আপনি যখন ভারতের কেরালা রাজ্যের কোচি থেকে ৪৯০ কিলোমিটার পশ্চিমে আরব সাগরের মাঝে লাক্ষা দ্বীপপুঞ্জে অবতরণ করবেন, ঠিক তখন চারপাশে নীল জলরাশি দেখতে পাবেন। সৈকতে শত শত নারিকেল গাছের সারি। সমুদ্রের দিকে একটু এগোলে পানির রঙ হয় ফিরোজা, আবার গভীর সমুদ্রে পানির রঙ পান্না নীল।
সংস্কৃত ভাষায় লাক্ষা দ্বীপ-এর অর্থ এক লাখ দ্বীপ। এটি ভারতের একমাত্র প্রবালপ্রাচীর, যা সমুদ্রপৃষ্ঠের ঠিক ওপরে অবস্থিত। লাক্ষা দ্বীপে মোট ৩৬টি দ্বীপ রয়েছে। এর মধ্যে ১২টি প্রবালপ্রাচীর। এই দ্বীপগুলোতে প্রায় ৭০ হাজার লোক বাস করেন। বাসিন্দাদের বেশির ভাগই মাছ ধরা ও নারিকেল চাষের ওপর নির্ভরশীল।
প্রবালপ্রাচীরের অগভীর জল, সামুদ্রিক জীবন ও প্রবাল প্রাচুর্যের কারণে লাক্ষা দ্বীপ ভারতের সাঁতার ও স্কুবা ডাইভের সেরা জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ ছাড়া দ্বীপের রাতের আকাশ আরেকটি দর্শনীয় বিষয়।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে পরিবারের সঙ্গে লাক্ষা দ্বীপে বেড়াতে আসেন শালিনা সিভি। তিনি বলেন, ‘আমি আমার জীবনে এত তারা, নক্ষত্রমণ্ডল ও ছুটন্ত তারকা দেখিনি-যতটা আমি দ্বীপে তিন দিনের ভ্রমণে দেখেছি। লাক্ষা দ্বীপ হলো একটি সুন্দর, নির্মল দ্বীপ- যেখানে জীবন শ্লথ বলে মনে হয়। কিন্তু সেখানে একটি পরাবাস্তব প্রশান্তি আপনি অনুভব করবেন।’
এ দ্বীপের আর একটি মিস না করা অ্যাডভেঞ্চার হলো রাতে মাছ ধরা। এ দ্বীপের পর্যটকরা জেলেদের সঙ্গে মাছ ধরার অভিযানে যোগ দিতে পারেন। চাইলে স্কিপজ্যাক ও ইয়েলোফিন টুনা মাছ ধরার চেষ্টা করতে পারেন। একই সঙ্গে রয়েছে কয়েকটি সরকার পরিচালিত ডাইভ সেন্টার, কায়াকিং, উইন্ড সার্ফিং, প্যারাসেলিং ও অন্যান্য জলক্রীড়া কার্যক্রম।
এ ছাড়াও স্থানীয়দের পরিচালিত অনেক হোমস্টে রয়েছে, যা আপনার ভ্রমণকে করবে আরামদায়ক। পর্যটকদের আনোগোনা বেড়ে যাওয়ায় ইতিমধ্যে কিছু স্থানীয় ব্যবসায়ী দ্বীপটিতে পর্যটন কোম্পানি গড়ে তোলার কার্যক্রমও শুরু করেছেন।
তবে শান্ত, স্নিগ্ধ, নীল জলরাশি পরিবেষ্টিত দ্বীপটি গত বছরও খুব বেশি মানুষের কাছে জনপ্রিয় ছিল না। এ বছরের জানুয়ারি মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লাক্ষা দ্বীপের প্রবাল দ্বীপ ভ্রমণের পর পর্যটকদের আগ্রহ বেড়েছে বহু গুণ।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ভূতাত্ত্বিক শ্রদ্ধা মেনন জানান, এটি সত্যিই চিত্তাকর্ষক একটি স্থান। একটি গবেষণার কাজে গত দুই বছরে তিনবার তিনি এই দ্বীপপুঞ্জে ভ্রমণ করেছেন। প্রতিবার তিনি কোচি থেকে লাক্ষা দ্বীপের উদ্দেশে ছোট প্লেনে চড়ে এসেছেন। প্রতিবারই প্লেনের যাত্রী ছিল হাতেগোনা। যাদের মধ্যে ছিলেন দ্বীপের বাসিন্দা ও সরকারি কর্মকর্তারা।
