ঢাকা ৮ চৈত্র ১৪৩১, শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫
English

নিঃশব্দ প্রত্যয়ে ঔপন্যাসিক হাসান আজিজুল হক

প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০৫ পিএম
আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০২:৩০ এএম
হাসান আজিজুল হক
আঁকা: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

হাসান আজিজুল হকের সব উপন্যাসই ব্যক্তিচৈতন্য উৎসারিত। ধ্যান-জ্ঞান-খেয়ালে তিনি একজন নিবিষ্ট কথাশিল্পী। তিনি কবিতা লেখেননি, কিন্তু উপন্যাসের ভাষা কবিতার মতো হৃদয়স্পর্শী। সৃজন-মননের অনন্যতায় জীবন-সময়-অভিজ্ঞতা সবকিছু দিয়ে তা পাঠককে আবিষ্ট করে। তার অপ্রকাশের ভারনামক গ্রন্থেও রয়েছে এই আবিষ্টতার প্রমাণ। আসলে মানবজীবনে নিঃশব্দে ঘাত-সংঘাত চলছে বিরামহীনভাবে। দেশে-সমাজে বহু কোটি মানুষের সেই নিঃশব্দ বিস্ফোরণের সংবেদ সাহিত্যিকের কাছে থাকতে হয়। হাসান আজিজুল হকের উপন্যাসে তা গভীর প্রত্যয়ে উপস্থাপিত।…

হাসান আজিজুল হক তখনো পরিপূর্ণ উপন্যাস লেখেননি, দু-একটি ঔপন্যাসিকা রচনা করেছেন। সাহিত্যিক অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় তাকে জানালেন, ‘হাসান আজিজুল হক, আপনার একটি সম্পূর্ণ উপন্যাস কবে পড়তে পাব? আপনার কথায়, গল্পে উপন্যাসে আপনি জলজ্যান্ত আঁকতে পারেন, এবং আপনার সব বৃত্তিকে কাজে লাগাতে পারেন। ...একটি সম্পূর্ণ উপন্যাস কবে পাঠককে উপহার দেবেন?’ একসময় তার নিজেরও নাকি আশঙ্কা ছিল- উপন্যাস লেখা সম্ভব হবে কি না! কিন্তু একে একে সাবিত্রী উপাখ্যান, বিধবাদের কথা, আগুনপাখি, শিউলি, বৃত্তায়ন ও শামুক তার কলমে উঠে আসে। উভয় বাংলার অবিসংবাদিত গল্পকার হিসেবে খ্যাত এই মানুষটি জন্মেছিলেন বর্ধমানের কঠোর আনুশাসনিক সমাজে। সেই সঙ্গে তা ইতিহাসের জটিল এক সময়পর্ব। কালের নির্জলা বাস্তব প্রতিফলিত হয়েছে তার কথকতায়। প্রবল অনুভব আর তীক্ষ্ণ যন্ত্রণার সামনে দাঁড়ানো তার চরিত্রগুলো। বহমান জীবন, সংগ্রাম আর কালের সত্য সেখানে মিলেমিশে একাকার। হাসান আজিজুল হকের বেশির ভাগ শিল্পই ব্যক্তি-প্রভায় স্নাত। কোনো লেখকই বোধহয় শূন্যস্থান থেকে সাহিত্য নির্মাণ করেন না। কথাসাহিত্যের কথকতায়ও তার এই অনুভব ব্যক্ত হয়েছে। এমনকি তার জীবনস্মৃতি, ব্যক্তিকথন, সাক্ষাৎকার কী বক্তৃতায় ঘুরেফিরে যেন সমান প্রতিধ্বনি। 

আগুনপাখি ও সাবিত্রী উপাখ্যান লেখকের শৈশব ও কৈশোর স্মৃতিঋদ্ধ। আখ্যানে সচেতনভাবে গ্রামজীবনকে সঙ্গী করেন তিনি। আন্তরিক ও প্রাঞ্জল ভাষা তার শৈল্পিকবৈশিষ্ট্য। মানুষের অন্তর্লোক উন্মোচনে এই লেখকের দক্ষতা বারবার প্রমাণিত। জগদীশ গুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল ও দ্বিতীয় সমরোত্তর কি ভারতের স্বাধীনতাপূর্ব ও পরবর্তীকালের লেখকদের সঙ্গে তার যেন সমিলবন্ধন। মানবমনের রহস্য ও জটিলতা উন্মোচনে নৈপুণ্য তার অনায়াস; তবে কখনো বেশি অন্তর্মুখী, অতি সূক্ষ্ম, সাংঘাতিক ব্যঙ্গবক্র। ষাটের নিরীক্ষাপ্রবণ কথাসাহিত্যের কর্ণধারদের একজন তিনি। দেশভাগোত্তর সমাজের সংখ্যাতীত বিষয় তার শিল্পের উপজীব্য। তার বক্তব্যে, ‘সাহিত্য কখনো বিচ্ছিন্ন দ্রব্য নয়, কারখানা থেকে গড় গড় করে বেরিয়ে আসে না, সমাজ-কাঠামোর সঙ্গে তার গাঁটছড়া এতই শক্ত যে সেটাকে ছিঁড়ে ফেলার কথাই ওঠে না।’ 

সাবিত্রী উপাখ্যানে সাবিত্রীর বৈধব্যদশার চিত্র সামান্য। এর পরিপূর্ণতা রয়েছে বিধবাদের কথায়। উপন্যাসিকা হলেও এটি উপন্যাসের সহোদর। অধুনা বড় গল্প, বড় ছোটগল্প ও উপন্যাসের প্রকৃতি দ্বন্দ্ব-বিতর্কের সবই আসলে আখ্যান। চিহ্ন-প্রতীক-সংকেত ভাঙতে ভাঙতে বিধবাদের কথা হয়ে ওঠে প্রামাণ্য ঐতিহাসিক আকর। ধর্ম-জাতিসত্তা, রক্তাক্ত কাল, শিহরণকারী হিংসা-প্রতিহিংসা এতে রূপায়িত। পিতা-পুত্র, ভাই-ভাইয়ের আদিম সংঘর্ষ যেন নারকীয় অন্ধকারের মুখোমুখি করে। নির্মমতা-জিঘাংসার রক্ত-ক্লেদ-পুঁজ মাখা শিশুদেশটি যেন বিধ্বংসী বাস্তবতা। ট্রাজিক অনুভব আখ্যানটিকে বিশিষ্ট করে তোলে। রাহেলা-সালেহা সহোদর দু-বোনের গায়ের রং ভিন্ন- এ বিরোধাভাস ইতিহাসের মতোই জটিল। অসীম ধৈর্যের নারী এতে জীবন্ত হয়েছে ‘মা’ নামক এক বিরাট সত্তায়, যারা এখন বিধবা। প্রতীকী ছোট আখ্যানটি যেন বাংলাদেশের জন্মলগ্ন।

