
সরকারি কেনাকাটায় স্বচ্ছতা আনতে সরকার ইজিপি সিস্টেম অনলাইন দরপত্র চালু করলেও এখনো তা সিন্ডিকেটের কবজায়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক যুগের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলেছে, ১০টি মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন প্রায় ৫৩ হাজার ঠিকাদার। এর মধ্যে ৫ শতাংশ পেয়েছেন ৬১ শতাংশ কাজ। মোট কাজের আর্থিক মূল্য ছিল প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকা। গত মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে মাইডাস সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। বাংলাদেশের ই-ক্রয়কার্য: একচ্ছত্র বাজার, যোগসাজশ ও রাজনৈতিক প্রভাব (২০১২-২৪) শীর্ষক গবেষণার তথ্য তুলে ধরেন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ইজিপি ব্যবস্থায় দুর্নীতি আরও বেড়েছে। তবে অনলাইন দরপত্রের মাধ্যমে সরকারি কেনাকাটার ফলে ছিনতাই, দরপত্র জমাদানে বাধা ও শক্তি প্রদর্শন কমেছে। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ, আমলাতন্ত্র, ঠিকাদার ও রাজনৈতিক শক্তির ত্রিপক্ষীয় আঁতাতে সরকারি কেনাকাটায় বাজার দখল প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারের যে তথ্যভান্ডার তা বিশ্লেষণ করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। দেখা গেছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ঠিকাদারদের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতার তীব্র প্রবণতা রয়েছে। বাজারে মুষ্টিমেয় ঠিকাদারের দখলদারত্ব রয়ে গেছে। প্রায় ৫৩ শতাংশ কাজ ওপেন টেন্ডার মেথডে (ওটিএম) এবং ৪৪ শতাংশ এলটিএম পদ্ধতিতে হয়েছে। প্রতি টেন্ডারে একটি মাত্র দরপত্র পড়ে ১৭ শতাংশ; দু-তিনটি দরপত্র পড়েছে ২৭ শতাংশ। ১২ থেকে ২৪টি দরপত্র পড়ে ৭ শতাংশ এবং ৩৬টির বেশি দরপত্র পরে ১৯ শতাংশ। ২০১৫ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১০টি মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পাঁচজন ঠিকাদারের মাধ্যমে ৯২ শতাংশ অর্থ খরচ করা হয়েছে। এভাবেই তারা বাজার দখল করে রাখে। প্রায় সব মন্ত্রণালয়ের কাজ মুষ্টিমেয় কয়েকজন ঠিকাদার যোগসাজশ করে পেয়েছেন। কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে সরকারি প্রকিউরমেন্ট ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা বাড়বে এবং প্রকৃত প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হবে। এ জন্য নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, বাজার শেয়ার সীমিতকরণ এবং প্রকৃত মালিকানার তথ্য উন্মুক্ত করতে হবে। এসব করা হলে ঠিকাদারদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হবে এবং সরকারি কেনাকাটায় সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারের কেনাকাটার ব্যাপারে সবার প্রত্যাশা ছিল ইজিপিতে স্বচ্ছভাবে সব কাজ হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, ম্যানুয়ালি কাজটা শুধু ডিজিটালাইজড হয়েছে। রাজনৈতিক শক্তি ও ঠিকাদারের দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করেছে। ২০১২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৯২১ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। তাতে শীর্ষ ১০ জন ঠিকাদার মোট অর্থের ৯২ শতাংশ খরচ করেছেন। প্রভাবশালী রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় এই বাজার দখল হয়েছে। আবার আইনের ফাঁকফোকরে একই ঠিকাদাররা যৌথভাবে কার্যাদেশ পেয়েছেন। নেতৃত্বের পরিবর্তনের সঙ্গে দু-একজন ঠিকাদার ছাড়া ঘুরেফিরে কয়েকজন ঠিকাদারই কাজ করেছেন। কাজের নিয়ন্ত্রণে শুধু একটু হাতবদল হয়েছে। এ নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া রহিত করতে হবে।
সরকারি কেনাকাটায় বাজার দখলে শীর্ষ ঠিকাদাররা সব সময়ই এগিয়ে ছিল। যদিও পদ্ধতিটা করা হয়েছিল অনলাইন দরপত্রের মাধ্যমে। যেখানে সব ঠিকাদারের মধ্যে দরপত্রের সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমলাতন্ত্র, ঠিকাদার ও রাজনৈতিক শক্তির মাধ্যমে একশ্রেণির ঠিকাদার তা দখলে নিয়ে তাদের স্বার্থ হাসিল করেছে। এভাবেই তারা দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। টিআইবির গবেষণায় যেটি উঠে এসেছে, তা খুবই হতাশাজনক। তাই সরকারি কেনাকাটায় স্বচ্ছতা আনতে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এ ব্যবস্থাকে আরও যুগোপযোগী করতে সক্ষম হবে, সেটিই প্রত্যাশা।