![বাঙালির ঐতিহ্য: শীতের পিঠা](uploads/2024/02/08/1707361071.Hasan-ul-Bari.jpg)
প্রাচীনকালে পিঠাকে মিষ্টান্নের মধ্যেই ধরা হতো। ‘পিঠা’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘পিষ্টক’ শব্দ থেকে। আবার ‘পিষ্টক’ এসেছে ‘পিষ’ ক্রিয়ামূলে তৈরি হওয়া শব্দ ‘পিষ্ট’ থেকে। পিষ্ট অর্থ চূর্ণিত, মর্দিত, দলিত। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গীয় শব্দকোষ বইয়ে লিখেছেন, পিঠা হলো চালের গুঁড়া, ডালবাটা, গুড়, নারিকেল ইত্যাদির মিশ্রণে তৈরি মিষ্টান্নবিশেষ। বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য ধান। ধান থেকে চাল হয় এবং সেই চালের গুঁড়া পিঠা তৈরির মূল উপকরণ। ভারতীয় সভ্যতার প্রেক্ষাপটে বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতিতে পিঠা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার নির্দিষ্ট কোনো বিবরণ নেই, তবে সংস্কৃত সাহিত্যে ‘পিষ্টক’ শব্দটির উল্লেখ মেলে। বাংলা ভাষায় লেখা কৃত্তিবাসী, রামায়ণ, অন্নদামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, মনসামঙ্গল, চৈতন্য চরিতামৃত ইত্যাদি কাব্য এবং মৈমনসিংহ গীতিকার কাজলরেখা গল্পকথনের সূত্র ধরে আনুমানিক ৫০০ বছর আগেও বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতিতে পিঠার জনপ্রিয়তার কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। সুতরাং বোঝাই যায় যে, বাংলার পিঠা তৈরির ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার ঘরে ঘরে পিঠা তৈরি হয়ে আসছে। সেই সময় বাংলার কৃষিপ্রধান সমাজে ধান ছিল প্রধান খাদ্যশস্য।
ষড়ঋতুর দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। শীতকাল এগুলোর অন্যতম ঋতু। শীতকালে নতুন ধান ওঠে। সেই ধানে ঘরে ঘরে পিঠা বানানোর উৎসব শুরু হয়। নতুন চালের গুঁড়া আর খেজুর রসের গুড় দিয়ে বানানো হয় নানারকম পিঠা। এগুলোর নানারকম নাম, আবার নানারকম রূপের বাহার। ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, পুলি পিঠা, দুধপুলি ও পাটিসাপটা বেশ জনপ্রিয়। এ ছাড়া তালের পিঠা, কলা পিঠা, নকশি পিঠা, পাকান পিঠা, কুশলি, তেলে ভাজা পিঠা, পায়েস পিঠা, সেমাই কুলি পিঠা, শামুক পিঠা, গোলাপ পিঠা, লবঙ্গ পিঠা, পাকড়া পিঠা, ডিমের ঝাল পিঠা, মালপোয়া, মালাই পিঠা, বিবিখানা, দুধচিতই, চষি পিঠা, ক্ষীরকুলি, দুধে ভেজানো হাতকুলি ছাড়াও হরেক রকম পিঠা তৈরি হয় বাংলার ঘরে ঘরে। বাংলাদেশে কত শত রকমের পিঠা যে তৈরি হয় তার কোনো তালিকা আজও করা সম্ভব হয়নি। প্রত্যেক বছর বাংলাদেশ শিশু একাডেমি জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে পিঠা মেলার আয়োজন করে থাকে, যেখানে শতাধিক পিঠা প্রদর্শিত হয়। পায়েস, ক্ষীর ইত্যাদি মুখরোচক খাবারগুলোও আমাদের রসনাকে তৃপ্ত করে শীতকালে। এ সময় শহর থেকে অনেকেই গ্রামে যায় পিঠা খেতে। তখন গ্রামের বাড়িগুলো নতুন অতিথিদের আগমনে মুখর হয়ে ওঠে। পিঠা ছাড়া শীতকালে বাঙালির আতিথেয়তাও যেন সম্পূর্ণ হয় না। শীত এলেই বাঙালির পারিবারিক রীতি অনুযায়ী মেয়ে-জামাতাকে দাওয়াত করে আনা হয়। বাড়ির সদস্য ছাড়াও জামাই-ঝি, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশী সবাই মিলে এক আসরে বসে চলত পিঠা খাওয়ার মহোৎসব। যদিও এখন যান্ত্রিক ব্যস্ততার