২০০৬ সালে প্রথম প্রকাশিত আগুনপাখির পটভূমি দেশভাগ। নারীর জবানে তা বাস্তুভিটার প্রতি মমত্ববোধের মানবিক আখ্যান। এতে রয়েছে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ, ব্রিটিশ-বিদ্রোহ, ভারত-স্বাধীনতা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রসঙ্গ। ব্যক্তিকেন্দ্রিক না হলেও, আধুনিক ব্যক্তিসত্তার উদ্বোধন ঘটেছে এতে। ফিরে যাই ফিরে আসি, উঁকি দিয়ে দিগন্ত কিংবা এই পুরাতন আখরগুলি- এই তিন আত্মজৈবনিক স্মৃতিকথার জগতের সঙ্গে এর অদ্ভুত সাদৃশ্য লক্ষণীয়। বর্ধমানের উপভাষায় উপন্যাসটির বর্ণনা চলিষ্ণু। লেখক-চৈতন্যের সঙ্গে উপভাষা-সংযোগে তৈরি হয় ভিন্নতর এক আখ্যানবিশ্ব।
 
যৌথ পরিবার-উদ্ভুত চেতনা হাসান আজিজুল হকের মজ্জায়-শিরায়। কথক মেজোবউয়ের নস্টালজিক স্মৃতির ভাষা তীব্র বেদনাদায়ক। স্বশিক্ষিত গৃহস্থ এ নারী তো কালের প্রতিক্রিয়া। বহমান বাংলায় নারী কর্ত্রী হলেও, সংসারের কর্তা নয়। এ ছাড়া আগুনপাখি-তে বাবা চরিত্র, আত্মীয়-স্বজনরা ঘুরে ফিরে এসেছে। আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্যও রয়েছে এতে। এ রকম উপন্যাসের পরিবেশ ও চরিত্রে লেখকের আত্ম-উপস্থিতি শনাক্ত করা সম্ভব। ডেভিড কপারফিল্ড পড়লেই যেমন ডিকেন্সের কথা মনে পড়ে, ফিলিপ মনে করিয়ে দেয় সমারসেট মমকে, তেমনি অপু চিনিয়ে দেয় বিভূতিভূষণকে, শ্রীকান্ত শরৎচন্দ্রকে। এ প্রসঙ্গে দেবেশ রায়ের কথা স্মরণযোগ্য, ‘উপন্যাসের ফর্মের প্রয়োজনেই ঔপন্যাসিককে কোনো না কোনোভাবে উপন্যাসের ভেতরে উপস্থিত থাকতে হয়।’ এই থাকাটাই একটি উপন্যাসকে সত্য ও বাস্তব করে তুলতে পারে। 

শামুক উপন্যাসসমগ্রে নেই, আলাদাভাবে ২০১৫ সালে প্রকাশিত। তবে শামুকই হাসান আজিজুল হকের প্রথম উপন্যাস- হাত মকশোর সময়ে লেখা। এটিও কৈশোরিক অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ। প্রধান চরিত্র গ্রামের ছেলে মুনীর সেখানে লেখক হয়ে উঠতে চায়। এ আখ্যানে প্রকৃতির বর্ণনা ও মুনীর যুগপৎ বিভূতি-হাসানের মিলিতস্থল। জীবনের গভীর সম্ভাবনা ও পরিণতির ইঙ্গিত এই মুনীর। হাসান আজিজুল হকের পরিণত বয়সের লেখায় প্রেম অনুপস্থিত। কিন্তু শামুক উপন্যাসে প্রেম এসেছে। তবে সে-প্রেম রোমান্টিক স্বপ্নের নয়, বিষাদের অশ্রুরেখা। পাখির মতো ডানা থাকলেও যন্ত্রণাদগ্ধ তেলাপোকার শাপগ্রস্ত ঘৃণ্যজীবন মুনীরের। শামুকের বর্ণনায়, ‘তেলাপোকা পাখি নয়। ...ডানা থাকলেই পাখি হয় না, উড়তে পারলেও না। বোধহয় ওড়ার ইচ্ছাটাই পাখির। ...কিন্তু তার পক্ষচ্ছেদ হয়েছে, উড়তে গেলেই মাটিতে পড়ে।’ পুরো কাহিনিজুড়ে অশুভ ছায়া ঢেকে রাখে একটি বৃহৎ জনপদ। ঔপনিবেশিক সমাজ, ইংরেজি শিক্ষা, কেরানির জীবন, প্রেমের অপরিণতি সবই বিদ্ধ করে নায়ককে; যেন শামুকের খোলসে নিবদ্ধ এক জীবন। ব্যক্তি-যন্ত্রণা, পরিবার, বিকাশ, দ্বন্দ্ব, সংঘাত, অচরিতার্থতা সব মিলে সুতীব্র সমাজ-সংকট।  
   
চল্লিশের উত্তাল সময়, দেশভাগ ও বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতির বেদনা শিউলি আখ্যানে চিত্রিত। শিউলির ছত্রিশ বছরের নিরুৎসব নিঃসঙ্গ, নিষ্ঠুর জীবন-সংগ্রামের জন্য দায়ী দেশভাগ। কেরানি পিতার ভয়াবহ দৈন্য, অপূর্ণতা-অতৃপ্তির বুকফাটা আর্তনাদে প্রকম্পিত আকাশ-বাতাস। বৃত্তায়ন আখ্যানটি হাসান আজিজুল হকের আত্মপ্রতিকৃতি কি না, তা স্পষ্টভাবে বলা কঠিন। তবে এর মধ্য দিয়েও কালের অমোঘ সত্য প্রকাশিত। তরুণ বয়সে রাজশাহী পদ্মাপারের জীবনের অভিক্ষেপ রয়েছে এতে। জীবনের উত্তাল আবেগ, পদ্মাপারের শিমুল-কৃষ্ণচূড়ার সৌরভ, তীব্র গভীর দার্শনিক অনুভব আর পঠনের ব্যাপকতায় সতৃষ্ণ জ্ঞানের জগতে লীন তিনি। হেমিংওয়ের দি স্নোজ অব কিলিমানজারো, দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি, হুসার্ল-এর ফেনোমেনলজি, হাইডেগারের বিয়িং অ্যান্ড টাইমের দর্শন ও সাহিত্যবোধে তা আলোকিত। প্রাগৈতিহাসিক যৌন-আকাঙ্ক্ষায় চালিত জীবনের গূঢ়-অন্ধকারকে তিনি সামনে এনেছেন। সমগ্র মানবজগতের গভীর নিয়তি-সন্ধান, অসভ্যতা, জিঘাংসা, অনাঘ্রাত কামনা-অন্বেষা দার্শনিক অভিজ্ঞতা হয়ে উঠেছে। জিদ ও মরিয়কের উপন্যাসের মতো দার্শনিকসত্তার প্রকাশ বৃত্তায়ন। কিন্তু মরিয়কের মতো আদিপাপ নয়, অন্যদিকে ব্যক্তিপ্রধান ইউরোসেন্ট্রিক আখ্যানের আভিজাত্য থেকেও হাসান আজিজুল হক স্বতন্ত্র। সে অর্থে তার অন্বিষ্ট- রম্যাঁ রল্যাঁ, জ্যুল রম্যাঁ, দু হামেলের মতো আত্মজিজ্ঞাসু, সমাজমুখী, বলিষ্ঠ ও প্রগতিশীল ঐতিহাসিক দৃষ্টি। আত্মকেন্দ্রিক মনোবিশ্লেষণ নয়, বৃহত্তর সমাজের গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের আখ্যান রচনায় তিনি বেশি আগ্রহী।

