সবাই যখন সহজ গোছানো পথে হাঁটতে শুরু করেন, তখন অনেকেই হাঁটেন বিপরীতে। তরুণ প্রজন্মের চাকরির প্রতি ঝোঁকের দিনে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া রকি বেছে নিয়েছেন উদ্যোক্তা হওয়ার পথ। নানা চড়াই-উতরাই পার করে রকি নিজেকে নিয়ে এসেছেন সফলতার মঞ্চে। অনেকের কাছে যেটা শুধুই ঘুরে বেড়ানো, রকির সেটা আয়েরও মাধ্যম। নিজে ঘুরে এবং অন্যদের ঘুরিয়ে রকি যেমন শান্তি পান, তেমনি আয়ও করছেন বেশ। চাকরি করে মাসে যে বেতন আয় হয়, রকির সেই আয় হয় এক সপ্তাহেই। ট্যুর গাইড রকির গল্প শোনাচ্ছেন হৃদয় মুজাহিদ
মেহেদী হাসান রকির জন্ম জামালপুরে। বাবার সেনাবাহিনীর চাকরিসূত্রে বেড়ে উঠেছেন নানা জায়গায়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগ থেকে শেষ করেছেন পড়াশোনা। এরপর কিছুদিন চাকরিও করেছেন। সেই চাকরি ছেড়ে আবার হয়েছেন উদ্যোক্তা। রকি এখন দেশের প্রতিষ্ঠান ট্যুর গাইডদের মধ্যে অন্যতম।
তবে রকির শুরুটা একেবারেই সহজ ছিল না। কোনো মেন্টর বা অভিজ্ঞতা না থাকায় সব কাজ করতে হয়েছে নিজে নিজে। নিজের প্রচেষ্টায় নিজেকে নিয়ে এসেছেন অনন্য উচ্চতায়। ২০১৭ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সরস্বতী পূজাতে বিদেশি পর্যটক দেখতে পান রকি। সঙ্গে দেখেন একজন বাংলাদেশি বিদেশি পর্যটকদের নানা বিষয়ে বর্ণনা দিচ্ছেন। শুরুতে রকি ভেবেছিলেন এটা হয়তো অফিসের কেউ যে তাদের ঘুরতে নিয়ে এসেছেন। এরপর আলাপ করে জানলেন তিনি ট্যুর গাইড, যার কাজ হচ্ছে বিদেশি ট্যুরিস্টদের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করানো। সেই থেকে ভাবতে শুরু করলেন রকি।
তবে বন্ধুদের সঙ্গে পড়ালেখার সুবাধে সেই ভাবনাও আড়াল হতে বসেছিল তার। এক দিন আহসান মঞ্জিলে ঘুরতে গেলে সেখানে বিদেশি পর্যটক দেখতে পান এবং তাদের সঙ্গেও দেখতে পান ট্যুর গাইড। ভাবলেন, আমি চাইলেও তো এই পেশায় নিজেকে যুক্ত করতে পারি। শুরুর দিকে বিভিন্ন ট্যুর গাইডের অফিসে সিভি দিয়েছিলেন, কাজ হয়নি।
ঢাকার আশপাশে নানা জায়গায় এক সপ্তাহ ঘুরে, নানা বই পড়ে এবং ইউটিউব থেকে শিক্ষা নিয়ে শুরু করেন পথচলা। চলো বাংলাদেশ ট্যুরস নামক ফেসবুক পেজ এবং ওয়েবসাইট চালু করেন তিনি। এরপর ধীরে ধীরেই বেড়েছে তার নাম ও কর্মপরিধি।
চলো বাংলাদেশ ট্যুরস খোলার পর, অনেক দিন পার হয়ে গেলেও কোনো পর্যটকের দেখা পাননি। অপেক্ষার প্রহর বাড়তে থাকতে। মেইল, হোয়াটসঅ্যাপ চেক করেও কোনো বার্তা পাননি। এরপর এক দিন এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। রকি দেখতে পেলেন, এক ভারতীয় পর্যটক তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। বেশ খুশি হলেন রকি। কিন্তু সব ঠিক থাকলেও সেই ট্যুরিস্টের মা মারা যাওয়ায় আর আসা হয়নি তার। এরপর আরেক দিন মালয়েশিয়ার দুই পর্যটক কথা দিলেন আসবেন। অজানা কারণে তারাও আসেননি। এভাবেই শুরুতে আশার ঘরে হতাশা বাসা বাঁধে তার। তবে কি থেমে যাবে তার স্বপ্ন? এরপর চাকরি নেন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে। সেখান থেকে দেশের মানুষদের