![স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় শিশুশ্রম যখন অন্তরায়](uploads/2023/11/30/1701315650.Shila-pramanik.jpg)
শিশুশ্রম একটি মারাত্মক সমস্যা। ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় শিশুশ্রম সম্পূর্ণরূপে অবৈধ। তবু এ সমস্যা সমাজকে গ্রাস করে রেখেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। যার মূলে রয়েছে অভাব। অভাবের তাড়নায় শিশুর মতো কোমলমতি প্রাণকে ব্যবহৃত হতে হচ্ছে তুচ্ছভাবে। যা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের যাত্রা পথে বাধাস্বরূপ। শিশুদের প্রয়োজন সাবলীল বিকাশ। যে বয়সে শিশুদের খেলাধুলা করার কথা সেই বয়সে তারা নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে খেলাধুলার অভাবে শারীরিক গঠনে ঘাটতি থাকছে। অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক শিক্ষার অভাবে মানস-গঠন দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যা একটি শিশুকে পূর্ণাঙ্গ বিকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে।
যদিও শিশুশ্রম একটি বৈশ্বিক সমস্যা। আইএলও সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমান বিশ্বের প্রায় ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশু নানাভাবে তাদের শ্রম বিক্রি করে চলেছে। এদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত প্রায় আট কোটি শিশু। ২০০৬ সালের শিশু সনদে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের সার্বিক শ্রম এবং ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ শ্রম আইন (সংশোধিত ২০১৮) অনুযায়ী ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে শ্রমে নিযুক্ত করা যাবে না। তবে ১৪ থেকে ১৮ বছরের শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ নয়, এমন কাজ করতে পারবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শিশুশ্রম সমীক্ষা ২০০৩ অনুযায়ী বাংলাদেশে শ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ছিল ৩২ লাখ। বাংলাদেশ সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে ২০২৩ সালে শিশুশ্রম সমীক্ষা অনুযায়ী শ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা হ্রাস পেয়ে ১৭ লাখে দাঁড়িয়েছে। যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্প গ্রহণ, সরকারি-বেসরকারি সংস্থার অংশগ্রহণ, সভা, সেমিনার, কঠোর মনিটরিং, মা-বাবা ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে গত এক দশকে শিশু শ্রমের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। এসডিজি-৪ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশকে সব ধরনের শিশুশ্রম থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০২১-২৫ প্রণয়ন করা হয়েছে। ফলে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শিশুশ্রম শূন্যের কোঠায় আনা সম্ভব হবে বলে বিশ্বাস।
শিশুশ্রমের কারণ হিসেবে দারিদ্র্যকে প্রধান বা অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিভিন্ন সমাজকর্মীর বক্তব্য থেকে উঠে আসে যে, কেবল দরিদ্রতাই শিশুশ্রমের অন্যতম কারণ নয়। অশিক্ষা, অসচেতনতা ও অনিশ্চয়তা শিশুশ্রমের অনেক বড় কারণ বলে মন্তব্য করা হয়। তবে অভিভাবকহীনতাও শিশুশ্রমের একটি বড় কারণ বলে আমি মনে করি। তাই এ সমস্যাগুলো অতি দ্রুত সমাধানের মাধ্যমে শিশুশ্রম যাতে বন্ধ করা সম্ভব হয় সেজন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
শিশুশ্রম বন্ধ না হলে, শিশুদের সব অধিকার নিশ্চিত করা না গেলে দেশের অগ্রগতি আশা করা যাবে না। প্রতিদিন অগণিত শিশু তাদের স্বপ্নকে বিলিয়ে দিচ্ছে কল-কারখানা কিংবা চায়ের দোকানে। ফলে শিশুশ্রম বন্ধ করে তাদের মৌলিক অধিকারগুলো ফিরিয়ে দিতে হবে। শিশুর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। একটি শিশুকেও অন্ধকারে রেখে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা মানে অন্ধকারে ঢিল ছোড়া
যদিও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে শিশুদের উন্নয়ন ও বিকাশে শিশু আইন প্রণয়ন এবং প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন। তিনি সংবিধানে শিশু অধিকার সমুন্নত রাখেন। জাতির পিতাকে অনুসরণ করে আওয়ামী লীগ সরকার শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যে ‘জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি-২০১০’ প্রণয়ন করেছেন। এ ছাড়া শিশুদের উন্নয়ন ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ‘জাতীয় শিশু নীতি-২০১১,’ ‘শিশু আইন-২০১৩,’ ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭’ এবং গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের অধিকার ও সুরক্ষায় ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫’ প্রণয়ন করা হয়েছে।
এসব নীতি যথাযথভাবে কার্যকর করার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা শিশুর মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারে এবং একটি উন্নত আধুনিক স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নের বাস্তব রূপ দেওয়া সম্ভব।
কারণ শিশুশ্রম বন্ধ করতে পারলে শিক্ষিত জাতি গঠন করা সহজ হবে। শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারলেই জাতিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করানো সম্ভব। সম্ভব হবে সমগ্র প্রজন্মকে আলোর পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। যদিও বাংলাদেশে শিশুশিক্ষা অবৈতনিক ও সর্বজনীন। শিক্ষার জন্য বছরের প্রথম দিন সব ছাত্রকে বিনামূল্যে বই দেওয়া হয়। প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে ৯০ শতাংশের অধিক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। তবে ঝরে পড়ার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। আর সেজন্য শিশুশ্রম বন্ধ করা একান্ত আবশ্যক।
কারণ শতভাগ শিশুকে বিদ্যালয়মুখী করতে না পারলে শিশুরা নানা রকম অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ে, জড়িয়ে পড়ে মাদকের নেশায়। একসময় অন্ধকার জগতে পা বাড়ায়। ফলে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারে পর্যবসিত হয়। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কবির ভাষায় ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে।’ শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। আর শিশুরা যদি বিপথে পরিচালিত হয়, শিক্ষালাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, মাদকাসক্ত হয়, বিভিন্ন রকম অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। তাই এখনই প্রয়োজন অভিভাবকরা যেন কোনো শিশুকে জোর করে কাজে না পাঠান। বরং এলাকার সবাই মিলে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের তালিকা তৈরি করে স্থানীয় মেয়র বা কাউন্সিলরের কাছে জমা দিতে পারেন। এতে করে একটি পরিকল্পনা করে তাদের পক্ষে এসব শিশুর জন্য সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারেন। কারণ শিশুশ্রম বন্ধ না হলে, শিশুদের সব অধিকার নিশ্চিত করা না গেলে দেশের অগ্রগতি আশা করা যাবে না।
প্রতিদিন অগণিত শিশু তাদের স্বপ্নকে বিলিয়ে দিচ্ছে কল-কারখানা কিংবা চায়ের দোকানে। ফলে শিশুশ্রম বন্ধ করে শিশুর মৌলিক অধিকারগুলো ফিরিয়ে দিতে হবে। শিশুর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। একটি শিশুকেও অন্ধকারে রেখে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা মানে অন্ধকারে ঢিল ছোড়া। তাই স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় শিশুদের শ্রমমুখী নয়, বিদ্যালয়মুখী করা আশু প্রয়োজন।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, চৌবাড়ী ড. সালাম জাহানারা কলেজ, কামারখন্দ, সিরাজগঞ্জ
[email protected]