কবিতার কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৫, ০৪:২১ পিএম
কবিতার কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
শক্তি চট্টোপাধ্যায়

জীবনানন্দোত্তর বাংলা কবিতার প্রধান কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। জন্ম ১৯৩৩ সালের ২৫ নভেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার জয়নগরে। পিতা রামনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা কমলা দেবী। কর্মজীবনে কবি বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থাকলেও কোনো পেশায় দীর্ঘস্থায়ী ছিলেন না। একসময় ব্যবসা, পরবর্তীতে শিক্ষকতা, তার পর মোটর কোম্পানিতে চাকরি এবং শেষবার ১৯৭০ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজ করেছেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘হে প্রেম, হে নৈশব্দ’ (১৯৬১); প্রথম উপন্যাস ‘কুয়োতলা’ (১৯৬১)। স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ‘আনন্দ পুরস্কার’ (১৯৭৫), ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’ (১৯৮৩)-সহ একাধিক পুরস্কার। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম- এরকম লাইন আমি লিখেছি, কিন্তু নিজের কাছে এ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিনি, অন্য দিকে চলে গেছি। এই লাইনটি বরং শক্তির ক্ষেত্রে সত্যি। ভয়ংকর খাদের কিনারা ধরে হেঁটে যাওয়া।…

ভাষা ও স্বাধীনতা হলো জাতির অস্তিত্ব ও মুক্তি

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৫, ০৩:৩৩ পিএম
ভাষা ও স্বাধীনতা হলো জাতির অস্তিত্ব ও মুক্তি

‘ভাষা’ ও ‘স্বাধীনতা’ কবিতার অন্ত্যমিলের মতোই পাশাপাশি দুটি অন্তর্নিহিত শক্তিশালী শব্দ। ভাষা হলো একটি জাতির অস্তিত্ব আর স্বাধীনতা হলো জাতির মুক্তি। বাঙালিরা এই দুটি শব্দের জন্য সংগ্রাম করেছে এবং জীবন দিয়ে। প্রথমেই আসা যাক, কীভাবে ভাষা একটি জাতির অস্তিত্ব বা পরিচয়? ধরুন একটি নদী, কলস্রোতা নদী, ধীরে ধীরে সেই নদীটি পানি হারাচ্ছে, একসময় সেই নদীটি মরে গেল। আসলে পানি ছাড়া নদী বাঁচে না, ভাষাও পানির মতো, জাতির ভাষা হারিয়ে গেলে, সেই জাতি আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যায়। কীভাবে হারিয়ে যায়? চলুন সেদিকে একটু নজর দেওয়া যাক। আমরা জানি, বর্তমানে পৃথিবীতে ১৯৫টি দেশে ৭ হাজার ৯৯টি ভাষা প্রচলিত আছে। অর্থাৎ কোনো কোনো দেশে একাধিক ভাষা আছে, খুব কাছে থেকে উদাহরণ দিচ্ছি- আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বর্তমান জনসংখ্যা ১৪০ কোটি ৭৫ লাখ ৬৩ হাজার ৮৪২ জন এবং তাদের ২৮টি অঙ্গরাজ্যে সাংবিধানিক স্বীকৃত ২২টি ভাষা রয়েছে (তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া)। 

১৯৯৪ সালে লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় তার কলকাতার বাসায় আমার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘দেখো পৃথিবীতে তোমরাই একমাত্র সংগ্রামী ও গৌরবান্বিত জাতি, যারা মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ দিয়েছ, সুতরাং ভাষার মর্যাদা যে জাতি দেয়, সে জাতি পৃথিবীতে ভাস্বর হয়ে থাকে’ কথাটি বলছিলেন পশ্চিমবঙ্গে ৫০ বছর পর বাংলা ভাষার প্রচলন থাকবে কি না, এই প্রসঙ্গে। কারণ হিসেবে বলেছেন যে, ‘কখনো কখনো একটি ভাষা অন্য একটি ভাষাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলে। যেমন হিন্দির যে প্রভাব ও বিস্তার ঘটছে পশ্চিমবঙ্গে, তাতে আশঙ্কা করছি এখানে বাংলা ভাষা ৫০ বছর বিলুপ্ত হয়ে যায় কি না।’ এই যে বাংলা ভাষার কথা তিনি বললেন, সেটির ত্যাগ ও মহিমার কথা একবার চিন্তা করুন সবাই। 

আমরা সবাই জানি, ‘১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও বস্তুত এর বীজ রোপিত হয়েছিল বহু আগে; অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত অধিরাজ্য নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। পাকিস্তানের ছিল দুটি অংশ: পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান অধিরাজ্য সরকার পূর্বপাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলাকে ইসলামীকরণ তথা আরবীকরণের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে আরবি হরফে বাংলা লিখন অথবা সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আরবি করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়। আবার পুরো পাকিস্তানের সব ভাষা লাতিন হরফে লেখার মাধ্যমে বাংলার রোমানীকরণের প্রস্তাবও করা হয়। এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভ জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। কার্যত পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি। ফলস্বরূপ মাতৃভাষা বাংলার সমমর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে রফিক, সালাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এমএ ক্লাসের ছাত্র বরকত ও আব্দুল জব্বারসহ আরও অনেকে। শহিদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহিদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিকশাচালক আউয়াল এবং অলিউল্লাহ নামের এক কিশোর। ২৩ ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। এ নির্লজ্জ, পাশবিক, পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মুসলিম লীগ সংসদীয় দল থেকে সেদিনই পদত্যাগ করেন। ভাষা আন্দোলনের শহিদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে রাতারাতি ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহিদ মিনার, যা ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন, শহিদ শফিউর রহমানের পিতা। ২৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শহিদ মিনারের উদ্বোধন করেন, দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। ক্রমবর্ধমান গণ-আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রবর্তিত হয়’। 

