বাঙালির ধর্মমুক্ত উৎসবের একটি হলো নববর্ষ। কিংবা বলতে পারি এই উৎসব ক্রমশ ধর্মের খোলস ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসছে। এই লেখক ব্যক্তিগতভাবে ‘মানুষের ধর্ম’ ছাড়া আর কোনো ধর্মের রাস্তায় হাঁটেন না। তবু ধর্ম যতক্ষণ না নিজের বা অন্য ধর্মের মানুষকে আঘাত করছে বা মানুষের ক্ষতি করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ধর্মের সঙ্গে এই লেখকের কোনো বিরোধ নেই।
ধর্ম মানুষের জন্য অজস্র উৎসব সৃষ্টি করেছে, তাতে আড়ম্বর ও জাঁকজমকের অভাবও নেই। এই উৎসবগুলো আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। মানুষ এখনো এই উৎসবগুলোতে আনন্দের সঙ্গে যোগ দেয় এবং কিছুটা বেহিসেবি অপচয়ের দ্বারা নিজের উল্লাসকে চিহ্নিত করে। তাতে কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু প্রায়ই লক্ষ করা যায় যে, এই প্রাচীন উৎসবগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে বিশেষ একটি শ্রেণি, যাদের সংস্কৃতে ‘পুরোহিত’ বলা হয়। তারা না হলে এসব উৎসব অচল, তাদের হাতে কিছু না পৌঁছে দিলে সে উৎসব সিদ্ধ হয় না। অর্থাৎ এ উৎসবগুলো আরোপিত, জনসাধারণের নিজের ভেতরকার চাহিদা থেকে উদ্ভূত নয়। তবু মানুষ যদি এ থেকে আনন্দ সঞ্চয় করে, সবার সঙ্গে সেই আনন্দ ভাগ করে নিতে চায়, তাতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।
কিন্তু ধর্মের বাইরেও উৎসবের একটি চাহিদা আছে। গ্রাম-গ্রামান্তরে নৌকাবাইচ, গরু-মহিষের দৌড়, মেলা, ফুটবল খেলার ফাইনাল ইত্যাদি প্রায় উৎসবের চেহারা নেয়। তবে তা নেহাতই স্থানীয় উৎসব, দেশের সব জনগোষ্ঠীকে তা উত্তেজিত বা উদ্বেলিত করে না, নববর্ষ যেমন করে। এই উৎসব বিশেষত বাংলাদেশের এক সাংস্কৃতিক সৃষ্টি, যা পশ্চিমবঙ্গে, বিচ্ছিন্ন চেষ্টা সত্ত্বেও এখনো তেমন ব্যাপ্তি বা উজ্জ্বলতা পায়নি।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে আর একটি দিন এই এক ‘জাতীয়’ সাংস্কৃতিক উৎসবের আকৃতি ধারণ করতে চলেছে। সেটি পঁচিশে বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। কয়েক বছর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকার সুবাদে এই লেখক সেই উৎসবের অন্দরমহলের সঙ্গে কিছুটা যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন, তারই স্মৃতি থেকে কিছু সংগ্রহ পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি।
আগে কলকাতায় এই উৎসবের প্রধান কেন্দ্র ছিল জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথের বাড়ি। আমি যৌবনে ভোরবেলায় উঠে সেখানে গেছি, সেখানে বিশ্বভারতী ও রবীন্দ্রভারতী আগে একসঙ্গে এই জন্মদিনের অনুষ্ঠান করত। এখানে বলা দরকার যে, আগে শান্তিনিকেতনে পঁচিশে বৈশাখ গ্রীষ্মের ছুটির মধ্যে পড়ত বলে সেখানে ১ বৈশাখই রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন করা হতো। পরবর্তীকালে এই ব্যবস্থা পরিত্যক্ত হয়েছে। এখন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ কলকাতাতেও একটি অনুষ্ঠান করে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে, রবীন্দ্রভারতীর সঙ্গে একযোগে নয়, পৃথকভাবে।
