
অ্যাকশন এইড ডেনমার্ক আয়োজিত কোপেনহেগেন পিপল পাওয়ার সম্মেলন বিশ্বব্যাপী অধিকারকর্মীদের এক মিলনমেলা। গত ৮ থেকে ১০ এপ্রিল ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে দ্বিতীয়বারের মতো আয়োজিত এ সম্মেলনে নিজেদের কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে অংশ নেন বিভিন্ন দেশের নবীন-প্রবীণ অধিকারকর্মীরা। বাংলাদেশি তরুণ অধিকারকর্মী হিসেবে সেখানে আমন্ত্রণ পান তাপসী দে প্রাপ্তি। সেই অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন আজকের লেখায়।
কোপেনহেগেন পিপল পাওয়ার সম্মেলনে এ বছর অংশ নেন বিশ্বের ২৭টি দেশের ৩ শতাধিক অধিকারকর্মী। এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ছিল শান্তির জন্য সামাজিক আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। তিন দিনব্যাপী সম্মেলনে অধিকারকর্মীদের অংশগ্রহণে আয়োজিত হয় প্রায় ২৪টি বৈঠক। বৈঠকে আমরা অধিকারকর্মীরা কীভাবে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াতে পারি, সাম্রাজ্যবাদ ও স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার বিপরীতে যেভাবে সামাজিক আন্দোলন শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে, বৈশ্বিক ক্ষমতা নির্দিষ্ট কিছু দেশ ও নীতিনির্ধারকের হাতে কুক্ষিগত না হয়ে যেভাবে সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারে এমন সব বিষয় উঠে আসে পারস্পরিক আলোচনায়। আবার আমাদের দেশের মতো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নানা সময় ঘটে গেছে বিপ্লব, গণ-অভ্যুথান। বিভিন্ন দেশের ছাত্র-জনতার বিপ্লবের কৌশল, সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা ভাগাভাগি করে নেওয়ার সুযোগ হয় সম্মেলনে।
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন ছিল ‘ডে আফটার টুমোরো’ শীর্ষক বৈঠক। বিশ্বের যেসব দেশে সম্প্রতি ঘটে গেছে গণ-অভ্যুথান, সেসব দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেন বৈঠকে। গণ-অভ্যুথান-পরবর্তী বাংলাদেশের কথা জানাতে তরুণ প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিই প্যানেলিস্ট হিসেবে। প্যানেলে আরও ছিলেন শ্রীলঙ্কা ও সার্বিয়ার প্রতিনিধিরা। সেখানে বাংলাদেশের ওপর গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী অর্থনৈতিক চাপ, বিভিন্ন বিষয়ে বহির্বিশ্বের অযাচিত চাপ, গুজব প্রচার প্রসঙ্গে মতামত প্রকাশের সুযোগ হয় সবার সঙ্গে। আবার একই সঙ্গে বাহরাইন, সিরিয়ার মতো দেশগুলোর প্রতিনিধিদের কাছেও জানতে পারি তারা কীভাবে যুদ্ধাবস্থায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে এবং সেগুলো সামাল দিচ্ছে।
সম্মেলনজুড়ে মনে হয় ইউক্রেন থেকে মায়ানমার, ফিলিস্তিন থেকে সার্বিয়া প্রতিটি দেশের সাধারণ মানুষের যুদ্ধটা যেন একই সূত্রে গাথা। দেশ, জাতি ভিন্ন হলেও শোষণের বিরুদ্ধে সবার গল্প অনেকটা একইরকম। আবার ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে অনেকেই বলে থাকেন, দীর্ঘ সময় নিপীড়নে জর্জরিত ফিলিস্তিনের মানুষ সুখ চায়। তবে সম্মেলনে ফিলিস্তিনি অধিকারকর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর মনে হয়েছে, ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষ সুখের চেয়েও বেশি স্বাধীনতা চায়।
সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন বিভিন্ন দেশের নারী অধিকারকর্মীরা। আফগানিস্তান, ইরানের মতো রক্ষণশীল দেশের নারীরা কীভাবে আজও স্বাভাবিক জীবন যাপন এবং মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য লড়ছেন, সে গল্প উঠে আসে মুখোমুখি। মনে হয়, বিশ্বব্যাপীই নারীদের অধিকারের স্বাধীনতা ও অধিকারের লড়াইটা সহজ নয়। বরং সমতার জন্য এই লড়াই আরও সময়সাপেক্ষ। পৃথিবীর যেসব দেশে যুদ্ধ চলছে সেখানে নারী ও শিশুদের অবস্থা আরও নাজুক। তবে সেখানে অসীম সাহসিকতায় কীভাবে নারীরা লড়াই করে চলছেন, সে অভিজ্ঞতাও জানান দেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের নারী অধিকারকর্মীরা।
এ আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য সব দেশের মানবাধিকারকর্মীকে একই সুতোয় গাঁথা। সম্মেলন শেষে দেশে ফিরেও নিয়মিত যোগাযোগ হয় ভিনদেশি অধিকর্মী বন্ধুদের সঙ্গে। পৃথিবীটা যেন এভাবেই আরও ছোট হয়ে এসেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লড়াই, বিপ্লবের প্রক্রিয়া একেক রকম। সম্মেলনে একে অন্যের অভিজ্ঞতায় পেয়েছি সাহস ও ঋদ্ধতা।