এখন আমাদের করণীয় কী? করণীয় হলো- সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা। শুদ্ধ বাংলা চর্চা করা, কথনে, পঠনে ও লিখনে বাংলাকে সুন্দর করে যত্ন করা। এই যত্নে অবহেলা করা যাবে না। কারণ মনে রাখতে দুটি কথা- ১. এই ভাষা প্রতিষ্ঠা হয়েছে রক্তের বিনিময়ে ও ২. ভাষার মর্যাদা না দিলে, চর্চা না করলে, মায়ের মলিন মুখের মতোই হয়ে যাবে, জলবিহীন নদীর মতোই ধীরে ধীরে মরে যাবে। মনে রাখতে হবে ভাষা জাতির আত্মা। আমরা নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইংরেজি কিংবা অন্যান্য প্রয়োজনীয় ভাষা ব্যবহার করব, তবে তা মাতৃভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে বা পাশ কাটিয়ে বা অপমান করে নয়। হাজার বছরের লালিত নিজস্ব পরিচয়ের শক্তি ভাষাকে পাশ কাটালে, নিজেকেই ঠকানো হবে। শিশুরা যেমন দুধ খেতে মায়ের কাছে গিয়ে আবদার করে, তেমনি ভাষাও শিশুর মতো, তাকে হাতে হাতে পরম্পরায় না রাখলে, সে অভিমান করে, পালিয়ে অগোচরে। ভাষা প্রাণ, ভাষা প্রাণ। তাকে জীবিত রাখতে হয়। ভাষার এই জীবনের নাম আদর। তাই আসুন ভাষাকে আদর করি- ভাষা ও দেশ, মায়ের নন্দিত মুখ। ভালোবাসি দেশ, স্বাধীনতা যুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশ।

পুরোনো রণক্ষেত্র

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৫, ০৩:২৪ পিএম
আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৫, ০৩:২৫ পিএম
পুরোনো রণক্ষেত্র
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

ধুলোবালি মাখা বাতাস বইছে। চোখ মেলে তাকানো যায় না। পেছনের রিকশা থেকে গলা বাড়িয়ে শিউলি জিজ্ঞেস করে- আর কয় মাইল হবে আলম ভাই?
মাইল চারেক, কষ্ট হচ্ছে খুব?
না, ঠিক আছে।

শাহ আলম মাথা ঘুরিয়ে পেছনের রিকশাটার দিকে তাকায়। পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের শরীরটা আগের মতো নেই বলে সহজেই পাড়ি দেওয়া গেছে। অমসৃণ মেঠো পথের ঝাঁকুনি সত্ত্বেও অনেকদূর আসা গেছে। কংক্রিটের সড়ক হলেও দেশ স্বাধীনের পর খুব একটা মেরামত হয়নি। এমন সড়কে হাঁটা তবু ভালো, রিকশায় চাপলে জান বেরোবার জোগাড় হয়।

শেরপুর পেরোতেই সড়কের চেহারা আরও সঙ্গিন মনে হয়। যত্রতত্র ইঁদুরের গর্ত। ট্রাক ও মহাজনি মোষের গাড়ি চলে খাদ-খন্দকে বেহাল বানিয়েছে সড়ক। অতএব দুজন নারী সহযাত্রীর অবস্থা সহজেই অনুমান করতে পারে শাহ আলম। বৃদ্ধ ভদ্রমহিলা অনেকটা পথ শক্তি সঞ্চয় করে টিকেছিলেন। ভেবেছিলেন- কষ্ট তো হবেই। কিন্তু আরও মাইল কয়েক চলার পর শরীরটাকে আর সামলে রাখতে পারলেন না তিনি। মেয়ে শিউলির বুকে মাথা রেখে বললেন- আমাকে একটু ধরবি, মা।

ঢাকা থেকে বাসে জামালপুর পৌঁছাতেই পাঁচ ঘণ্টার বেশি লেগেছে। বৃদ্ধার শরীর ভেঙে গেছে তখনি। তবু কিছু বলেননি। কিন্তু খেয়াঘাট পেরিয়ে রিকশাটা চলতেই তিনি কাঁপতে থাকলেন। তার মতো একজনের এরকম ধকল সইবার কথা নয়। কিন্তু শরীর আজ তার কাছে বড় নয়, যে করেই হোক তিনি গন্তব্যে পৌঁছতে চান।

আরও ঘণ্টা খানেক পর সড়কের পাশে বড় একটা আমগাছ দেখতে পায় শাহ আলম। গাছটাকে বেশ চেনা মনে হয়। শাহ আলম রিকশা থেকে নামে। পা দুটো জমে গেছে, রগগুলো টনটন করছে। যতদূর মনে পড়ে, এই গাছটার নিচে অনেকবারই তারা বিশ্রাম নিয়েছে যুদ্ধের সময়। 

গাছটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম। অনেক বছরের ব্যবধানে অনেক বদলে গেছে। আগের শরীর নেই। তবু চেনা যায়। পাশের পুলটি আজও সে রকম, তেমন মেরামত হয়নি। দক্ষিণের বিলটা প্রায় জলশূন্য। মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম চিনতে পারে এলাকাটি।

পেছনের রিকশাটা ইতোমধ্যে কাছে আসে। শাহ আলম এগিয়ে গিয়ে বলে, মা, নামুন, একটু বিশ্রাম নিন।

বৃদ্ধাকে হাত ধরে রিকশা থেকে নামিয়ে দেয় শাহ আলম। পা ফেলতেই ধপাস করে হাঁটু ভেঙে বসে পড়েন বৃদ্ধ মহিলা। জিরজিরে শরীরে এমন ধকল সইবার কথা নয়।

