বর্ষসেরা উদ্ভাবক টমাস চের্মাক ও আনা পোডমানিকা। ছবি: সংগৃহীত
টিনএজারদের জন্য পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ‘দ্য আর্থ প্রাইজ।’ প্রকৃতি, পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষায় সারা বিশ্বের টিনএজাররা প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় নিজেদের বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন নিয়ে। এ বছর দ্য আর্থ প্রাইজের বর্ষসেরা উদ্ভাবক হয়েছে স্লোভাকিয়া ও চেকিয়ার দুই কিশোর-কিশোরী। এ ছাড়া বিশ্বের সাতটি অঞ্চল থেকে বিজয়ী হয়েছে মোট ১৭ জন। চলো জেনে নিই এবারের বিজয়ী ও তাদের উদ্ভাবন সম্পর্কে।
বর্ষসেরা উদ্ভাবন ‘পুরা’
আমাদের এ পৃথিবীর প্রায় ৭০ ভাগই পানি। তবুও নিরাপদ পানির জন্য হাহাকার পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্তেই। ‘পুরা’ এমন এক পানি পরিশোধক যন্ত্র যা আলো ও প্লাজমার শক্তি ব্যবহার করে পানি থেকে দূষিত পদার্থ আলাদা করে এবং পানি থেকে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া সরিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। পানি পরিশোধনের বিশেষ এ যন্ত্রটি উদ্ভাবন করেছেন স্লোভাকিয়ার ১৯ বছর বয়সী কিশোর আনা পোডমানিকা এবং চেকিয়ার ১৮ বছর বয়সী কিশোরী টমাস চের্মাক। উদ্ভাবক আনা পোডমানিকা স্লোভাকিয়ার একজন তরুণ বিজ্ঞানী। চেক প্রজাতন্ত্রের বাসিন্দা টমাস চের্মাক একজন অটিজম সমর্থক এবং চেক একাডেমি অব সায়েন্সেসের ইনস্টিটিউট অব প্লাজমা ফিজিক্সের গবেষক। এবারের আর্থ প্রাইজের হাজার হাজার প্রকল্পের ভেতর বর্ষসেরা উদ্ভাবন ও উদ্ভাবকের খেতাবটি তাদের ঝুলিতেই।
এশিয়ার ‘থার্মাভল্ট’
বাড়িতে শুধু খাবার সংরক্ষণ করতেই নয়। হাসপাতালে ওষুধ, রক্ত, অঙ্গ প্রতিস্থাপনের বিভিন্ন সরঞ্জাম সংরক্ষণেও রেফ্রিজারেটর একমাত্র অবলম্বন। প্রত্যন্ত গ্রামে যেখানে আজও পৌঁছায়নি বৈদ্যুতিক সুবিধা, সেখানে চিকিৎসাসেবা মোটেই সহজ নয়। ভারতের তিন টিনএজার ধ্রুব চৌধুরী, মিথ্রান লাধানিয়া এবং মৃদুল জৈন শিশুকুঞ্জ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ইন্দোরের ছাত্র। তারা উদ্ভাবন করেছে লবণচালিত এক রেফ্রিজারেটর থার্মাভল্ট। এটি চালাতে বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় না বরং অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড এবং বেরিয়াম হাইড্রোক্সাইড অক্টাহাইড্রেট ব্যবহার করে এ রেফ্রিজারেটর চলতে পারে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা। আর তাতে সংরক্ষণ করা যায় রোগীর প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিনসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম। এশিয়া থেকে নির্বাচিত সেরা উদ্ভাবকের এ দল ইতোমধ্যেই ১২০টি সুবিধাবঞ্চিত হাসপাতালের জন্য ২০০টি থার্মাভল্ট ফ্রিজ তৈরির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
আফ্রিকার ‘প্রিজার্ভ আওয়ার রুটস’
জলবায়ুর পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী এখন প্রাণী ও মানুষের আতঙ্কের কারণ। নাইজেরিয়ার ১৭ বছর বয়সী পরিবেশকর্মী আমারা সি এনওনেলি ‘প্রিজার্ভ আওয়ার রুটস’ প্রকল্পের উদ্যোক্তা। এ প্রকল্পের মধ্যদিয়ে এনওনেলি নাইজেরিয়ার পরিত্যক্ত জিনিস ব্যবহার করে শহরের দূষিত স্থানে গড়ে তুলেছে অসংখ্য পরিবেশবান্ধব ছোট পার্ক। কীভাবে একটি ডাস্টবিনকে খেলার মাঠে রূপান্তর করা যায়- এমন ভাবনা থেকেই এই কিশোরী গড়ে তোলে এমন প্রকল্প। প্রাণ, প্রকৃতি ও সবুজায়ন ফিরিয়ে আনতে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন দেশে সাড়া ফেলেছে তার এ উদ্যোগ। আর সেই সঙ্গে জিতে নেয় আফ্রিকার সেরা আর্থ প্রাইজ বিজয়ীর খেতাব।
