
ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায়, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় রমজানকে কেন্দ্র করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কোনো নজির নেই। বরং মূল্য অনেকাংশে হ্রাস পেত এবং এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) সবাইকে উৎসাহ দিতেন। তার নির্দেশনা মেনে সাহাবায়ে কেরাম সারা বছর ব্যবসা করলেও রমজানের এক মাস সব ঝামেলামুক্ত হয়ে নিজেকে আল্লাহর জন্য সঁপে দিতেন। শিল্পপতি সাহাবিরা সওয়াবের আশায় কম মূল্যে পণ্য বিক্রি করে দিতেন। তাই রমজান মাসকে কেন্দ্র করে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় এবং পরবর্তী চার খলিফার সময়কাল ও সাহাবিদের যুগে কখনোই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কোনো ঘটনা ঘটেনি।
মজুতদারী করে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং একে পাপ বলেছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। তিনি বলেছেন, ‘পণ্য আমদানিকারক রিজিকপ্রাপ্ত। আর যে মজুতদার মূল্য বৃদ্ধি করে, সে অভিশপ্ত।’ (ইবনে মাজাহ, ২১৫৩)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘শুধু পাপী ব্যক্তিই মজুতদারী করে থাকে।’ (মুসলিম, ১৬০৫)। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের ওপর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে মজুতদারী করবে, সে পাপী।’ (সিলসিলায়ে সহিহা, ৩৩৬২)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যে ব্যক্তি খাদ্যশস্য মজুত রাখে, আল্লাহ তার ওপর দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন।’ (আবু দাউদ, ৫৫)। আরেক হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিনের খাবার মজুত রাখে, সে আল্লাহর জিম্মা থেকে বেরিয়ে যায়।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, ২০৩৯৬)।
ব্যবসায়িক পণ্য বিক্রি না করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বর্ধিত মুনাফা আদায়ের প্রচেষ্টা শুধু ইসলাম নিষিদ্ধ করেনি। বরং এটিকে সামাজিক অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি সেখানে (হারামে) অন্যায়ভাবে কোনো ধর্মদ্রোহী কাজ করতে চাইবে, আমি তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাব।’ (সুরা হজ, ২৫)। হাফেজ ইবনে কাসির (রহ.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, মক্কায় পণ্য মজুতকারী ব্যক্তিদের বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে ইবনে কাসির, ৫/৪২৩)। ইমাম গাজালি (রহ.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘মজুতদারী জুলুমের শামিল এবং এ আয়াতের ধমকির অন্তর্ভুক্ত।’ (এহইয়াউ উলুমিদ্দিন, ২/৭৩)।
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, ‘মক্কায় মজুতদারী হারামে ধর্মদ্রোহী কাজের অন্তর্ভুক্ত।’ (এহইয়াউ উলুমিদ্দিন, ১/২৪৩)। উমর (রা.) বলেছেন, ‘তোমরা মক্কায় খাদ্যদ্রব্য মজুত করো না। কারণ তা ধর্মদ্রোহী কাজ।’ (আল মাওসিলি, আল ইখতিয়ার লি তালিলিল মুখতার, ৪/১৬০)।
এ ছাড়া মজুতদারী যেহেতু এক প্রকার জুলুম, সেহেতু কোরআনের যেসব আয়াতে জুলুম হারাম করা হয়েছে, সাধারণভাবে সেগুলো দ্বারাও মজুতদারী হারাম হওয়ার দলিল গ্রহণ করা যাবে। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি (রহ.) বলেছেন, ‘বেশি দাম পাওয়ার আশায় পণ্য মজুত করে রাখা সম্পূর্ণ নিষেধ বা হারাম। কারণ নাগরিকদের প্রয়োজন সত্ত্বেও নিছক উচ্চমূল্যের আশায় পণ্য আটকে রাখা তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করার শামিল। যে ধরনের মুনাফা লাভের আশাতেই তা করা হোক, এটা নগরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির নামান্তর।’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, ২/২০২)।
লেখক : আলেম, গবেষক ও সাংবাদিক