দেশে উন্নতি যে হয়েছে তা ঠিক। শত বিপদের মধ্যেও ওই উন্নয়ন থেমে নেই, নির্ভয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে সে উন্নতি যে এক বিশেষ প্রকারের, এ সম্পর্কে পরিকল্পনামন্ত্রী একটা সুস্পষ্ট ধারণা আমাদের দিয়েছেন। মন্ত্রীদের বক্তব্য আমাদের শুনতে হয়; না শুনে উপায় থাকে না; চোখ-কান খোলা রাখার দরকার পড়ে না, বক্তব্যগুলো চতুর্দিকে ঘুরতে থাকে। সেসব বক্তব্য সাধারণত আলো দেয় না, অনেক ক্ষেত্রে অন্ধকারই বরং বৃদ্ধি করে। এরই মধ্যে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো এসেছে পরিকল্পনামন্ত্রীর বক্তব্যটি। গত বছরের ১৯ আগস্ট তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের উন্নয়নের মডেল বৈষম্য বাড়াচ্ছে’, এবং ‘খুব সহসা যে তা কমবে এমন সম্ভাবনা নেই।’
এ ধরনের সত্য কথা গুরুত্বপূর্ণ লোকদের কাছ থেকে পাওয়াটা প্রায় অসম্ভব। বাংলাদেশের উন্নয়নের মডেল সারা বিশ্বে অত্যন্ত প্রশংসিত, অন্যরা অনুকরণে ভীষণ আগ্রহী, এসব কথাই শুনে আসছি; ওই উন্নয়ন যে বৈষম্য বৃদ্ধি করে অধিকাংশ মানুষের দুঃখ বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে, এ কথাটা তো এমনকি জ্ঞানী ব্যক্তিদের কাছে থেকেও সচরাচর শুনতে পাই না। পরিকল্পনামন্ত্রীকে ধন্যবাদ। এবং এটা আমাদের মনে পড়ে যে, উন্নয়ন পাকিস্তান আমলেও বিস্তর হয়েছে। কিন্তু ওই উন্নতি বৈষম্যমূলক ছিল বলেই তার বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধে যেতে হয়েছে। বাধ্য হয়ে। ভয়ংকর রকমের বিপদ মাথায় নিয়ে। তবে পরিকল্পনামন্ত্রীর এই বক্তব্য যে তার সঙ্গের লোকদের কানে পৌঁছাবে এবং উন্নয়ন নিয়ে চিন্তিত করবে, এমন ভরসা একেবারেই নেই। তার সঙ্গের লোকেরা উন্নয়নের বাজনা বাজাচ্ছেন এবং সেই নিনাদে তাদের কর্ণে বিপরীত শব্দের প্রবেশ দুঃসাধ্য হওয়ারই কথা। পরিকল্পনামন্ত্রীকে আমরা অভিনন্দন জানাই সত্য কথাটা বলার জন্য।
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেশবাসীর জন্য সুখ যে বয়ে আনেনি, সেটা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। উন্নয়ন বেড়েছে কিন্তু কর্মসংস্থান তার সঙ্গে যে পাল্লা দিয়ে বাড়বে তেমনটি ঘটেনি। অথচ মেহনতিদের শ্রমের ওপর ভর করেই সৌধটি দাঁড়িয়েছে। করোনাকালে মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে গেছে। কিন্তু গ্রামে গিয়ে খাবে কী? আয়-উপার্জনের কী বন্দোবস্ত? একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক, পাবনা অঞ্চলের এক দম্পতি ঢাকা শহরে কাজ করত পোশাক কারখানায়। কাজ হারিয়ে গ্রামে ফেরত গেছে। গ্রামে গিয়ে কাজ না পেয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে মরেছে। দুজনে। একসঙ্গে।
ওদিকে আমাদের জন্য মহাসমস্যাগুলোর একটি হচ্ছে বন্যা। উন্নতি বন্যার অভিশাপ নিরসনের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র কার্যকর হয়নি। বন্যার কথা খুব করে বলতেন মওলানা ভাসানী। তিনি কৃষকদের দুর্দশা জানতেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে ৭ নম্বরটি ছিল, ‘খাল খনন ও সেচের ব্যবস্থা করিয়া দেশকে বন্যা এবং দুর্ভিক্ষের কবল হইতে রক্ষা করিবার ব্যবস্থা করা হইবে।’ ১৯৬৫ সালে ঘোষিত ন্যাপের ১৪ দফা ছিল সারা পাকিস্তানের কর্মসূচি, সেখানেও ১৩ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা প্রতিরোধ করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে।’ বহু কষ্টে পাকিস্তানকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিদায় করা গেছে, কিন্তু গত ৫০ বছরেও বন্যার অভিশাপ আমাদের কাঁধ থেকে নামেনি। প্রধান কারণ, সমস্যাটা বিত্তবানদের স্পর্শ করে না।
পাকিস্তান আমলেই এটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত ছিল এবং গিয়েছিলও, যে বন্যা সমস্যার সমাধান মূলত নদীর সমস্যা। যে জন্য ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের সময়ে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আপত্তি তোলা হয়েছিল। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সেই ফারাক্কা কার্যকর করা হয়েছে এবং বাংলাদেশের জন্য শুষ্ক মৌসমে কম পানি ও বর্ষায় প্লাবনের দুর্ভোগ সহ্য করতে হচ্ছে। মওলানা ভাসানী সমস্যাটির গুরুত্ব কখনো ভোলেননি। তাই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এবং অসুস্থ অবস্থাতেও ফারাক্কা লং মার্চের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে তিস্তাসহ অন্য নদী নিয়েও মস্ত মস্ত সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমরা ভুক্তভোগী হচ্ছি। কিন্তু এ নিয়ে রাষ্ট্র-কর্তাদের তেমন দুশ্চিন্তা দেখা যায় না। ওদিকে বর্ষা এলেই নদীর ভাঙন-কাজ শুরু হয়ে যায়। শত শত মানুষ গৃহহীন হয়। জমি কমে আসে। আবার গ্রীষ্মের সময় অনেক এলাকায় দেখা দেয় নিদারুণ খরা। খাওয়ার পানির আকাল পড়ে। উন্নতির উৎসবের নিচে হারিয়ে যায় বিপন্ন মানুষের উদ্বেগ ও আর্তনাদ।