লাক্ষাদ্বীপের ফ্লাইটগুলো কোচি থেকে ছেড়ে যায় এবং আগত্তি দ্বীপে অবতরণ করে। ছবি: সংগৃহীত
কিন্তু এ বছরের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লাক্ষা দ্বীপে যাওয়ার পর ভারতীয় পর্যটকদের এই দ্বীপের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে বহুগুণ।
নরেন্দ্র মোদি সৈকতে হাঁটার ও স্ফটিক-স্বচ্ছ জলে সাঁতারের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে প্রকাশ করে জনসাধারণের উদ্দেশে বলেন, ‘লাক্ষা দ্বীপের সৌন্দর্য কথায় বর্ণনা করা যাবে না। যারা সারাবিশ্বের সমুদ্রসৈকত ও দ্বীপ দেখতে পছন্দ করেন, আমি তাদের লাক্ষা দ্বীপে আসার আহ্বান জানাই।’
সেই থেকে পর্যটকপ্রেমীদের কাছে দ্বীপপুঞ্জটি স্পটলাইটে পরিণত হয়েছে। দ্য ইকোনমিক টাইমস অনুসারে, লাক্ষা দ্বীপের জন্য গুগলে এত বেশিবার অনুসন্ধান করা হয়েছে, যা বিগত ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
ভারতের বৃহত্তম ভ্রমণ বুকিং পোর্টাল মেকমাইট্রিপ দাবি করছে, মোদির সফরের পর লাক্ষা দ্বীপের জন্য ইন-প্ল্যাটফর্ম অনুসন্ধান তিন হাজার ৪০০ শতাংশ বেড়েছে।
লাক্ষা দ্বীপ সোসাইটি ফর প্রমোশন অব ন্যাচার ট্যুরিজম অ্যান্ড স্পোর্টসের (স্পোর্টস) ওয়াটার স্পোর্টস প্রশিক্ষক আব্দুল সামাদ জানান, এই অঞ্চলে পর্যটন পরিচালনা করা হয় স্পোর্টসের ফোনলাইনের মাধ্যমে। এ লাইন এর আগে কখনো এত ব্যস্ত ছিল না। দিনে দুই-একজন পর্যটক অনুসন্ধান করতেন। কিন্তু গত মাস থেকে প্রতিদিন অন্তত ১০টি ফোনকল আসছে।
এদিকে ২০২১ সাল থেকে মুম্বাই, কোচি ও গোয়া থেকে লাক্ষা দ্বীপে যাতায়াত করা জাহাজ কর্ডেলিয়া ক্রুজ কর্তৃপক্ষ জানায়, মোদির সফরের পর থেকে জাহাজটির বুকিং প্রায় আড়াই হাজার শতাংশ বেড়েছে।
ওয়াটার স্পোর্টস প্রশিক্ষক আব্দুল সামাদ আরও জানান, বাড়তি পর্যটকের চাপ সামলাতে ইতিমধ্যে সুহেলি ও কদমত দ্বীপে নতুন রিসোর্ট তৈরির পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
এমনকি গত ১ ফেব্রুয়ারি ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন তার বাজেট বক্তৃতায় দেশটির পর্যটনশিল্পের প্রসার ঘটাতে লাক্ষা দ্বীপের সঙ্গে ভারতের অন্য দ্বীপগুলোর ভালো সংযোগ তৈরির কথা উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু দ্বীপের বিনাশশীল পরিবেশ কি পর্যটনের বিকাশ ঘটাতে পারবে? এটা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে বিশেষজ্ঞদের মাঝে।
