গত মঙ্গলবার রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ও মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় নিরাপত্তা শঙ্কায় ভুগতে থাকা দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ধৈর্য ধরে সরকারকে সাহায্য করার আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেছেন, আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান, বিভেদের সুযোগ নেই। এ সময় ৫৩ বছরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন ও বৈষম্যের বিচারে একটি কমিশন গঠনের দাবি জানান হিন্দু সম্প্রদায়ের জ্যেষ্ঠ নেতারা।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর কয়েক দিন কার্যত দেশে সরকার ছিল না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও তাদের দায়িত্ব পালনে শঙ্কা বোধ করে অনেকটা আড়ালে চলে গিয়েছিল। সেই সুযোগে কিছু দুষ্কৃতকারী দেশের বিভিন্ন এলাকায় লুটতরাজ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। অনেক দুষ্কৃতকারী হিন্দুদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করে বলেও জানা যায়। ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ। এখানে সব ধর্মের মানুষের স্বাধীনতা রয়েছে। যার যার ধর্ম সে তা পালন করে থাকে। এমনকি মুসলমানদের ঈদের দিনে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষও মুসলিম প্রতিবেশীর বাড়িতে দাওয়াত গ্রহণ করে থাকে। অন্যদিকে হিন্দুদের পূজা-পার্বণেও মুসলিম প্রতিবেশী তাদের আতিথেয়তা গ্রহণ করে থাকে। সে ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি দিনে দিনে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। উদার চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার কথা। কিন্তু কতিপয় ব্যক্তি তাদের হীনম্মন্যতা পোষণ করে সাম্প্রদায়িক এই সম্প্রীতিতে ফাটল তৈরি করার অপচেষ্টায় রয়েছে। আমরা আগেও লক্ষ করেছি, যখনই এ দেশে কোনো রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়, তখনই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়গুলো সামনে চলে আসে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর আমরা একটি বিষয় লক্ষ করেছি, তা হলো উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠী হিন্দুদের ওপর করা অত্যাচার-নির্যাতনকে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তারা ঢাল হয়ে মন্দির, পূজামণ্ডপ পাহারা দিয়েছে। হিন্দু প্রতিবেশীদের খোঁজখবর নিয়েছে। শিক্ষার্থীরা রাত জেগে মন্দির পাহারা দিয়েছে। হিন্দুপাড়াগুলোতে যাতে দুষ্কৃতকারীরা না ঢুকতে পারে, সে জন্য পাড়া-মহল্লার মুসলিম সম্প্রদায়ের অসংখ্য মানুষ রাত জেগে সতর্ক থেকেছে; যাতে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের খড়্গ না নেমে আসে। এ জন্য তাদের কার্যক্রমকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ভাই ভাই। কোনো অবস্থাতেই তারা একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। বরং বিপদে-আপদে সবাই সবার পরিপূরক।
অসাম্প্রদায়িক চেতনায় যারা বিশ্বাস করেন, তারা বলছেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ ও প্রতিরোধে প্রয়োজন টেকসই সমাধান। ধর্মীয় সংখ্যালঘু রক্ষায় আলাদা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি তৈরি করতে হবে। সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন করার বিষয়ে তারা মতামত ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দুরা অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও আজও তা থামেনি। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা যে ঘটছে তা বাস্তব সত্য। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, সংবিধানে যে অধিকার দেওয়া আছে তা ধর্ম-সম্প্রদায়নির্বিশেষে সব নাগরিকেরই প্রাপ্য। তিনি আরও বলেছেন, আমরা বৈষম্য নিরসনে কাজ শুরু করতে চাই এবং এটিই আমাদের অঙ্গীকার।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশে সংখ্যালঘুরাও এ দেশের নাগরিক। তাদের অধিকার সমুন্নত রাখতে দল-মতনির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের সেই ইতিবাচক মানসিকতা পোষণ করতে হবে। তাহলেই একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।