নিয়ে ঘুরতে থাকেন সিলেট, কক্সবাজার, রাঙামাটি, সেন্টমার্টিন, বান্দরবানসহ দেশের নানা জায়গায়। এভাবে কয়েক মাস চলার পর রকির সঙ্গে যোগাযোগ করেন নেপালের এক ট্যুরিস্ট। নাম তার নেত্র। আগ্রহ জানান বাংলাদেশ ভ্রমণের, তিনি নিজেও একজন ট্যুর গাইড। এরপর ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল রকির প্রথম বিদেশি পর্যটক নেত্র আসেন ঢাকায়। রকির জন্য দিনটি স্মৃতির এবং স্বপ্নের। নেত্রকে নিয়ে রকি ঘুরে দেখান ঢাকা, রাজশাহী, নওগাঁ, সোনারগাঁ। সেখান থেকে আয় হয় ৮৫০ ডলার। এরপর তার কদিন পরই পেয়ে যান অস্ট্রেলিয়ান এক পর্যটকের। এভাবেই ব্যস্ততা বাড়তে থাকে রকির।
হঠাৎ এক দিন জেফ্রি ক্লাইন নামে আমেরিকানের মেইল দেখে অবাক হয়ে যান রকি। যেখানে বিদেশি পর্যটকের মেইল এলে খুশি হওয়ার কথা সেখানে হতবাক হওয়ার কারণ ভদ্রলোকের বয়স। সত্তরোর্ধ্ব একজন ব্যক্তি বাংলাদেশ ঘুরে দেখতে চান। যিনি ইতোমধ্যে ঘুরে দেখেছেন বিশ্বের অনেক দেশ। জেফ্রি জানান, অনেক ট্যুরিস্ট কোম্পানিকে বললেও কেউ সাড়া দেননি তার মেইলের। অনেক ভেবে চিন্তে তার বুকিং কনফার্ম করেন রকি। মেইলে রকি জানান, শ্রদ্ধেয় জেফ্রি, নির্ভয়ে চলে আসুন, আমি আপনাকে আমাদের বাংলাদেশ ঘুরিয়ে দেখাব।
বিমানবন্দর থেকে ইন্টারকন্টিনেন্টালে যাওয়ার সময় রকি জিজ্ঞেস করেন, আপনি কেন এই বয়সে ঘুরে বেড়াচ্ছেন? জেফ্রি জানান, ঘরে বসে সিলিং দেখার চেয়ে ঘুরে বেড়ানো বেশি ভালো। এরপর জেফ্রিকে নিয়ে ঘুরেছেন পানামনগর, বড় সরদার বাড়িসহ নানা জায়গায়। হুইলচেয়ারে করে ঘুরতে বেশ সমস্যার মুখোমুখি হলেও জেফ্রিকে ঘুরে দেখিয়েছেন বাংলাদেশ।
ভ্রমণে ভয়ংকর অভিজ্ঞতারও মুখোমুখি হয়েছেন রকি। একবার নরওয়ে থেকে এসেছিলেন দুই পর্যটক- মার্তে ভাদলা ও এলিসিয়া গার্সিয়ার। কথা ছিল স্থানীয়দের মতো করে সব ঘুরে দেখাবেন। ঢাকায় কখনো রিকশায় আবার সিএনজিতে ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। এরপর তারা যেতে চান কুমিল্লার অদূরে মেঘনার চরে। পরিবেশের অবস্থা ভালো না থাকায় প্রথমে আগ্রহ দেখাননি, তবে দুজনের জোরাজুরিতে যেতেই হয়। উঠে বসলেন নৌকায়। বিকেলে সেখানে মজার সময় কাটিয়ে ফেরার পথে বাধে বিপত্তি। প্রচণ্ড কালবৈশাখী শুরু হয়। ঝোড়ো বৃষ্টিতে এবং অন্ধকারে ভয়ে তাদের অবস্থা কাহিল। এরপর অনেক কষ্টে তাদের নৌকা থামে জেটি ঘাটে। সেখানেই তারা বসে ছিলেন অনেকক্ষণ। এরপর সব স্বাভাবিক হলে বাড়ি ফেরেন।
এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, নেপাল, স্পেন, বেলজিয়াম, চেক প্রজাতন্ত্র, আয়ারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের বাংলাদেশ ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন রকি। এখন প্রতি মাসেই ১০-১৫ জন বিদেশি পর্যটক পান রকি। চলো বাংলাদেশ ট্যুরসে রকি শুধু একাই নন, উদ্যোক্তা হয়ে কয়েকজনের কাজের সুযোগ করে দিয়েছেন। কোনো পর্যটক আসতে চাইলে রকির চলো বাংলাদেশ ট্যুরস ফেসবুক বা ওয়েবসাইটে মেসেজ দিয়ে প্যাকেজ বুকিং করলেই ঘুরে দেখতে পারে বাংলাদেশের যেকোনো জায়গা।
জাহ্নবী