অনেক দিন পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের বাড়ির অনুষ্ঠান ছিল কলকাতায় প্রধান অনুষ্ঠান। পরে মধ্য কলকাতায় রবীন্দ্রসদনে একটি অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়েছে। এই দুটি ছিল ভোরবেলার প্রধান অনুষ্ঠান, কিন্তু পরে সম্ভবত বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে রবীন্দ্রসদনে বেলা ২টা থেকে অনুষ্ঠান আরম্ভ হতে শুরু করেছে।
কালক্রমে এ ধরনের রবীন্দ্র-জন্মদিন অনুষ্ঠান কলকাতার আরও নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। দক্ষিণ কলকাতার নজরুল মঞ্চে একটি বড় অনুষ্ঠান হয়, একটি অনুষ্ঠান হয় সল্টলেকে মেলা প্রাঙ্গণে। শিল্পীদের নানা প্রান্তে দৌড়ে গলদ্ঘর্ম হতে হয় বলে কখনো এক দিন আগ-পিছ করে এই অনুষ্ঠানগুলো সাজানো হয়। কলকাতার সব অঞ্চলেই ছোট-বড় নানা উৎসব চলে। ওই দিন এবং তার পরে প্রায় ১৫ দিন ধরে। ‘কবি-পক্ষ’ কথাটা কে চালু করেছিলেন জানি না, বোধহয় প্রয়াত প্রেমেন্দ্র মিত্র। পুরো এক পক্ষ বা তার বেশি সময় ধরে এই উদ্যাপন চলে। স্কুল-কলেজ, ক্লাব, অফিসে, ক্যাসেট কোম্পানি, রেডিও, টেলিভিশন- কেউ রবীন্দ্রনাথকে ভুলে থাকবেন তার উপায় নেই। পুরো পশ্চিম বাংলায় এই সময়টা রবীন্দ্রজয়ন্তীর উচ্ছল বন্যার ঢেউ উঠতে থাকে।
তার বৈচিত্র্যই-বা কত! ট্রেনের কামরায় নিত্যযাত্রীরা আয়োজন করেন রবীন্দ্র-জন্মোৎসবের, গঙ্গাবক্ষে নৌকার ওপর হয় রবীন্দ্র-জন্মদিন, ছেলেমেয়েদের রবীন্দ্রনাথের নাটকের চরিত্র সাজিয়ে, এমনকি কাউকে রবীন্দ্রনাথ সাজিয়ে, কেউ নিয়ে আসেন জোড়াসাঁকো বা রবীন্দ্রসদনে, ট্রাকের ওপরে গানের দল রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে অঞ্চল পরিক্রমা করে, বাসের মধ্যে চলে রবীন্দ্রজয়ন্তী- সে এক কাণ্ডই বটে! আমার সময়ে ছাত্র পঙ্কজ সাহার উদ্যোগে রবীন্দ্রভারতী থেকে অনুষ্ঠানের টেলিভিশন প্রচার শুরু হয়। এখন তা কলকাতার সব প্রধান অনুষ্ঠানকে ধরার চেষ্টা করে এবং যারা ঘরের বাইরে বেরোতে পারেন না, তাদের কাছে এই সম্প্রচার এক আশীর্বাদের মতো হয়ে উঠেছে।
এই দিন এখানকার বাঙালি যেন ওই মানুষটির কাছে নিজেদের সমর্পণ করে। কত কত দূর থেকে যে বাঙালি ওদিন জোড়াসাঁকোয় এসে পৌঁছায়, তার হিসাব নেই। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত আমার কাছে চিঠি লিখতেন পুরুলিয়ার আদ্রা শহরের এক ইঞ্জিনিয়ার বুধন ভট্টাচার্য, তিনি চব্বিশে বৈশাখ রাত ১০টা না ১২টার পুরুলিয়া এক্সপ্রেস ধরে ভোরবেলায় হাওড়া এসে পৌঁছাতেন। প্রথমেই জোড়াসাঁকো। সেখানে শেষ পর্যন্ত কাটিয়ে কোথাও কিছু একটা মুখে দিয়ে অন্য কোনো রবীন্দ্র-অনুষ্ঠানে। তার পর রাতের ট্রেন ধরে আবার আদ্রায় ফেরা, পরদিন ভোরবেলায়। জীবনের বেশ কয়েকটা বছর পঁচিশে বৈশাখ ওই ছিল তার রুটিন। জানি না বয়সের কারণে এখন তা বজায় রাখতে পেরেছেন কি না। বুধন ভট্টাচার্য একা নন। দুই বাংলায় নিশ্চয়ই এ রকম রবীন্দ্র-উন্মাদ একাধিক মানুষ আছেন, যারা রবীন্দ্রনাথ থেকে বাঁচার রসদ জোগাড় করেন, রবীন্দ্রনাথ, তার ভাষাতেই বলি, তাদের দিনরাত্রির দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