তবে উন্নতির যথেচ্ছাচারের সংবাদ ও প্রমাণ দেখা যাচ্ছে যত্রতত্রই। যেমন সংসদীয় নির্বাচনে। অভিনবত্বের দিক থেকে আমাদের গত তিনটি নির্বাচনই অসামান্য, তবে তৃতীয়টি আগের দুটিকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রথমটিতে বিরোধী দল অংশ নেয়নি; ফলে সরকারি দল ভোটারবিহীন নির্বাচনে বিজয়ী হতে পেরেছে। দ্বিতীয়টিতে বিরোধী দল কোনো মতে হাজির হয়েছিল, তবে এবার ভোটারদের পক্ষে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হওয়ার প্রয়োজন পড়েনি, সরকারি স্বেচ্ছাসেবকরা ভোটারদের হয়ে মধ্যরাতেই ভোটদানের কষ্টকর কাজটি সম্পন্ন করে দিয়েছে। তৃতীয়টি তো অভিনব একতরফা। দলীয় প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীও একই দলের। কী সেকুলাস বাংলাদেশের নির্বাচনি গণতন্ত্র! ভারতও আমাদের অনুসরণ করছে, তার প্রমাণ সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচন।
আগামীতে দেশে আরও কত রকমের উন্নতি হবে কে জানে। তবে প্রশ্ন থাকবে, পুঁজিবাদের এই যে স্রোত একে রোধিবে এখন কোন বাঁধ? না, পুঁজিবাদী বাঁধ দিয়ে পুঁজিবাদের প্লাবন রোধ করা যাবে না; সামাজিক মালিকানার দিকে যেতে হবে। এবং খুব জরুরিভাবে সেই ব্যবস্থা দরকার হবে, যাতে জনপ্রতিনিধিরা টাকার জোরে নির্বাচিত হবেন না; তাদের একমাত্র যোগ্যতা হবে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষমতা; অন্য কিছু নয়। কিন্তু তেমনটি ঘটার আশু কোনো সম্ভাবনা কি দেখা যাচ্ছে? ব্যাপার-স্যাপার মনে হবে কৌতুকের, কিন্তু আসলে কি তাই?
নিরাপত্তার কথা বলছিলাম। নানা দিক থেকেই আমরা নিরাপত্তাহীনতায় আছি। চালের দাম, তেলের দাম বাড়ছে। বলা হচ্ছে সিন্ডিকেট দায়ী। তা সিন্ডিকেটকে কি সরকার চেনে না? সিন্ডিকেট ভাঙা হচ্ছে না কেন? এমনকি ব্যক্তিগত আলাপও তো দেখছি এখন অনিরাপদ। টেলিফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রস্তুত রয়েছে খপ করে ধরে ফেলার জন্য। কোভিড-১৯ তো তার কাজ করছেই, ডেঙ্গুও পূর্বাবস্থায় থাকছে না। তার প্রকোপে উন্নতি ঘটেছে। বছরের এ সময়ে বজ্রপাত ঘটে। কিন্তু যা অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারণ তা এই যে, বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। রাজশাহীতে বিয়ের বরযাত্রীরা ঝড়বৃষ্টিতে পড়ে আশ্রয় নিয়েছিল টিনের এক চালের নিচে; এক আঘাতে প্রাণ হারিয়েছে ১৭ জন। দিনাজপুর এলাকায় মাঠে ফুটবল খেলছিল কিশোররা, বজ্রাঘাতে চারজন মারা গেছে। তিনজন মাছ ধরছিল বৃষ্টিতে, বজ্রাঘাত তাদের প্রাণ ছিনিয়ে নিয়েছে।
এগুলো সব নয়, দৃষ্টান্তস্বরূপ কয়েকটি ঘটনা। মূল কথাটা হলো বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এর একটা বড় কারণ বৃক্ষ নিধন। গাছ যে কতটা উপকারী সেটা বোঝা হয় না। তা বৃক্ষ নিধনের দায়টা কার? এক কথায় বলতে গেলে দায় পুঁজিবাদী উন্নয়নের। এই উন্নয়নকারীদের বিরুদ্ধে ভালো একটা অবস্থান নিয়েছেন দেখলাম কলকাতা হাইকোর্ট। হাইকোর্ট ভারতের একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে ৪০ কোটি রুপি জরিমানা করেছেন, ৬০০ গাছ কেটে ফেলার জন্য। কলকাতা শহরের একেবারে কেন্দ্রে একটি খোলা জায়গায় বহুতল আবাসন নির্মাণের অছিলায় প্রতিষ্ঠানটি ওই ৬০০ বৃক্ষ নিধন করেছিল। হাইকোর্টের হিসাবে এতে ক্ষতি হয়েছে ৪০ কোটি রুপি। হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন যে, জরিমানা বাবদ প্রাপ্ত অর্থ ব্যয় করা হবে বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যার কাজে। এটা একটা ভালো দৃষ্টান্ত এবং প্রয়োজনীয় বার্তা প্রেরণ। কিন্তু কেবল এতে যে কাজ হবে তা তো নয়; বদলানো চাই উন্নয়নের পুঁজিবাদী ধারণা ও ধারাকেই।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়