ওরা যখন আমগাছের নিচে বসে খানিকটা জিরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছিল, ঠিক তখনই গাছটার পাতা কাঁপিয়ে, ডালপালা বেয়ে এক পশলা ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে যায়। শিউলি সঙ্গে সঙ্গেই বলে ওঠে- ইশ কী ঠাণ্ডা, বৃষ্টি হবে নাকি আলম ভাই?
হবে হয়তো, এ সময় তো বৃষ্টি হয়, যা গরম।

ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে শিউলি মুখের ঘাম মুছতে থাকে। ইতোমধ্যে গাছের গোড়ালিতে শরীর ঠেকিয়ে বসে পড়েন বৃদ্ধা। চোখ ঘুরিয়ে জায়গাটা দেখতে থাকেন। আগে কখনো আসা হয়নি এখানে। কোনোদিন আসতে হবে তাও ভাবেননি, অথচ এসেছেন। কেন, কীসের টানে, অজানা-অচেনা এলাকাটি এত বছর পর এলেন তিনি? সবার অগোচরে আঁচলে চোখ মুছলেন বৃদ্ধা। 

গারো পাহাড়ঘেঁষা জামালপুর - শেরপুর অঞ্চল। ব্রহ্মপুত্র নদ ও বেশ কয়েকটি স্রোতস্বিনী বয়ে গেছে উত্তর জনপদের এলাকাটার মাঝ দিয়ে। পূব দিকে যমুনা, পশ্চিমে পুরোনো ব্রহ্মপুত্র। অনেক বছর হয়ে গেলেও চিনতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি শাহ আলমের। আরও মাইল কয়েক গেলেই তার স্মৃতির রণাঙ্গন। সামনের একটা কংক্রিটের পুল দেখে শিউরে ওঠে মুক্তিযোদ্ধা। মনে পড়ে - এই পুলটায় অ্যাম্বুশ বসিয়ে একবার সেনা ও রসদ বোঝাই তিনটি পাকিস্তানি ট্রাক উড়িয়ে দিয়েছিল ওদের প্লাটুন। 

অক্টোবরের শেষ। পাকিস্তানি সেনারা প্রায় সব রণাঙ্গনে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। একদিন ভোর হতে না হতেই সেনাভর্তি জিপ ও ট্রাক আসতে থাকে জেলা শহর থেকে। দুপাশের জঙ্গলে সারা রাত লুকিয়ে থাকে ১৫ জনের একটি গেরিলা দল। নির্ধারিত সময়ে শাহ আলমের হাতে মেশিনগানের ব্যারেল কেঁপে ওঠে। পুলের ওপর গাড়িগুলো উঠতেই বিকট শব্দে মাইন ফাটে। ভোর রাতের বাতাস তোলপাড় হতে থাকে। খেতের ফসল কেঁপে ওঠে। জয় বাংলা বলে একসঙ্গে চিৎকার দিয়ে ওঠে সবাই। 
তারপর?

পরের ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করেন শাহ আলম। নস্টালজিয়া থেকে তাকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনে শিউলি। বলে, জায়গাটা আপনার খুব চেনা - ভাইয়া কি এখানেই? 

শিউলির সহজ প্রশ্ন শাহ আলমকে কাঁপিয়ে তোলে। এত সহজে এ রকম কোনো প্রশ্ন কি করা যায়! কিন্তু সে শান্ত থাকে। বলে, ঠিক বলেছো, এলাকাটা আমার বেশ চেনা - অনেক স্মৃতি আছে এখানে।
আর ভাইয়া? 

না, সে জায়গাটা এখানে নয় - কামালপুরে - আরও বেশ খানিকটা যেতে হবে আমাদের। 

১৯৭১ সালে শিউলির বয়স অনেক কম। চোখের সামনে মুক্তিযুদ্ধের মতো বিশাল ঘটনা ঘটে গেলেও ওর মনে তেমন দাগ কাটেনি। শিউলিদের নতুন নতুন জেনারেশন তৈরি হয়েছে। পলাতক সময় অতীত ভুলিয়ে দিচ্ছে। শাহ আলম এবং শিউলির আবেগের মাঝে তাই বিস্তর ফারাক।

বুড়ো ভদ্র মহিলা ইতোমধ্যে সামনের একটি বাড়ি থেকে ফিরে এলেন। বহুমূত্র রোগ তার। ফিরেই বললেন - কামালপুরটা আর কদ্দুর রে বাবা? 

এইতো মা, সামনেই। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাব। আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পাচ্ছি, কিন্তু করার যে কিছু নেই মা। রাস্তাঘাট খুবই খারাপ।

কীসের কষ্ট রে - এসেই তো গেলাম। তুই যা উপকার করলি বাবা, কাজকর্ম ফেলে ছুটলি আমাদের সঙ্গে। তুই বাঁচালি, বাবা, বাঁচালি আমাকে। 

এই বৃদ্ধাকে কী এমন উপকার করেছে শাহ আলম? সন্তানের বধ্যভূমি দেখতে যাবেন মা। গোটা দেশটাই আশা-আকাঙ্ক্ষার আরেক বধ্যভূমি হতে বসেছে। একজন সহযোদ্ধার মাকে না হয় কিছুটা সময়ই দিয়েছে সে - আর বেশি কী! প্রথম দিকে শাহ আলম চেষ্টা করেছিল সহযোদ্ধার মাকে ফেরাতে। বোঝাবার চেষ্টা করেছিল - এত বছর পর হয়তো কোনো চিহ্নই থাকবে না সেখানে - শুধু শুধু কষ্ট বাড়িয়ে লাভ কী? বলেছিল - মা, একটা কথা বলি, শুধু শুধু মনটা খারাপ করে কী লাভ?
কী লাভ জানিনে বাবা, একটি বার তুই নিয়ে চল - শুধু একবার।

ভারত সীমান্তঘেঁষা এলাকাটা শাহ আলমের চেনা। বর্ডারের সামান্য ভেতরে ইপিআরের ক্যাম্প, তাকে ঘিরে শক্ত ঘাটি বানিয়েছে পাকিস্তানি সেনারা। বহু সহযোদ্ধার রক্তে রঞ্জিত এলাকা। অনেক স্মৃতি তার এখানে। সেই পুরোনো রণক্ষেত্রের স্মৃতি বুকে ধারণ করে মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম ফিরে যাচ্ছে আজ সেখানে। কেন যেন তার মনে হতে থাকে - এমন এক স্বপ্নরাজ্যে প্রবেশ করছে সে - যেখানে সে ছিল জননন্দিত রাজদ্রোহী - প্রজার রক্ত শোষণ করা রাজাধিরাজের সিংহাসন ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে হাজারো-লাখো রাজবিদ্রোহী হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল তখন! সে এক বিস্ময়কর অনুভূতি! শত্রুকে পরাস্ত করে স্বাধীনতার প্রত্যাশায় মহান এক রণযাত্রা! রক্ত নদীতে স্নান করে বাঙালির বাঙালি হয়ে বসবাসের মহোৎসব!

