বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে জলাবদ্ধতায় জমিতে পলি পড়ে উপকূলের ভূ-প্রকৃতিতে পরিবর্তন এসেছে। চিংড়ি চাষ বন্ধ হওয়ায় চাষের জমিতে লবণাক্ততাও কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ফলে বেলে-দোআঁশ মাটিতে তরমুজ চাষে বদলে গেছে এখানকার কৃষি অর্থনীতি। কয়েক বছর আগেও লবণাক্ততায় এক ফসলি আমন ধানের পর সারা বছর বিঘার পর বিঘা জমি পতিত পড়ে থাকত। সেই বিরান ভূমিতে এখন সুখের বাতাস বইছে।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, খুলনার উপকূলীয় দাকোপ, কয়রা, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় এ বছর ১২ হাজার ৯৬৫ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছে। হেক্টরপ্রতি ফলন হয়েছে ৩৫ টন। উৎপাদিত তরমুজ বিক্রি করে খরচ বাদে প্রতি হেক্টরে লাভ থাকছে প্রায় ৫ লাখ টাকা।
এক ফসলি আমনের পর লবণাক্ত জমিতে এতদিন ফসল না হওয়ায় কৃষকদের দিন কাটত দুশ্চিন্তায়। কিন্তু পতিত জমিতে তরমুজ চাষ সেই চিত্র বদলে দিয়েছে। এখন তরমুজের মাঠে তপ্ত রোদ উপেক্ষা করে স্বপ্নের বীজ বুনছেন চাষিরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতিদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ট্রাক-পিকআপ নিয়ে তরমুজ কিনতে খুলনার প্রত্যন্ত এলাকায় আসছেন বেপারিরা। তরমুজের খেত দেখেশুনে বিঘা হিসাবে ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দর নির্ধারণ করা হচ্ছে। বড় আকারের ভালো তরমুজ হলে বিঘাপ্রতি দাম পাওয়া যাচ্ছে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত। সকালেই কৃষকরা মাঠের কাজে লেগে যান। কেউ মাঠে তরমুজ কাটছেন, কেউ তা ঝুড়ি বা বস্তায় ভরে ট্রাকে তুলছেন। আবার কেউ ট্রাকে তরমুজ সাজিয়ে রাখছেন। তরমুজ বিক্রির নগদ টাকা হাতে পেয়ে প্রখর রোদ আর ভ্যাপসা গরমের মাঝেও খুশির ঝিলিক প্রত্যন্ত উপকূলের চাষিদের মুখে।
বটিয়াঘাটা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক জানান, সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় এবার পানির সংকটে এখানে কৃষিতে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তার পরও এবার বটিয়াঘাটায় ২ হাজার ১৬০ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছে। প্রত্যেক কৃষকই তরমুজ বিক্রি করে ভালো দাম পেয়েছেন। বটিয়াঘাটার সুখদাড়া গ্রামের চাষি তিমির বিশ্বাস জানান, আগে এখানকার জমি ফেলানো থাকত। আমনের পর আর কোনো ফসল হতো না। কিন্তু তরমুজ চাষে কৃষকদের ভাগ্য বদলেছে। বাজারে ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে। কৃষকদের পাশাপাশি যারা তরমুজ খেতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন তাদের জীবন-জীবিকায়ও পরিবর্তন এসেছে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, খুলনায় উৎপাদিত তরমুজের ৭০ শতাংশ হয় দাকোপ উপজেলায়। এ বছর দাকোপের সিটিবুনিয়া, বটবুনিয়া বিল, তিলডাঙ্গা, পানখালী, কামারখোলা, চুনকুড়ি ও তালতলা বিলে ৫ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে। তরমুজের চাষ পদ্ধতি নিয়ে বিভিন্ন সভা, লিফলেট বিতরণ, রোগবালাই নির্ণয়, প্রতিকার নিয়ে কাজ করছেন কৃষি কর্মকর্তারা।
