প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক ও লেখক ভিক্টর হুগোর মতে, ‘জীবনের দুঃখকে জয় করে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সাহস আর ধৈর্য।’ আমেরিকার রেনেসাঁর জনক রালফ ওয়ালডু ইমারসন বলেছেন, ‘প্রকৃতির গোপন শক্তিটিকে অর্জন করার চেষ্টা করো। গোপন শক্তিটি হলো ধৈর্য।’
সুরা আল-ইমরান, সুরা আল-নাহলসহ পবিত্র কোরআনের একাধিক সুরায়ও ধৈর্য সম্পর্কে মহান আল্লাহতায়ালার একাধিক বাণী রয়েছে। এগুলোর মূল সারমর্ম হলো, ধৈর্যশীলকে মহান আল্লাহ পছন্দ করেন।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি এখন কতটা ধৈর্য ধরবে, তা নিয়েই মূলত আলাপ-আলোচনা চলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি কৌতূহলী সুধী সমাজসহ সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে একটাই প্রশ্ন, বিএনপি কি ধৈর্য ধরতে পারবে? নাকি তাদের তাড়াহুড়োয় সব নষ্ট হয়ে যাবে?
এমন প্রশ্নে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দৈনিক খবরের কাগজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে ‘ইনটেনশন অব দ্য গভর্নমেন্ট’ এটি স্পষ্ট হওয়া দরকার। দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন দাবি করে তিনি বলেছেন, আমরা বলেছি তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন চাই। তার মতে, নির্বাচনে বেশি দেরি করলে গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিএনপির ধৈর্য ধরা উচিত কি না জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, বিএনপি তো সংগ্রাম করছে, লড়াই করছে। বিএনপির রাজনীতি তো বিএনপিকে করতেই হবে। রাজনৈতিক যে কর্মকাণ্ড, জনগণের কাছে যাওয়া, মিছিল, সভা-সমাবেশ করা এসব থাকবে। ‘অ্যাট দ্য সেইম টাইম’ সামনে যে নির্বাচন হবে, বিএনপিকে তার প্রস্তুতিও নিতে হবে।
তবে মির্জা ফখরুলের প্রকাশ্য বক্তব্য এমন হলেও বিএনপি এবং তার সমর্থকদের ধৈর্য ও সহনশীলতার ওপরই দেশের আগামী দিনের রাজনীতি তথা দেশ বিনির্মাণ অনেকাংশে নির্ভর করছে। বলা হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দেওয়া না হলে আন্দোলন-পূর্ব এবং পরবর্তী রাষ্ট্রের অবকাঠামোগত যে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, তা বিনির্মাণ করা না হলে দেশ পরিচালনা যেমন কঠিন হবে; তেমনি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানও সম্ভব হবে না। তবে নানা সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, বিএনপির ভেতরের বড় একটি অংশ ক্ষমতার স্বাদ নেওয়ার জন্য এখনই নানা তৎপরতা শুরু করেছে। কেউ কেউ অতি উৎসাহ দেখাচ্ছেন, যা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা-আলোচনা শুরু হয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সুধী সমাজের প্রতিনিধিরাও বলছেন, আজকে বাংলাদেশের যে প্রধান সমস্যা, তা মূলত গণতন্ত্রহীনতা ও সুশাসনের অভাবের ফলেই উদ্ভূত। এ দুটিই ফিরিয়ে আনতে গেলে রাষ্ট্র সংস্কার প্রয়োজন। এই সংস্কার সংবিধানে ১২৩ অনুচ্ছেদে প্রণীত ‘সংসদ ভাঙ্গিয়া যাওয়ার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচন’ দিয়ে সম্ভব নয়। এমনকি ‘দৈব-দুর্বিপাক’ হলেও তারও নব্বই দিনের মধ্যে সম্ভব নয়। তবে আশার কথা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এ বিষয়ে বিএনপি নেতাদের ‘ধীরে চলার’ পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। কেউ কেউ বলছেন, বিএনপি আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন দেওয়ার দাবি তুলবে। তবে দলটির দায়িত্বশীল নেতারা ড. ইউনূসের সরকারকে সময় দেওয়ার পক্ষে। কারণ তারা বুঝতে পারছেন যে, তাড়াহুড়ো করে নির্বাচন করতে গেলে সবকিছু ভণ্ডুল হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে আন্দোলনের নিয়ামক শক্তি ছাত্রসমাজের সঙ্গে তাদের বিরোধ তৈরি হতে পারে। ছাত্ররা বিগড়ে গেলে বিএনপির একক চাপে নির্বাচন আদায় শেষমেশ কঠিন হতে পারে; এমনকি আন্দোলনের ফলাফলও নস্যাৎ হয়ে যেতে পারে। এমন আশঙ্কা নিতান্ত কম নয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনের নিয়ামক শক্তি ছাত্রসমাজও এই রাষ্ট্র সংস্কার চাইছে। বিএনপি ও তাদের সমর্থক দলগুলোও ১৫ বছর ধরে অভিযোগ করে আসছে যে আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে। বিএনপি নেতারা এমন কথাও বলেছেন, আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রের এমন দশা করেছে যে এই ক্ষত ঠিক করতে এক যুগ লেগে যাবে। ফলে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য বেশ সময় দরকার। ইতোমধ্যে উচ্চ আদালত, পুলিশ, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তন শুরু হয়েছে। কিন্তু সার্বিকভাবে পুলিশ ও প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচন কমিশনেও ব্যাপক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে নির্বাচন করতে গেলে নির্বাচন যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে, তেমনি নির্বাচন করার প্রশাসনিক বা কাঠামোগত সক্ষমতাও এই মুহূর্তে সরকারের যে নেই, এটি বেশ স্পষ্ট।
সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, এমন ধারণা জনমনে বেশ অনেক দিন ধরেই প্রতিষ্ঠিত। পর্যবেক্ষকদের মতে, এমন সম্ভাবনা থেকেই বিগত সরকার কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে তিনটি নির্বাচনকে বিতর্কিত করেছে। তা ছাড়া বিএনপিকে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে গণ-অভ্যুত্থানের প্রধান নিয়ামক শক্তি ছাত্রসমাজের সঙ্গে কোনো কারণে তাদের দূরত্ব তৈরি হলে পরিস্থিতি অনুকূলে নাও থাকতে পারে। ড. ইউনূস এবং সরকারের উপদেষ্টারা যাতে রুষ্ট না হন, সেটি বিবেচনায় রাখা বেশ জরুরি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্রদের আন্দোলনের ফসল বলে সবাই মনে করে। ফলে তাদের মনোভাব বুঝেই বিএনপিকে এগোতে হবে।
গত বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নিয়েছে। দুই দিন ছুটির পর মাত্র গতকাল রবিবারই অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করেছে। বিএনপি ও তার সমর্থক দলগুলোর ধৈর্যের পরীক্ষার পালা এখন থেকে শুরু হলো।