![বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র : গৌরবে, সৃষ্টিতে ৪৫ বছর](uploads/2024/02/09/1707456443.Hasibul_Hasan.jpg)
তেপান্ন বছরে বাংলাদেশ। ঔপনিবেশিক শক্তির শাসন আর শোষণ থেকে মুক্তির মাইলফলক, একই সঙ্গে ৪৫ বছরে পদার্পণ করল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। সদ্য স্বাধীনতাপরবর্তী এই সময়টা দেশটার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সময়টা এই দরিদ্র দেশটার নির্মাণপর্ব বললেও ভুল হবে না। অনেক সংগ্রাম, বেদনা, যন্ত্রণা আর আত্মদানের ভেতর দিয়ে জন্ম নিয়েছে আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশকে ভেতর থেকে নির্মাণের অভিপ্রায় নিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। বাংলাদেশের মতো এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের নির্মাণ ইতিহাস আরও বর্ণিল। স্বাধীন দেশের পরে প্রত্যাশা বাড়ায় দেশ নির্মাণ প্রক্রিয়ার পদ্ধতি। আর এই দেশনির্মাণকে অর্থময় সার্থক পরিপূর্ণ আর এগিয়ে নেওয়ার জন্য ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ গোড়াপত্তন করেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের।
হাঁটি হাঁটি পা পা করে মানুষের মৌলিক মানবিক বিকাশ চর্চার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে আজ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। জাতির মানসিক উৎকর্ষসাধন ও আলোর পথে এনে যথার্থ বিকাশসাধনই যার মূল লক্ষ্য। এটা আজ আর কারও অজানা নয়। সমাজের নানাবিধ নীতি-আদর্শ ধারণ করে এগিয়ে চলার প্রত্যয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বিশ্বাস করেন প্রতিটি মানুষ অসীম সম্ভাবনাময়, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়, ব্যক্তি মানুষের বড়ত্বের বিকাশ সমাজ দেশ ও জাতিকে পৌঁছে দেয় কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশে চাই আজ অযুত লক্ষ নিযুত সম্পন্ন মানুষ; তারুণ্যদীপ্ত বিকশিত মানুষ, উন্নত মানুষ, সেই সব মানুষ যারা উচ্চ-মূল্যবোধসম্পন্ন, আলোকিত মানুষ, উদার, শক্তিমান ও কার্যকর- যারা জাতীয় জীবনের বিভিন্ন অঙ্গনে শক্তিমান নেতৃত্ব দিয়ে এই জাতিকে সমৃদ্ধি ও আলোকায়নের পথে এগিয়ে নিতে পারবে। ক্রান্তিকালে দেশের হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে বুক চিতিয়ে। এমন সাহসী আর ত্যাগী প্রজন্ম তৈরি করলেই হবে জাতির টেকসই উন্নয়ন। দেশের সবখানে এমন মনন আর মানসিকতা সম্পন্ন আলোকিত মানুষ তৈরি করতে পারলেই কেবল সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে বাংলাদেশ। এরই ধারাবাহিকতায় আলোকিত মানুষ চাই নামে সামাজিক আন্দোলনের প্রভাব আজ সর্বব্যাপী। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত এই আন্দোলন এখন মানুষের সুকুমার বৃত্তিচর্চার এক অনন্য প্রতিষ্ঠানের নাম।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বিশ্বাস করে, উন্নত মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ তৈরির লক্ষ্য বাস্তবায়িত হলেই কেবল দেশের ঘটবে সত্যিকার উন্নয়ন। উন্নত মানুষের হাত ধরে উন্নত জীবনের পথে টিকে থাকতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে পাড়ি দিতে হয়েছে বন্ধুর পথ। এই সংগ্রামের পথে দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সারথির ভূমিকা পালন করে আসছেন ৪৫ বছর। দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে জাতি গঠনের এই প্রয়াস বিরতিহীন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বিশ্বাস করেন, পৃথিবীর মহান মানুষদের মহৎ সাহিত্যকর্মের সংস্পর্শে এনে তরুণ সমাজের চিত্তকে বিকশিত করতে পারলেই মিলবে প্রকৃত মুক্তি। আলোকিত মানুষদের জীবন, কর্ম ও সাহিত্য থেকে আলো ধারণ করে নিজেকে বিকশিত করতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আজ দেশের অভ্যন্তরে অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সজীব, সপ্রাণ প্রতিষ্ঠান বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মূল লক্ষ্য প্রতিটি ঘরে দেশের প্রতিটি আনাচে-কানাচে বুদ্ধিদীপ্ত, উৎকর্ষিত মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন আলোকিত মানুষ তৈরি করে সমগ্র দেশকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে জাতীয় চিত্তের বিকাশ ঘটানো। আর এই পরিকল্পনার সফলতার জন্য অনুরাগ-আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা বহমান। একদিনে এই সফলতা ছোঁয়া যাবে না।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ফাইল ছবি