কিন্তু আজ কে শত্রু কে মিত্র বোঝা যায় না। সবকিছু পাল্টে গেছে। স্বাধীনতার পতাকা নামিয়ে দিতে আসছে অচেনা মানুষ। শাহ আলমের হাতে আজ রাইফেল নেই। সেদিনের বন্ধুরা কে কোথায় সে খোঁজও জানে না সে। 

রিকশা এগিয়ে চলছে। কড়কড়ে রোদে চালক দুজন ঘেমে অস্থির। একজন বেশ বৃদ্ধ - শরীরে অপুষ্টির চিহ্ন। তবে চোখ দুটো বেশ উজ্জ্বল মনে হয়। শাহ আলম ওদের ঘর্মাক্ত দেহের দিকে তাকিয়ে থাকে। জিজ্ঞেস করে - পরিবার আর আছে ভাই ?
আল্লায় দিলে আছে কয়েকজন। 
ছেলেমেয়ে?
তাও আছে।

হঠাৎ শাহ আলমের চোখ যায় লোকটার বাঁ হাতের দিকে। লক্ষ করলেই বোঝা যায় শক্ত কোনো আঘাতে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল কখনো। 

হাতে কী হয়েছিল?
রেজাকারে ধইর‌্যা পাক-বাহিনীর ক্যাম্পে দিছিল। বাইনট দিয়া খুঁচাইছে, জানে মরি নাই খোদার রহমে।

রিকশাওয়ালার কথায় শাহ আলমের চোখে ৭১ সাল ভেসে ওঠে। প্রাচীন দেখার আরশিতে চোখ রাখে সে। শেরপুর-জামালপুরের মধ্যবর্তী এলাকাটা হঠাৎ সবাক চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে। স্বচ্ছ মন্ত্র পড়া আয়নায় নাকি দূর অতীতের ছবি দেখা যায়। অনেক জাদুকর নাকি পারেন এমন অসম্ভব সাধন করতে।
তুমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলে?

না স্যার, ছোট ছিলাম, মুক্তিগর ক্যাম্পে যাতায়াত করতাম, খবরাখবর দিতাম।
ওরা তো তোমাকে মেরেও ফেলতে পারত? 

কত মানুষই তো মরল বাবা, সব্বনাসী একাত্তর কত মানুষের জান নিল, কত মানুষ শহিদ হইল। কিন্তু আল্লাহ তো শেষ পর্যন্ত বাঁচাইয়া রাখল আমারে। 

পড়ন্ত বিকেলে রণক্ষেত্র কামালপুরের সীমানায় এসে দাঁড়ায় রিকশা দুটি। পুরোনো রণক্ষেত্রে পা রাখতেই দেহটা কেঁপে উঠে শাহ আলমের। না, এখানে আজ কোনো বাংকার নেই। যত্রতত্র পড়ে নেই বুলেট ও মর্টারের খোসা। সেই কামালপুরকে চেনার কোনো উপায় নেই। নতুন ফসলের মাঠ। যত্রতত্র ঘরবাড়ি। ইপিআর ক্যাম্পটির নাম বদলে হয়েছে বিডিআর ক্যাম্প। নবীন বৃক্ষরাজি বেড়ে ওঠে ইতিহাসের কামালপুরকে এক অচেনা জনপদ বানিয়েছে। একাত্তরের ৯ মাসে অসংখ্য জনযোদ্ধা এই মাটিতে প্রাণত্যাগ করেছে, এখানেই স্বাধীনতার জন্য আত্মবলি দিয়েছে অগণিত বাঙালি যুবক। এসবের কিছুই অবশিষ্ট নেই আজ!

শহিদ সাদেক আহমদের মাকে ধরে রিকশা থেকে নামায় শাহ আলম। মাটিতে পা রেখেই বৃদ্ধা বললেন, একটু পানি পাওয়া যাবে, বাবা, তেষ্টা পেয়েছে।
নিশ্চয়ই মা, আমি পানি আনছি।

বলেই শাহ আলম পানির খোঁজে বেরিয়ে যায়। কিন্তু কোথায় যাবে? দুর্ধর্ষ গেরিলা কমান্ডার শাহ আলম এবং সাদেক আহমদকে একদিন এ অঞ্চলের প্রতিটি মানুষ চিনত। ভালোবাসা উজাড় করে দিত। কিন্তু সবকিছুই বদলেছে। গাছ, ঘরবাড়ি, দোকানপাট সব বদল হয়েছে। শাহ আলম তবু হাঁটতে থাকে। 

ব্যস্ত মানুষ যার যার কাজে চলেছে। স্কুল থেকে দলবেঁধে ফিরছে একদল বালিকা। ভারত সীমান্তের উঁচু বাঁধটা দেখা যাচ্ছে। ধানুয়া গ্রামটা দাঁড়িয়ে আছে সেই আগের মতো। এক থেকে সাত নম্বর পর্যন্ত বাংকার ছিল এই গ্রামে। উঁচু একটি তালগাছ দাঁড়িয়ে থাকত ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষে। শাহ আলম দেখল সে গাছটি নেই।

চোখ ছল ছল করে ওঠে মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলমের। মনে আক্রোশ জমে ওঠে। কেন এই রণক্ষেত্রের সব নরনারী, গাছপালা, পাখি, কীটপতঙ্গ সবাই আজ ছুটে আসছে না? প্রতিটি দোকানপাট, প্রতিটি বাড়ি, প্রতিটি ফসলের খেত থেকে কেন ছুটে আসছে না হাজার কৃতজ্ঞ মানুষ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ সাদেক আহমদের মায়ের তৃষ্ণা নিবারণ করতে?

কিন্তু সে আশা পূরণ হয় না। কেউ তাকে চিনতে পারে না। কেউ এগিয়ে আসে না। মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলমের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয় - তোমরা কেউ কি মনে করতে পারো - আমি সেই কমান্ডার শাহ আলম, আর ওই তো সেই মা, যার সন্তান সাদেক আহমদ রক্ত তোমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে।

বেশ খানিকক্ষণ পর একটি চা দোকান থেকে এক গ্লাস পানি হাতে ফিরে আসে শাহ আলম। শহিদ মুক্তিযোদ্ধা সাদেক আহমদের মা তখন বিডিআর ক্যাম্পের উপরে জাতীয় পতাকার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। ওই তো সেই পতাকা- যার গায়ে তার সন্তানের রক্তের দাগ!
মা, এই যে পানি।

কোনো কথা না বলে স্পষ্ট, সোজাসুজি তাকালেন বৃদ্ধা। হঠাৎ বদলে গেল পরিস্থিতি। শাহ আলম মাথা নিচু করে বলল, মা, এই যে পানি এনেছি আপনার জন্য। 

শিউলি ঠিক তখনি এগিয়ে গেল মায়ের কাছে। বলল - পানি খেতে চাইলেন না আপনি? নিচ্ছেন না যে?

