![একুশে বইমেলা যেন বাংলা সাহিত্যের প্রাণস্পন্দন](uploads/2024/02/17/1708149450.Md-Rezaul-Karim.jpg)
একুশে বইমেলা এখন নিছক বই বিক্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অমর একুশে বইমেলা আজ বাংলা ভাষাভাষী মানুষের প্রাণের মেলায় রূপ নিয়েছে। যদিও মাসব্যাপী বই বিপণন মেলার প্রধান আকর্ষণ, এ ছাড়া মেলায় প্রতিদিন পৃথক স্থানে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, ‘লেখক বলছি’ অনুষ্ঠানে লেখকের সাক্ষাৎকার, প্রতিদিনই বিষয়ভিত্তিক সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। স্থান-সংকুলানে সমস্যা হওয়ায় বইমেলা ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থানান্তরিত হয়েছে। গ্রন্থ প্রকাশনী ও লেখকের সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান। একুশে বইমেলা সত্যিকারার্থে লেখক-প্রকাশক-পাঠকের এমন এক মিলনমেলায় রূপান্তরিত হয়েছে, যেখানে শুধু ঢাকা শহর নয়, গোটা দেশ থেকেই লেখক, এমনকি বইপ্রেমী সাধারণ মানুষও আসেন।
আগে বড় প্রকাশকরা মুদ্রিত পত্রিকায় সীমিত-সংখ্যক বইয়ের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতেন। বর্তমানে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। শুধু প্রকাশক নন, লেখকও অন্তর্জালের বিভিন্ন মাধ্যমে তার নিজ গ্রন্থের প্রচার চালাতে পারছেন। ফলে গ্রন্থপ্রেমী মানুষ সহজেই নানা ধরনের বই, এর বিষয়সূচি ইত্যাদি দেখতে পারছেন এবং বই কেনার ব্যাপারে সহজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন। বইপ্রেমী মানুষ সারা বছরই ফেসবুকে বিভিন্ন লেখকের চিন্তার বহিঃপ্রকাশ স্ট্যাটাস আকারে দেখে লেখকের লেখার মান সম্পর্কে একটা ধারণা করে নেন, যা তার বই কেনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।
তিন দশক আগেও বইমেলাতে পাঠকরা লেখকদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেই চলতেন। এখন যেহেতু ফেসবুকের মাধ্যমে লেখক-পাঠক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে, সেহেতু বইমেলাতে তারা পারস্পরিক আলোচনা ও মতবিনিময় করতে পারেন; এর মধ্য দিয়ে লেখকরা পাঠকের মন ও মনন সম্পর্কে অবহিত হতে পারেন। যদিও লেখকের জন্য পাঠকরুচি জেনে লেখালেখি জরুরি তো নয়ই, প্রয়োজনীয়ও নয়। তবে মেলাতে লেখক ও প্রকাশকদের মধ্যে যে যোগাযোগ হয় তা গুরুত্ব বহন করে। অনেক প্রকাশক লেখকের বর্তমান লেখালেখি সম্পর্কে জানতে পারেন, যা তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়নে সহজ হয়।
অনেকেই অধিক-সংখ্যক বই প্রকাশের ব্যাপারে অভিযোগ বা আপত্তি তোলেন। ২০২২-এর বইমেলায় নতুন বই আসে ৩ হাজার ৭৩৭, যার মধ্যে উপন্যাস ও ছোটগল্পের বইয়ের সংখ্যা যথাক্রমে ৫০১ ও ৪৬৭। যদি অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করা হয় তাহলে দেখা যায় যে, আমেরিকা, চায়না, যুক্তরাজ্য ও জাপানে ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২৭৫২৩২, ২০৮৪১৮, ১৮৬০০০ ও ১৩৯০৭৮ (সোর্স: wordsrated.com/number-of-books-published-per-year-2021)। তাহলে ১৭ কোটি মানুষের দেশে ৩ হাজার ৭৩৭টি বই প্রকাশ কি বেশি বলে প্রতীয়মান হয়? যারা মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তাদের উদ্দেশে বলতেই হয়, মানসম্পন্ন বই-ই প্রকাশিত হতে হবে- এটি কি পূর্ব থেকে নির্ধারণ করা সম্ভব?
তারপরও বলতে হয়, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় তদানীন্তন পূর্ববাংলায় না ছিল উল্লেখযোগ্য লেখক, না ছিল বইয়ের বাজার। এ দেশে মূলত মানসম্পন্ন লেখালেখির গোড়াপত্তন হয় ষাটের দশকে। তথাপি সত্তরের দশকও এ দেশের বইয়ের বাজার মূলত পশ্চিমবঙ্গের বইয়ের দখলেই ছিল। আশির দশকে বাংলাদেশের মানুষ ব্যাপকভাবে এ দেশের লেখকের বইয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। নব্বইয়ের দশকে তা এতটাই বিস্তার লাভ করে যে, এখন ফেসবুকে সাধারণ লেখালেখি করতে করতে অনেকে বই লেখায় আগ্রহী হয়ে উঠছেন। এই প্রক্রিয়াকে আমি সাধুবাদ জানাই। শতকুঁড়ির মধ্যে সবগুলো না, তবে কিছু কুঁড়ি ফুল হিসেবে বিকশিত হবে- এটিই আমাদের বিবেচনা করতে হবে।
বিগত ৫৩ বছরে আমাদের দেশে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার নিয়ে যেসব রাজনৈতিক ইতিহাসের বই লেখা হয়েছে, তা পরবর্তীতে একাডেমিশিয়ান তথা ঐতিহাসিকদের জন্য ইতিহাস রচনায় প্রধানতম উপকরণ বলে বিবেচিত হবে। অন্যান্য মননশীল গ্রন্থ রচনাও যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক।
এখন আমাদের দেশে রচিত উপন্যাস অন্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হচ্ছে। আমাদের দেশের অন্তত ১০ জন লেখকের বই ইংরেজি শুধু না অন্য ভাষায়ও অনুদিত হচ্ছে। এই সফলতার পেছনে শুধু বইমেলা যে অবদান রাখে তা নয়, তবে বইমেলা আমাদের সার্বিক লেখালেখির যে বিশাল যজ্ঞ তার বহিঃপ্রকাশ।
লেখক : কথাসাহিত্যক ও সমাজ গবেষক
[email protected]