১৫ বছর ধরে লাক্ষা দ্বীপে কাজ করা জিভিআইর সংরক্ষণ পরিচালক বর্ধন পাটাঙ্কর জানান, এই প্রবাল প্রাচীরগুলো প্রাচীন আগ্নেয়গিরির অবশিষ্টাংশ যা অগ্ন্যুৎপাতের ফলে ধীরে ধীরে সমুদ্রপৃষ্ঠের ঠিক ওপরে ডুবে গেছে। প্রবাল প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত লাক্ষা দ্বীপ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র কয়েক মিটার ওপরে। বিশ্বের বেশির ভাগ দ্বীপের মতো লাক্ষা দ্বীপেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
লাক্ষা দ্বীপ রিসার্চ কালেকটিভের মতে, উপকূলীয় ক্ষয়ের কারণে দ্বীপপুঞ্জের ভূমি আস্তে আস্তে সংকুচিত হচ্ছে, এমনকি ২০১৭ সালে একটি দ্বীপ সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে গেছে। গত দুই দশকে লাক্ষা দ্বীপে চারটি প্রধান এনএসও-সম্পর্কিত তাপমাত্রার বিচ্যুতি (হাওয়া এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার তারতম্য সৃষ্টিকারী একটি জলবায়ু ঘটনা) দেখা গেছে। এর পাশাপাশি গত কয়েক বছরে তিনটি বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ও হয়েছে।
পাটাঙ্কর বলেন, বিজ্ঞানীদের রক্ষণশীল ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে ২০৫০ সালের মধ্যে লাক্ষা দ্বীপ সমুদ্রের নিচে চলে যাবে। যদি পর্যটনসহ অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্প এবং মাছ ধরার কারণে দ্বীপে অতিরিক্ত লোকসমাগম হয়, তবে তা দ্বীপ ও এর পরিবেশের জন্য বিপর্যয়কর হতে পারে।
লাক্ষা দ্বীপের প্রশাসনিক কেন্দ্র কাভারত্তি। ছবি: সংগৃহীত
স্পোর্টস জানিয়েছে, দ্বীপগুলোতে পর্যটকদের চাপ কমাতে তারা পারমিট সিস্টেম ব্যবহার করবে। ইতিমধ্যে তারা জাহাজগুলোকে দ্বীপে যাতায়াত করার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। তাদের দাবি, এর মাধ্যমে দ্বীপটিতে রাতে অবস্থান করা মানুষের সংখ্যা কমবে। ফলে উৎপন্ন বর্জ্যের পরিমাণও কমে আসবে।
যদিও বিজ্ঞানীরা বলছেন, বড় জাহাজগুলো নিয়মিত যাতায়াত করলে দ্বীপের সূক্ষ্ম প্রবাল প্রাচীরের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অন্যদিকে ভূতাত্ত্বিক শ্রদ্ধা মেনন বলেন, দ্বীপে পর্যটক আগমন অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত হতে হবে, যেন তা লাক্ষা দ্বীপের বাস্তুসংস্থান বজায় রাখতে সক্ষম হয়।
নির্জন ও দারুণ সুন্দর এই দ্বীপটি রক্ষা প্রসঙ্গে পাটাঙ্কর বলেন, ‘আমি মনে করি দ্বীপটি স্থানীয়দের হাতেই সবচেয়ে নিরাপদ থাকবে। দ্বীপটি রক্ষায় তাদের ক্ষমতায়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে তাদের সঙ্গে কাজ করা দ্বীপ এবং এর পরিবেশের জন্য সেরা হবে।’ সূত্র : বিবিসি
অনুলিখন: ইসরাত জাহান চৈতী