হঠাৎ আকাশ ফাটা আর্তনাদ করে শহিদ সাদেক আহমদের মা ডুকরে উঠলেন। দুই হাত বাড়িয়ে শাহ আলমকে জাপটে ধরলেন। - আমি পানি চাই না বাবা, তুই শুধু বল - কোন জায়গায়, ঠিক কোন জায়গায় আমার বাবাকে ফেলে গেছিস তোরা? একবার বল - কোন জায়গায় - কোন জায়গায়?

উন্মাদের মতো বিলাপ করতে থাকলেন শহিদ জননী। বারবার করে ডুকরে উঠলেন - বাবা-বাবারে, জাদুমণি রে। আয় বাবা, আয়। একবার, শুধু একবার বুকে আয়।

কিছুতেই থামালেন না বৃদ্ধা। সে রোদনে গাছের ডালে বসা পাখিরা গান থামিয়ে দিল। গরু-ছাগলগুলো সকরুণ চোখে তাকিয়ে থাকল। শহিদ সাদেক আহমদের মায়ের হাতের ঝাঁকুনিতে গ্লাসের পানি পুরোনো রণক্ষেত্রের মাটিতে ছড়িয়ে পড়ল। পানির রং গাঢ় লাল হয়ে শাহ আলম ও শিউলির শরীর, কাপড় রাঙিয়ে দিল। 

মাটিতে আছড়ে পড়তে থাকলেন শহিদ জননী। কেবলই বলতে থাকলেন - শুধু একবার জায়গাটা দেখিয়ে দে বাবা। বল, আমার সাদেক কোথায় শুয়ে আছে? আমি আমার বাবার কাছে শুয়ে থাকব।

মায়ের রোদনে চোখ ভিজে ওঠে শিউলির। শিশু বয়সের স্মৃতি মনে না পড়লেও চোখের সামনে নিজের ভাইয়ের রক্তাক্ত শরীর ভেসে ওঠে। দ্রুত খুলে যায় ঢেকে রাখা বিস্মৃতির চাদর। রণক্ষেত্র কামালপুরের মাটি ওর কাছে তীর্থভূমি মনে হয়। চোখ দিয়ে অবিরল ধারায় পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। 

লোকজন জমে যায় ইতোমধ্যে। কেউ কেউ প্রশ্ন করে - কে এই বৃদ্ধা, কেন কাঁদছেন তিনি? এমন প্রশ্নে বোবা হয়ে যায় শাহ আলম। জড়ো হওয়া মানুষগুলোর ওপর আক্রোশ বাড়তে থাকে। শহিদের মাকে সে থামাতে চেষ্টা করে না, কাঁদুক, যত পারে কাঁদুক শহিদ সহযোদ্ধার মা।

শাহ আলমের কানে তখন রাইফেল, মর্টার এবং এলএমজির গর্জন ছাড়া কিছুই পৌঁছে না। ১৪ দিন অবরুদ্ধ কামালপুরের শত্রুঘাঁটি। মুক্তিবাহিনী ঘিরে রেখেছে দুর্ভেদ্য পাকিস্তানি ক্যাম্প। অবিরত গোলাবর্ষণ চলছে কামালপুর বিওপির ওপর। কোম্পানি কমান্ডার সাদেক আহমদ সহযোদ্ধাদের নিয়ে ঢুকে গেছে শত্রুঘাঁটিতে। রক্তে ভিজে গেছে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তভূমি। হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণের পতাকা উড়িয়েছে। জয়বাংলার বিজয় উৎসব চলছে। বাংকার থেকে বেরিয়ে হাত ওপরে তুলে বেরিয়ে আসছে পরাজিত সেনারা। চোখে-মুখে ওদের পরাজয়ের গ্লানি। 

পাকিস্তানি সেনাদের পরিত্যক্ত অস্ত্র- গোলাবারুদ এক জায়গায় এনে জড়ো করা হচ্ছে। চোখে আনন্দাশ্রু নিয়ে অনেকেই তখন গান ধরেছে, ..আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...।

বিশাল বিজয়ের পর দুই বন্ধু জড়িয়ে ধরে দুজনকে। চোখ দিয়ে দুজনের নোনা পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। সদ্য শত্রুমুক্ত ঘাটিতে জড়ো হতে থাকে অজস্র মানুষ। জয় বাংলা এবং জয় মুক্তিবাহিনীর স্লোগানে বাতাস আন্দোলিত হয়ে উঠছে। বিজয়ের অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। শাহ আলমের সব মনে পড়ে এখনো।

ঠিক সেই মুহূর্তে বিকট এক বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে রণক্ষেত্র। প্রথমে কেউই বুঝতে পারে না কী ঘটল। শাহ আলম দ্রুত ক্যাম্পের ভেতর প্রবেশ করে। দেখে, সাদেক আহমদের বিক্ষত শরীর পড়ে আছে। পাশে পড়ে আছে কাঠিতে বাঁধা একটি জাতীয় পতাকা এবং কমান্ডারের পরিত্যক্ত স্টেনগান। ছিন্নভিন্ন শরীরের নিচের অংশটি উড়ে গেছে পাকিস্তানিদের পুঁতে রাখা মাইনে।

অনেক বছর আগের কথা - শাহ আলম নিজেও ভুলতে বসেছিল। কিন্তু রণক্ষেত্র কামালপুরের মাটিতে দাঁড়িয়ে রক্তমাখা স্মৃতি তাকে কঠিন করে তোলে। নতুন ক্রোধ, নতুন ঘৃণা, নতুন এক প্রত্যয় দ্রুত থেকে দ্রুততর ছড়িয়ে পড়তে থাকে শরীরে। এক প্রচণ্ড অস্থিরতা বোধ করতে থাকে শাহ আলম। সে প্রচণ্ড বেগে ছুটতে চায়, একটি ঝড় কামনা করে, নতুন একটি ঝড়। 

