার একটা গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতায় এই দিকগুলোর প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। খবরের কাগজে সেনাপ্রধানের বক্তৃতার যে বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেশে কীভাবে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে, তার সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই বক্তৃতাটিকে তাই যেমন ‘যুগোপযোগী’, তেমনি ‘যুগান্তকারী’ বলেও চিহ্নিত করা যায়।
জেনারেল ওয়াকার এমন একটা সময়ে এই বক্তৃতাটি দিলেন, যখন বাংলাদেশ গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে চলেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বহুমুখী দাবি-দাওয়ার আন্দোলনে সরকার অনেকটা দিশেহারা। ছিনতাই, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ ইত্যাদি কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, এসবের প্রতিকার চেয়ে ঢাকা শহরের শিক্ষার্থীসহ অনেকেই আবার রাস্তায় নেমে এসেছেন। দেশের সর্বস্তরের মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। উল্লিখিত প্রেক্ষাপটে জেনারেল ওয়াকারের বক্তৃতাটি সবার কাছে দারুণভাবে সমাদৃত হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে গণমাধ্যম, ব্যক্তিগত আলাপ থেকে গণপরিসর, সর্বত্রই তিনি প্রশংসায় ভাসছেন। দেশের মানুষ যেন তার এই কথাগুলো শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি যেন সংকট উত্তরণের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।
কী বলেছেন তিনি, খতিয়ে দেখা যাক। জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, আমরা হানাহানিতে ব্যস্ত থাকায় অপরাধীরা সেই সুযোগে অপরাধ করে চলেছে। সবাইকে তাই সংগঠিত ও একত্রিত থাকতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কারণে সুন্দর পরিবেশ পাওয়া গেছে। পুলিশের মধ্যে বিরাজ করছে আতঙ্ক। বিজিবি, র্যাব, আনসার-ভিডিপি শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে। এই সংস্থাগুলোকে তাই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য (আন্ডারমাইন) করা যাবে না। তার কথায়, এরা না থাকলে শান্তিশৃঙ্খলা বিরাজ করবে না। শান্তিতে থাকা যাবে না। এখন যে উচ্ছৃঙ্খল কাজগুলো হচ্ছে, সেগুলো আমাদের নিজেদের তৈরি। কিন্তু এভাবে চলতে পারে না। নিজেদের মধ্যকার হানাহানি বন্ধ করতে হবে। সেনাবাহিনীর ৩০ হাজার সদস্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দিনরাত চেষ্টা করে চলেছেন। সেই চেষ্টা সত্ত্বেও সেনাবাহিনীর প্রতি যে বিদ্বেষ পোষণ করা হয়, তারও কোনো কারণ খুঁজে পাননি তিনি। সেনাবাহিনীকে তাই সাহায্য, অনুপ্রাণিত এবং উপদেশ দেওয়ার কথা বলেছেন।
তবে জেনারেল ওয়াকার তার বক্তৃতায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন নির্বাচন নিয়ে। তিনি মনে করেন, ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার দিকেই অন্তর্বর্তী সরকার ‘ধাবিত’ হচ্ছে। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় নিয়ে কিছুটা হলেও যে ধোঁয়াশা ছিল, তা তিনি দূর করার চেষ্টা করেছেন অথবা তার প্রস্তাবটি রেখেছেন। সেই সঙ্গে আরও যে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বলেছেন তা হলো, তার ভাষায়, ‘আমরা দেশে একটা ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ইলেকশনের জন্য (সামনের দিকে) ধাবিত হচ্ছি।’ এ জন্য যেসব সংস্কার করা প্রয়োজন, সরকার সেই সংস্কারে সাহায্য করবে।
জেনারেল ওয়াকার এই যে কথাগুলো বললেন, এর সবই ইতিবাচক। রাষ্ট্রীয়ভাবে সেনাবাহিনী কখনো তাদের ভাবনা জনগণের কাছে প্রকাশ করে না। তারা কী চায় তাও জাতিকে জানায় না। বিষয়টা এক ধরনের ট্যাবুর মতো নিষিদ্ধ। কিন্তু জেনারেল ওয়াকার সেই ট্যাবু ভেঙে দিলেন। সেই সঙ্গে এমন কিছু বিষয়ের প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন, যা চলমান সংকট থেকে মুক্ত হতে আমাদের সাহায্য করবে। এই দিকগুলো হচ্ছে নির্বাচন, আইনশৃঙ্খলা, দ্রব্যমূল্য, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ইত্যাদি। তিনি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথভাবে কাজ করা, রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীলতা, সরকারের ভূমিকা ও করণীয়, সর্বোপরি সেনাবাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন।
শুধু তাই নয়, দেশের বর্তমান সংকট ও পরিণামের ইঙ্গিত দিয়ে তিনি সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছেন। এই সংকটের জন্য দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব যাতে বিপন্ন না হয়, তার সেই সতর্কবার্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু সাধারণ জনগণ বা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নয়, সরকারের উদ্দেশেও উচ্চারিত হয়েছে। আমরা মনে করি, দেশের স্বার্থে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের কথাগুলো সংশ্লিষ্ট সবার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়া উচিত। বিশেষ করে সরকারের কাজ হবে দেশকে নির্বাচনমুখী করা। দেশ ও জাতি তাহলে বর্তমানের বিপন্ন অবস্থা থেকে মুক্ত হতে পারবে বলে আমরা মনে করি।