যুগে পরিবারের সবাই মিলে গ্রাম-বাংলার সেই রসাল পিঠা-পায়েস খাওয়ার উৎসবের রীতি অনেকটাই ম্লান হয়েছে। পানির বাষ্পে তৈরি ভাপের মধ্যে দানা গুড় গলে তৈরি হওয়া মিষ্টি মজাদার পিঠার নাম ভাপা পিঠা। এটি বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী পিঠা। সাধারণত শীত মৌসুমেই ঘরে ঘরে ভাপা পিঠা তৈরির ধুম পড়ে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা ও দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মালদহে ভাপা পিঠা ভাক্কা পিঠা নামে পরিচিত। বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে এখন গোটা মালদহ শহরের বিভিন্ন রাস্তায় অসংখ্য দোকান তৈরি হয়েছে ভাক্কা পিঠার।
বাংলার পিঠার ইতিহাসের সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবের এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। যেমন, নবান্ন, পৌষসংক্রান্তি, চৈত্রসংক্রান্তি, বৈশাখী, ঈদ, শারদীয় দুর্গাপূজা, জামাই খাওয়া, বিয়ে, খতনা, জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী ইত্যাদি উৎসবে পিঠা তৈরি ও খাওয়ার বহুল প্রচলন রয়েছে। এই পিঠা তৈরি আর খাওয়া বাংলার মানুষ এমন এক উচ্চপর্যায়ে নিয়ে গেছে, যা যুগে যুগে বাংলার কবি-সাহিত্যিকের কলমে বারবার উঠে এসেছে। পিঠাকে ঘিরে ‘পল্লীস্মৃতি’ কবিতায় বিখ্যাত কবি বেগম সুফিয়া কামাল লিখেছেন, ‘পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশীতে বিষম খেয়ে/ আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।’
এ ছাড়া পৌষ-পার্বণ কবিতায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লিখেছেন-
‘আলু তিল গুড় ক্ষীর নারিকেল আর।
গড়িতেছে পিঠেপুলি অশেষ প্রকার।
বাড়ি বাড়ি নিমন্ত্রণ, কুটুম্বের মেলা।
হায় হায় দেশাচার, ধন্য তোর খেলা।’
বর্তমানে দেশের প্রায় সব শহরের অলিতে গলিতে, রাস্তার মোড়ে, পাড়া-মহল্লার ফুটপাতে শীতকালে ভাপা ও চিতই পিঠা বানিয়ে বিক্রি করা হয়। এজন্য বিদেশিরা এসব পিঠার নাম দিয়েছেন স্ট্রিট কেক। এক শ্রেণির মৌসুমি পিঠা বিক্রেতা শীতকালে পিঠা তৈরির এ ধরনের ব্যবসা করে থাকেন। এ ছাড়া অনেক বড় বড় হোটেলে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘পিঠা উৎসব’ বা ‘পিঠামেলা’ আয়োজন করা হয়। বড় হোটেলগুলোতে হোম ডেলিভারির সুবিধা থাকায় গ্রাহকরা ঘরে বসেই পাচ্ছেন বাহারি পিঠার স্বাদ। পিঠা বাঙালি সংস্কৃতির একটি অন্যতম উপাদান।
প্রবাসী বাঙালিদের কেন্দ্র করে বিদেশে পিঠা বাজারজাতকরণের মাধ্যমে আমরা বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি। ফলে দেশের অর্থনীতির চাকা বেগবান হবে এবং হারিয়ে যাওয়াসহ নতুর নতুন পিঠা উদ্ভাবনে বাঙালি মায়েরা সচেষ্ট হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
শীত এলে পিঠাপুলির কদর বেড়ে যায় বহুগুণ। পৌষ-পার্বণ তথা পিঠা-পার্বণের এ আনন্দ ও ঐতিহ্য যুগ যুগ টিকে থাকুক বাংলার ঘরে ঘরে। শিল্পবিপ্লবের যুগে শহরের মায়েরা পিঠা বানানো ভুলে গেলেও গ্রামের মায়েরা কিন্তু এত দ্রুত ভুলে যাননি। আশা করি, তারাই বাঁচিয়ে রাখবেন বাংলার পিঠাকে যুগ থেকে যুগান্তরে।
লেখক: শিক্ষক, মিলেনিয়াম স্কলাস্টিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, জাহাঙ্গীরাবাদ সেনানিবাস, বগুড়া
[email protected]