আজকের স্বপ্ন, চেষ্টা ও আয়োজনের পথ ধরে আগামীতে যদি দেশের সবখানে উজ্জ্বল, বুদ্ধিদীপ্ত, আলোকিত ভালো মানুষেরা জন্ম নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারে, তবে অনেক পরে নয়, আগামীকালই বদলে যাবে বাংলাদেশ। একজন সফল আলোকিত মানুষ যদি আরেকজন সফল আলোকিত মানুষ তৈরি করতে সক্ষম হয়, তা হলেই সফল হবে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। প্রতিযোগিতামূলক এই বিশ্ব পরিস্থিতিতে জাতির সঠিক চৈতন্যোদয় ও আলোকায়নের বাস্তবতা খুবই প্রাসঙ্গিক। শুধু পুঁজিবাদের বিকাশ নয়, শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঠিক বিকাশ ব্যাহত হলে প্রকৃত অর্থেই পিছিয়ে যায় সেই জনপদ- এমন মজ্জাগত ধারণা থেকেই ক্রমাগতভাবে বিকশিত হচ্ছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। ক্ষুদ্র মানুষ আর বড় জাতি একসঙ্গে থাকতে পারে না। তাই এই সংক্রীর্ণ মানবসত্তাকে বড়ত্বের সংস্রবে এনে উন্নত করাই অন্যতম উদ্দেশ্য।
শুধু অবয়ব আর বিত্ত থেকে চিত্তের মানসিক বড়ত্বের উন্নয়নই আজ বড় বেশি প্রাসঙ্গিক কেন্দ্রের জন্য। বই পড়া, আর পাঠচক্র কার্যক্রমকে নিয়ে শুরু করা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মৌলিক কর্মকাণ্ডের পরিধি আজ বেড়েছে বহুগুণে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এখন সর্বমোট ১২টি মৌলিক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করে চলেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- দেশভিত্তিক উৎকর্ষ কার্যক্রম, পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচি, ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি, কেন্দ্র লাইব্রেরি, আলোর ইশকুল, মৌলিক প্রকাশনা, বই বিক্রয় কার্যক্রম, শ্রবণ-দর্শন কার্যক্রম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোর পাঠশালা, প্রাথমিক শিক্ষকদের বই পড়া কার্যক্রম এবং বাঙালির ২০০ বছরের মৌলিক চিন্তাগুলোকে গ্রন্থিত করে ২০৮ খণ্ডে প্রকাশের উদ্যোগ চ্যালেঞ্জিং হলেও অসম্ভব নয়; সেটা করে দেখাচ্ছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আজ আর শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়। মেধা ও বোধের আলোকে মানবিক সমৃদ্ধি সাধন করে সামাজিক অচলায়তন ভেঙে জেগে ওঠার অপর নাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। এটি আজ একটি দেশব্যাপী আন্দোলন। জ্ঞানের আন্দোলন, বই পড়ার, অর্জিত জ্ঞান নিয়ে মূল্যবোধ চর্চার আন্দোলন। আর এই সামগ্রিক কর্মযজ্ঞকে শুধু আন্দোলন বললে কৃপণতা করা হয়। এটি আজ একটি সামাজিক আন্দোলনের নাম। পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে এই প্রতিষ্ঠান থেকে উপকৃত হচ্ছে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন উপকারভোগীর সংখ্যা লক্ষ কোটি। এটি আজ আলোকিত জাতীয় চিত্তের একটি বিনীত নিশ্চয়তা। মানবজ্ঞানের সামগ্রিক চর্চা এবং অনুশীলনের পাশাপাশি হৃদয়ের উৎকর্ষ ও জীবনের বহুবিচিত্র কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে উচ্চতর শক্তি ও মনুষ্যত্বে বিকশিত হওয়ার একটি সপ্রাণ, সজীব, স্বপ্নবান পৃথিবী।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ৪৫ বছর পূর্তি উৎসব সফল হোক, এমন মাহিন্দ্রক্ষণে প্রত্যাশা- আলোর বাতিঘর হয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ছড়িয়ে পড়ুক দেশ হতে দেশান্তরে।
প্রাবন্ধিক, গল্পকার ও শিক্ষা গবেষক