![ট্রেন যোগাযোগ : কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রাম মানুষদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান](uploads/2023/12/02/1701496638.post-editorial.jpg)
১ ডিসেম্বর থেকে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে। এ সংবাদটি শুধু চট্টগ্রাম বা কক্সবাজারের মানুষদের জন্য আনন্দদায়ক নয়, পুরো দেশের মানুষের জন্য শুভ সংবাদ। এই ট্রেন চলাচলের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলের মানুষদের দীর্ঘ বছরের প্রতীক্ষার অবসান এবং সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে গেল। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আসবে বলে দেশের অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা ধারণা পোষণ করেছেন।
সত্যিই এ এক আশ্চর্য, বিস্ময়কর, অভূতপূর্ব, অবিশ্বাস্য এভাবে শত শত শব্দে বিশেষায়িত করলেও আবেগ-আনন্দ শেষ করা যাবে না। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের সঙ্গে দেশের অন্যান্য জেলার ট্রেন যোগাযোগ স্থাপন জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছাশক্তির সফল বাস্তবায়ন এবং সেই সঙ্গে একটি অভাবনীয়, ঐতিহাসিক স্বপ্নের প্রতিফলন! নতুন কাজ করতে যত না সহজ, তার চেয়ে অধিকতর কঠিন পুরোনো কাজকে পুনঃনির্মাণ পূর্বক উপযোগী করে তোলা। চট্টগ্রাম টু কক্সবাজার রেললাইন করতে গিয়ে অনেক বেশি ভুগিয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্তদের। কখনো কখনো কাজটি থমকে যাওয়ার উপক্রম হয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম টু চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী পর্যন্ত আগে থেকেই ৪৮ কিলোমিটারের রেললাইন ছিল। এ লাইনটি ব্রিটিশদের করা। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ লাইনকে সম্প্রসারণ করে সুদূর কক্সবাজারে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা এ সরকারই প্রথম গ্রহণ করে। এটি ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আজকে স্বাধীনতার ৫৩ বছরে এসে কক্সবাজারের সঙ্গে সমগ্র বাংলাদেশে ট্রেন যোগাযোগে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হতে দেখে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে অনেকের মতো আমিও সত্যিই গর্ব অনুভব করছি। ব্রিটিশ আমলের পুরোনো লাইন দিয়ে কক্সবাজারের যোগাযোগ স্থাপন করতে গিয়ে কতবার যে জরিপ কার্য পরিচালনা করতে হয়েছে তার হিসাবে নেই। পথে পথে যখন জরিপ কাজ এবং শেষে জায়গা অধিগ্রহণ করা হচ্ছিল তখনো পর্যন্ত কারও বিশ্বাসে ছিল না এই অবিশ্বাস্য ঘটনার আসল রূপটি অতি সহসা ধরা দেবে। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম টু দোহাজারী পর্যন্ত পুরোনো নড়বড়ে রাস্তা দিয়ে বৃহৎ পরিসরের ট্রেন চালানো সম্ভব হবে কি না এটি নিয়েও মানুষের মনে সন্দেহের কমতি ছিল না। কারণ আগে থেকে এই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন কয়েক জোড়া লক্কর-ঝক্কর ট্রেন চলাচল করত। অতীব দুর্ভাগ্যের বিষয়, যে ট্রেনগুলো এই লেনে চলাচল করত তা দিয়ে যাতায়াত করা উপযোগী ছিল না। আমার বাড়ি পটিয়ায় হওয়ার কারণে একসময় ধলঘাট স্টেশন হয়ে শহরে যাতায়াত করতাম। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাড়ি থেকে ট্রেনে করে শহরে যাতায়াত করেছি। এরপর বিগত ৩৩ বছর পর্যন্ত এই রোড দিয়ে আসা-যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। তার একমাত্র সমস্যা অনুপযোগী ট্রেন ব্যবস্থাপনা। যেখানে কোনো রকম বসার সুব্যবস্থা ছিল না, ভাঙাচোরা সিট, ট্রেনের ভেতরে ভূতুড়ে অন্ধকার লাইটিংয়ের ব্যবস্থা ছিল না, দরজা-জানালা নষ্ট, জরাজীর্ণ, অপরিষ্কার, যাত্রী কম্পার্টমেন্টে মালামাল তুলে দেওয়া, যত্রতত্র মলমূত্র পড়ে থাকা, মাদকসেবী ও ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য, যাত্রীদের নিরাপত্তাঝুঁকি, আবার চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়া ও গন্তব্যে পৌঁছার মধ্যে কোনো রকম সময়জ্ঞান না থাকা এ ধরনের প্রচুর সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছে এই রোডে যাতায়াতকারী ট্রেন যাত্রীদের। মূলত এসব কারণে সাধারণ যাত্রীরা ট্রেন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। অথচ এমন একটা সময় ছিল বোয়ালখালী, পটিয়া, চন্দনাইশ উপজেলার মানুষদের যাতায়াতের একমাত্র বাহন ছিল ট্রেন যোগাযোগ। আজ থেকে ৩০ বছর আগে ২ টাকা, ৩ টাকা এবং সর্বশেষ ৫ টাকার টিকিট ক্রয় করে চট্টগ্রাম শহরে এসেছি। রেলওয়ের সার্বিক অব্যবস্থাপনার কারণে সেদিনটি কোথায় যেন হারিয়ে গেল! বহু বছর পর আবার নতুন করে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সফল রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সত্যিই এ এক আশ্চর্য, বিস্ময়কর, অভূতপূর্ব, অবিশ্বাস্য এভাবে শত শত শব্দে বিশেষায়িত করলেও আবেগ-আনন্দ শেষ করা যাবে না। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের সঙ্গে দেশের অন্যান্য জেলার ট্রেন যোগাযোগ স্থাপন জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছাশক্তির সফল বাস্তবায়ন এবং সেই সঙ্গে একটি অভাবনীয়, ঐতিহাসিক স্বপ্নের প্রতিফলন! নতুন কাজ করতে যত না সহজ, তার চেয়ে অধিকতর কঠিন পুরোনো কাজকে পুনঃনির্মাণ পূর্বক উপযোগী করে তোলা
প্রধানমন্ত্রীর প্রবল আকাঙ্ক্ষার কারণে গত ১১ নভেম্বর কক্সবাজারে দেশের আইকনিক ট্রেন স্টেশন ও রেল যাত্রার উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে রামু স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছান। এ সময় রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার মানুষ প্রধানমন্ত্রীকে হাত নেড়ে স্বাগত ও অভিবাদন জানান। সেদিন পুরো কক্সবাজারে উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়। ট্রেন যাত্রার সংবাদ এখন এতদাঞ্চলের সবচেয়ে বড় সংবাদ হিসেবে সংবাদকর্মীদের চোখেও ধরা পড়েছে। লাখ লাখ মানুষ ফিরে পাবে রেলের নিরাপদ বাহন। এটি ভাবতে নিজের মধ্যে কী যে আনন্দ লাগছে ভাষার প্রকাশ করার মতো নয়। ১ ডিসেম্বর থেকে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন যাত্রা সূচন হতে চলেছে। ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত দিনে আপাতত একজোড়া ট্রেন চলাচল করবে। এর কয়েকদিন পর থেকে চট্টগ্রাম থেকেও কক্সবাজার ট্রেন চলাচল শুরু হবে। ঢাকা থেকে ইতোমধ্যে ট্রেনের টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে। রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, ১১ দিনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য এটি একটি নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন।
১৯৩১ সালে ব্রিটিশের করা পুরোনো জরাজীর্ণ কালুরঘাট সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচলে যে সন্দেহের দানা বেঁধে ছিল পুনঃনির্মাণের মধ্য দিয়ে সে ভয়-আতঙ্ক উপড়ে ফেলেছে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইনটি ২০১০ সালের ৬ জুলাই এ প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। কাজ ধরতে গিয়ে জমি অধিগ্রহণ এবং অন্যান্য খাতে ব্যয় বেড়ে যায়। এ জন্য মাঝখানে কয়েক বছর প্রকল্পের কাজ থমকে দাঁড়ায়। ২০১৭ সাল নাগাদ পুনঃবাজেট অনুমোদন লাভ করলে প্রকল্পটি গতি ফিরে পায়। ২০১৮ সালে রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কাজটি ২০২২ সালের ৩০ জুন শেষ করার কথা থাকলেও, করোনার কারণে আবারও ধীরগতিতে চলতে শুরু করায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়। ২০২৩ সালের অক্টোবরে প্রকল্পের কাজ প্রায় ৯০ শতাংশ সম্পন্ন করা হয়। ৫ নভেম্বর পরীক্ষামূলক প্রথম পরিদর্শন ট্রেন কক্সবাজার গমন করেন। ট্রেন যাওয়ার পথে মানুষের কী যে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস তা বর্ণনাতীত। কেউ কেউ নেচে-গেয়ে ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়ে মোবাইলে সেলফি তুলে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ করেছে। এই প্রথম কক্সবাজার অভিমুখে ঘন ঘন ট্রেনের হুইসেল বাজিয়ে যাওয়ার পথে ঘরবাড়ি ছেড়ে মানুষ তখন ট্রেনের রাস্তায় ওঠে আসে নতুন অতিথিকে সাদরে বরণ করতে। অনেকে এই অতিথিকে এভাবে দেখবে কল্পনাতেও ভাবেনি তাই অকস্মাৎ ছুঁয়ে চোখেমুখে আনন্দ অশ্রু বর্ষণ করেছে। দর্শনার্থীদের ভিড়ের কারণে সেদিন পরিদর্শক টিম অনেক জায়গায় ঠিকমতো পরীক্ষা-নীরিক্ষা চালাতে হিমশিম খেয়েছে আবার অনেক জায়গায় করতেও পারেনি। আমি বলব এ প্রকল্প প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার সার্থক প্রতিফলন। তার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই।