সেচের পানিসংকট: উপকূলীয় এলাকায় সেচের পানিসংকট কৃষিকাজে বড় চ্যালেঞ্জ। শুষ্ক মৌসুমে অধিকাংশ নদী-খালের পানি লবণাক্ত হওয়ায় তরমুজ খেতে সেচ দিতে সমস্যা হয়। চলতি বছর বৃষ্টি না হওয়ায় এই ভোগান্তি আরও বেড়েছে। তবে ক্লাইমেট স্মার্ট টেকনোলজিতে মিনি পুকুর প্রযুক্তি জমিতে সেচ দিতে সহায়তা করেছে। এই পদ্ধতিতে জমির এক প্রান্তে ছোট পুকুর খনন করে সেখানে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হয়। শুষ্ক মৌসুমে এই পানি স্বল্প চাহিদাসম্পন্ন ফসলের সেচকাজে ব্যবহার করা হয়।
প্রকল্প কর্মকর্তা ফজলুল হক মনি বলেন, বটিয়াঘাটা, দাকোপ, কয়রায় সেচের পানির অভাব রয়েছে। সেচের অভাবে এখানে বিগত দিনে ফসল নষ্ট হতো। এখন মিনি পুকুর প্রযুক্তিতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে সেখান থেকে জমিতে সেচ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া মাটির ওপর হালকা পলিথিন দিয়ে গাছপালার গোড়া, সবজি খেত ঢেকে দিয়ে পলি মালচিং পদ্ধতিতে চাষাবাদের ফলে জমিতে ৫ ভাগের ১ ভাগ পানি সেচের প্রয়োজন হয়। এসব পদ্ধতিতে উৎপাদন বেড়েছে। কৃষকদের জীবন-জীবিকার পরিবর্তন এসেছে।
তরমুজ চাষি তিমির বিশ্বাস বলেন, সময়মতো সেচ দেওয়া গেলে শতভাগ পতিত জমি তরমুজ চাষের আওতায় আনা যাবে। এরই মধ্যে প্রকল্প কর্মকর্তারা সুখদাড়া বিলে পুরোনো চারটি মিনি পুকুরের পাশাপাশি আরও ২০টি নতুন মিনি পুকুর খননের কাজ শুরু করেছেন।
নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি: দাকোপের সিটিবুনিয়া, বটবুনিয়া বিল ও বটিয়াঘাটা সুখদাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, অসংখ্য নারী সকাল থেকে তরমুজের খেতে কাজ করছেন। ভোরে স্বামী-সন্তানদের পাশাপাশি তারাও খেতে পানি ও নিড়ানি দিচ্ছেন, আগাছা পরিষ্কার করছেন। সার ও কীটনাশক দিতে সহায়তা করছেন। আবার অনেক নারী দিনমজুর হিসেবে খেতে কাজ করছেন। নারী শ্রমিক করুণা মণ্ডল বলেন, তরমুজের তিন মাসে কেউ ঘরে বসে থাকে না। তরমুজ চাষে, বিশেষ করে নারী শ্রমিকের ব্যাপক কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।
পরিবর্তন গ্রামীণ অর্থনীতিতে: তরমুজ বিপণন ঘিরে গ্রামের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। জেলা শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত পিচ ঢালা রাস্তায় ট্রাক-পিকআপ চলাচল করছে। কৃষক খেত থেকেই সরাসরি তরমুজ বিক্রি করছেন। যেখানে আগে এক বিঘা জমি থেকে সারা বছরে ৩০ হাজার টাকা পাওয়া যেত না, এখন সেখানে তরমুজ চাষে তিন মাসেই বিঘাপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লাভ হচ্ছে। ফলে পরিবর্তন এসেছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, বাড়ির অবকাঠামো উন্নয়নসহ দুবেলা-দুমুঠো খেতে পারছেন উপকূলের মানুষ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, উপকূলের বিরান ভূমি এখন সবুজে ভরে গেছে। প্রতিবছরই তরমুজ চাষের আওতায় চাষের জমি বাড়ছে। তরমুজ চাষে কৃষি অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তরমুজ চাষে নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন এখানকার মানুষ।