মধ্যপ্রাচ্যের ‘সাসটেইনেবিলিটি হিরো’
মধ্যপ্রাচ্যের আরব আমিরাতের চার কিশোরী উদ্ভাবক ইসরা আশরাফ, আলমাহা আলমানসুরি, ফাতমা হুসেন এবং জৌরি আব্দুল্লাহর দল ‘সাসটেইনেবিলিটি হিরো।’ পরিবেশ রক্ষায় এআই-নির্ভর অ্যাপ ‘ইকোমাইন্ড একাডেমি’ তৈরি করে এ বছর আর্থ প্রাইজের সেরা উদ্ভাবকের তালিকায় নাম লিখিয়েছে তারা। তাদের এ অ্যাপের মাধ্যমে সহজেই বর্জ্যব্যবস্থাপনা এবং পুনর্ব্যবহার করা যায়। এর মাধ্যমে বর্জ্য পোড়ানো হ্রাস করা এবং টেকসই পরিবেশ গঠন সম্ভব। এ এআই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ভার্চুয়াল সহকারীর সাহায্যে শিক্ষার্থীরা পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারবে।
ওশেনিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ‘কুলটিবাদো’ অ্যাপ
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি কৃষিনির্ভর দেশ ফিলিপিন্স। তবে দেশটিতে খাদ্য, কৃষিপণ্য সরবরাহ এবং শৃঙ্খলাজনিত অদক্ষতার কারণে প্রায় ৩০ ভাগ কৃষিপণ্যই নষ্ট হয়। এর ফলে শুধু খাদ্যসংকট ও অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধনই হয় না, মিথেন নির্গমন হয়ে পরিবেশদূষণের ঘটনাও ঘটে। কৃষি, অর্থনীতি এবং পরিবেশ বাঁচাতে ফিলিপাইনের দুই কিশোরী হেইলি এবং ইউম তৈরি করেছে কুলটিবাদো নামে একটি বিশেষ অ্যাপ। এ অ্যাপের মাধ্যমে কৃষক, ভোক্তা এবং সমবায়কে সহজেই একসঙ্গে যুক্ত করা যায়। ফলে মূল্য নিয়ন্ত্রণকারী মধ্যস্থতাকারীদের ছাড়াই কৃষকরা ন্যায্যমূল্যে গুছিয়ে খাদ্য সরবরাহ করতে পারে। এবার ওশেনিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চল থেকে সেরা উদ্ভাবকের স্বীকৃতি পেল হেইলি এবং ইউম।
উত্তর আমেরিকার ‘কিরিবোর্ড’
প্লাস্টিকের যত্রতত্র ব্যবহার শোষণ করে চলছে পৃথিবীর পরিবেশ ও জলবায়ু। কীভাবে প্লাস্টিকের ব্যবহার আরও একটু কমানো যায় এমন ভাবনা ছিল নিউইয়র্কের স্টুইভেসান্ট হাইস্কুলের তিন টিনএজার ঝি হান, ফ্লিন্ট এবং জেমসের মাথায়। অবশেষে তারা সেই উপায় খুঁজে পায় জাপানের কাগজশিল্প কিরিগামি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। পোর্টেবল কার্ডবোর্ড শিটকে কিরিগামি শিল্পের মতো জ্যামিতিক ভাঁজ দিয়ে তৈরি করে বিশেষ এক প্যাকেজিং পন্থা ‘কিরিবোর্ড।’ এর ফলে প্যাকেজিংয়ে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ফিলারের প্রয়োজন হয় না। জৈব ও পচনযোগ্য এ পরিবেশবান্ধব প্যাকেজিং উদ্ভাবন করে উত্তর আমেরিকার সেরা আর্থ প্রাইজ উদ্ভাবকের খেতাব অর্জন করে নিয়েছে এই তিন টিনএজার।
মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার ‘ইকো অ্যাকশন’
ব্রাজিলের ইসাক কারভালহো ‘ইকোঅ্যাকশন’ নামক প্রকল্পের জন্য বিজয়ী হয়েছে। সে এআই এবং উপগ্রহভিত্তিক ডেটা বিশ্লেষণ করে পরিবেশের সবুজায়ন এবং পরিবেশ শীতল করতে প্রকল্প তৈরি করেছে। তার প্রকল্পটি নগর জলবায়ু বিশ্লেষণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং উপগ্রহ চিত্র ব্যবহার করে। চরম তাপ প্রশমনে উদ্ভিদের জন্য সবচেয়ে কৌশলগত অবস্থানগুলো চিহ্নিত করে, যাতে পরিবেশ শীতল করতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তা জানা যায়। পরিবেশকে বাসযোগ্য করতে কাজ করে যাচ্ছে হাইস্কুল পড়ুয়া ইসাক।