রেললাইন, স্টেশন, সেতু, কালভার্ট নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) সহায়তা দিয়েছে ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা বাকি ৪ হাজার ১১ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দিয়েছে। নতুন এই রেললাইন চালু করতে গিয়ে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১ হাজার ৩৬৩ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুনভাবে স্টেশন করা হয়েছে ৯টি। নতুন স্টেশনগুলো হলো- দোহাজারী স্টেশন, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ইসলামাবাদ, রামু ও সর্বশেষ কক্সবাজার আইকনিক স্টেশন। আর চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত আগের রেলস্টেশনগুলো ছিল ঝাউতলা, ষোলশহর, জানালীহাট, গোমদন্ডী, বেঙ্গুরা, ধলঘাট, খানমোহনা, পটিয়া, চক্রশালা, খানমোহনা, খরনা, হাসিমপুর, দোহাজারী। সম্প্রতি কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মিত হয়েছে। এই দুই রোডই দক্ষিণ চট্টগ্রামে যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এবং একই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পোন্নয়নে বিপুল অবদান রাখবে। দক্ষিণ চট্টগ্রাম তথা কক্সবাজার-টেকনাফ পর্যন্ত সরকার এবং ব্যক্তি মালিকানায় বড় বড় প্রকল্প ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যেখানে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে বোয়ালখালী, পটিয়া, আনোয়ারা, সাতকানিয়া ও বাঁশখালীতে বৃহৎ বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে। কক্সবাজারে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত তো আছেই এ ছাড়া চকরিয়া চিংড়ি প্রজেক্ট ও লবণ শিল্পের জন্য বিখ্যাত। মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গড়ে তোলা হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর, বিদুৎকেন্দ্র। আছে চুনতী অভায়রণ্য, ডুলাহাজারা খ্রিষ্টীয়ান হাসপাতাল, চন্দনাইশে বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি, বাঁশখালিতে ইকোপার্ক, বিদুৎকেন্দ্র, যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের ফলে টেকনাফ, কক্সবাজার, চকরিয়া, মহেশখালী থেকে খুব সহজে পণ্যসামগ্রী চট্টগ্রাম শহর হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়বে। এ ছাড়া আনোয়ারা উপজেলায় কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার (কাফকো), চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার (সিইউফল), পারকি বিচ, কর্ণফুলী উপজেলায় কেইপিজেড ও ইয়ংওয়ানের মতো বিশ্ববিখ্যাত শিল্পপ্রতিষ্ঠান শতাধিক ফেক্টরি খুলেছে যেখানে লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। পটিয়া ও বোয়ালখালীতেও বহু সংখ্যক গার্মেন্টসশিল্পসহ অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে। দক্ষিণ চট্টগ্রাম এবং টেকনাফ, কক্সবাজার পর্যন্ত বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান থাকলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন উন্নত ছিল না। তাই কর্মরত শ্রমিক, কর্মচারী-কর্মকর্তা, দক্ষিণ চট্টগ্রামের শিক্ষার্থী এবং চট্টগ্রাম শহর তথা বৃহত্তর চট্টগ্রামে ব্যবসায়ী ও অফিস-আদালতে কর্মরতদের সীমাহীন কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করতে হতো। এই ট্রেন যোগাযোগের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও নতুন নতুন শিল্পায়নে গতি ফিরে পাবে।
লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
[email protected]