শিউলির ডাকে বর্তমানে ফিরে আসে শাহ আলম। শহিদ জননীর বিলাপ কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। উৎসুক মানুষের ভিড় কমতে শুরু করেছে। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যার আগেই এ এলাকা ছাড়তে হবে। অচেনা গ্রাম - কে কাকে চিনবে, কে কাকে কোথায় আশ্রয় দেবে। 

আলম ভাই, মাকে জায়গাটা দেখিয়ে দিন তো, সন্ধ্যা হচ্ছে। এক হাতে মাকে আগলে রেখে অনুরোধ করে শিউলি।

এরপর নবীন গজানো গাছপালা, বৃক্ষরাজি, নতুন-পুরোনো ঘরবাড়ি, দোকানপাট, স্কুল, অফিসঘর পেরিয়ে একটা জায়গায় এসে দাঁড়ায় ওরা। শাহ আলম জায়গাটাকে চিনতে চেষ্টা করে। না, আগের কিছু নেই, নেই সারি সারি বাংকার, নেই বোমা ও গ্রেনেডের আগুনে পোড়া খয়েরি রঙের মাটি। এখন কোনো ভারী সামরিক ট্রাক চলে না এখানে, নতুন ঘাস গজিয়েছে। শহিদের রক্তের দাগ ঢেকে দিয়েছে নতুন মাটি ও দূর্বাঘাসে।

অনেকক্ষণ ঘুরে শাহ আলম সহযোদ্ধাকে হারাবার জায়গাটা ঠিক চিনতে পারে। ওই তো আকাশমুখী সেই দেবদারু গাছটা আজও দাঁড়িয়ে আছে। সে নিশ্চিত হয় - ওই তো, ওখানেই তো ঢলে পড়েছিল মুক্তিযোদ্ধা সাদেক আহমদ। 

না, সেই বধ্যভূমিতে কোনো স্মৃতিসৌধ গড়ে উঠেনি। বরং গাছটার নিচে, দেখা গেল, নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে দুটি নেড়ে কুকুর - কড়কড় শব্দে হাড্ডি ভাঙছিল তারা। মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম এ দৃশ্য মেনে নিতে পারে না। ঘামে শরীর ভিজে ওঠে - এ হয় না, এ হতে পারে না!

ভদ্র মহিলা ইতোমধ্যে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছেন। বললেন, কোথায় রে বাবা - কোন জায়গাটায়? একটু থেমে আবারও বলেন, বেশি দেরি হবে না বাবা, এক মুঠ মাটি নিয়েই চলে যাব আমি, কেবল এক মুঠ মাটি। 
মা, একটু অপেক্ষা করুন। 

বলেই শিউলির চোখের দিকে তাকায় শাহ আলম। শিউলি বুঝতে পারে তার ভাইয়ের বন্ধুর চোয়ালগুলো টানটান হয়ে উঠছে। চোখ দুটি সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত হচ্ছে। সে দু হাতে মাকে জাপটে ধরে। 

তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে হাতে দুটি ইটের টুকরো তুলে নেয় শাহ আলম। শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে ইট দুটিকে কুকুরগুলোর দিকে ছুড়ে মারে। ঘেউ ঘেউ শব্দে কুকুরগুলো স্থান ত্যাগ করতেই পরিবেশটা হালকা হয়। শাহ আলমের কাছে যেন আজ আবারও একাত্তর।

এরপর সহযোদ্ধার মায়ের কাছে এগিয়ে যায় শাহ আলম। বলে, মা, এবার আপনি আসুন। ওই তো সেই জায়গা, সেই পবিত্র জায়গা।

হো হো করে কেঁদে ওঠে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন শহিদ জননী। মাটি খাবলে কিছু মাটি-ধুলোবালি হাতে নিয়ে নিজের শাড়ির আঁচলে পেঁচিয়ে রাখেন তিনি। শিউলির চোখ দিয়ে তখন অঝোরে পানি গড়িয়ে পড়ছে। শাহ আলম এগিয়ে গিয়ে ওর পিঠে হাত রেখে বলে - চল, আমরা দুজনেই মাকে সাহায্য করি। 

ক্রমশ অদৃশ্য হতে থাকে

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৫, ০৩:১০ পিএম
আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৫, ০৩:১০ পিএম
ক্রমশ অদৃশ্য হতে থাকে
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

সন্ধ্যার নির্জনতায় আমি যখন বা‌ড়ি ফির‌ছিলাম 
‌বিপণি‌বিতা‌নের মৃদু আলোয় চারপা‌শের মানুষ ও
যানবাহ‌নের ধূসরতা রহস্যময় হ‌য়ে আব‌র্তিত হ‌তে
থা‌কে। মানু‌ষের স্বভাবজাত ইতিহাস বড় বেদনার 
বড় বিষা‌দের। ক্রমশ অদৃশ্য হ‌তে থা‌কে সম্প‌র্কের
অমল বিন্যাস। আজকাল মানুষের সা‌থে মানু‌ষের
দূরত্ব বৃ‌ষ্টির জ‌লের ম‌তো গ‌ড়ি‌য়ে গ‌ড়িয়ে যায়।
জ্ঞানীরা নির্ঘণ্ট ছুঁয়ে গ্র‌ন্থের আয়ুষ্কাল ‌নির্ণয় ক‌রে
ফু‌লের সৌগ‌ন্ধের সা‌থে স্মৃ‌তির দর্প‌ণে ভা‌সে 
‌নিরব‌ধিকাল। সূচক ধ‌রে ধ‌রে যে মান‌চিত্র গি‌লে
খায় সে দেশ‌দ্রোহী।

এই পতাকা গর্বিত আজ

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৫, ০২:২৯ পিএম
আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৫, ০২:৩০ পিএম
এই পতাকা গর্বিত আজ
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

আবহমান এই বাংলা
প্রকৃতির অবদান
ঝিরিঝিরি বাতাস শোনায়
শান্তির শুভ গান-

হাওয়ায় হাওয়ায়
আসা-যাওয়ায়
মেঘের নানা খেলা
বৃষ্টি এলে রিমঝিম ঝিম
সকাল-সন্ধ্যা বেলা
জীবন জয়ের মেলা-

স্বপ্নের এই দেশ
কৃষক-শ্রমিক-জেলে-তাঁতির
মুগ্ধতার আবেশ
সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা
সোনার বাংলাদেশ-

মাঠে-ঘাটে সময় কাটে
পাখির গানে গানে
এই বাঙালি বিশ্বে অমর
মহৎ অবদানে
এই পতাকা গর্বিত আজ
কীর্তি ও সম্মানে।