আমরা রবীন্দ্রনাথের কাছে কী এত পাই যে তাকে শুধু ওই দিনটি নয়, আমাদের অনেক মুহূর্ত উৎসর্গ করি, উৎসর্গ করে কৃতার্থ বোধ করি। তার উত্তর বহু দেশে বহু মানুষ দিয়েছেন, সাধারণ অখ্যাত মানুষ থেকে মহামনীষী পর্যন্ত, ফলে তা নিয়ে আর বেশি বাগ্বিস্তারের দরকার নেই। পিতৃহীন একটি ছেলের কথা জানি, যে তার পরীক্ষার আগে রবীন্দ্রনাথের ছবিতে নমস্কার করে বেরোত। বলত, তার ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই, কিন্তু ঈশ্বরের বিকল্প যদি কিছু থাকে তবে তার কাছে তিনি রবীন্দ্রনাথ- তাই জীবনের সংকটে, সন্ধিতে তাকে প্রণাম করতে তার ইচ্ছে হয়।
যাকে নিয়ে এত সব কাণ্ড, তিনি নিজে কিন্তু ঈশ্বর হওয়ার কথা ভাবেননি কখনো। এমনকি ‘গুরুদেব’-এর ভূমিকাও তার অস্বস্তি বাড়িয়েছে, বলতে চেয়েছেন- তিনি শুধুই কবি, আর কিছু নন। কিন্তু কবিরা তো যেকোনো পথচলতি মানুষ নন, তার ওপর রবীন্দ্রনাথের মতো কবি। তিনি আমাদের জীবনের সবকিছুর মধ্য থেকে, বিশ্বচরাচর থেকে, ছয় ঋতুর আবর্তন থেকে, এই মানবজীবনের এমন সুন্দর, এমন মহৎ, এমন অভাবনীয় অর্থ আমাদের জন্য তুলে এনেছেন যে আমরা অনেকে তাকেও একই সঙ্গে বন্ধু আর নাথ ভাবতে শুরু করেছি।
কখনো তারও অবশ্য একজন ঈশ্বরের প্রয়োজন হয়েছে। কিন্তু তিনি কোনো প্রচলিত ধর্মের ঈশ্বর নন, এমনকি তার কৌলিক ব্রাহ্মধর্মের ঈশ্বরও নন। তিনি এক ব্যক্তিগত নির্মাণ, তার নিজস্ব ঈশ্বর। তিনি তার বন্ধু, তার নাথ। কোনো কাতর মুহূর্তে তিনি বলতে চেয়েছেন, ‘তুমি এবার আমায় লহো হে নাথ, লহো।’ এই উপলব্ধি বহন করেছেন কখনো যে তিনি তার প্রভু, প্রিয়, পরম ধন; তিনি তার চিরপথের সঙ্গী, তিনি তার চিরজীবন। কিন্তু আবার লক্ষ করি, জীবনসায়াহ্নে গিয়ে সদ্য-আবির্ভূত সত্তাকে তিনি বুঝতে পারেননি, ‘কে তুমি’ প্রশ্নের উত্তর তিনি পাননি, প্রথম দিনের বা দিবসের শেষ সূর্যের মতো। তাই হয়তো পৃথিবীর মানুষের কাছে তার শেষ আবেদন, শেষ আর্তি উচ্চারণের সময়, ‘সভ্যতার সংকট’-এ, তিনি কোনো ঈশ্বরের ওপর নির্ভর করেননি, বলেছেন, ‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ।’ তিনি কি আর সবকিছুর ওপর বিশ্বাস হারিয়েছিলেন? কে জানে! কিন্তু আমাদের বিশ্বাসের সব দিগন্ত তিনি অধিকার করে আছেন। তার সঙ্গে আমাদের এক জটিল সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তাকে আমরা কখনো সমালোচনা করি, কিন্তু তার হাত ছাড়তে চাই না।
তাই তার জন্মদিন এক অর্থে আমাদের নিজেদেরই জন্মদিন। তিনি বাঙালির আত্মপরিচয়ের মহৎ অংশ, কখনো তার সংগত বা অসংগত অহংকারের উৎস। তার জন্মদিনে বাঙালি, যে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় জন্ম নেওয়ার অভাবনীয় সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছে, নিজেকে আরও বেশি করে পাওয়ার সাধনা করে। তাই তাকে নিয়েই হয়তো গড়ে উঠেছে বাঙালির আর এক ধর্মমুক্ত উৎসব।
লেখক: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়