আজকের শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন নিরাপদে বেড়ে ওঠে, তার জন্য চাই একটি নিরাপদ পৃথিবী। যে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থাকবে সিসামুক্ত, ওজোনস্তর থাকবে ফাটলমুক্ত। যে পৃথিবী থাকবে সবুজ শ্যামলিমায় ঘেরা। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, পৃথিবী তার রূপ হারাচ্ছে। পৃথিবী ক্রমাগত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। এ নিয়ে টিনএজাররাও চিন্তিত। কিছু টিনএজার প্রতিবাদীও হয়ে উঠছে। তেমনই প্রতিবাদী দুই বাংলাদেশি টিনএজারের কথা জানাচ্ছেন জাজাফী।
ফাতিহা আয়াত
ফাতিহা আয়াত যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বসবাসকারী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লেখক, শিশু অধিকার কর্মী ও একজন জলবায়ু পরিবর্তন সংস্কারক। সে CHIL&D নামের একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা যেখানে জলবায়ু, স্বাস্থ্য, তথ্য, শিক্ষা ও উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে। ফাতিহা আয়াত ২০১১ সালের ১৩ অক্টোবর বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে। আমেরিকার বুকে নিজেকে এক টুকরো বাংলাদেশ করে রেখেছে। তার বর্তমান বয়স ১৩ বছর। ফাতিহার বয়স যখন সাত বছর সেই বয়স থেকে ফাতিহা নিজে শেখে আর অন্যদের শেখায়। যে বয়সে আমরা বাসায় মেহমান আসলে লজ্জা আর ভয়ে লুকিয়ে থাকি, সেই বয়সে সে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে বিখ্যাত সব মানুষের সামনে বক্তব্য দিয়েছে। ওর বক্তব্য শুনে অন্যরা হতবাক হয়ে যায়।
শুধু ২০২৩ সালেই ফাতিহা আয়াত এখন পর্যন্ত তিনবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বক্তব্য রেখেছে। এগুলো ছিল বিশ্ব পানি সম্মেলন, ইকোসক ইয়ুথ ফোরাম, ১৭তম আন্তর্জাতিক মানবাধিকার যুব সম্মেলন। বিশ্বের নানা প্রান্তে ফাতিহা আমন্ত্রিত হয়ে শিশু অধিকার, জলবায়ু পরিবর্তন রোধসহ
নানা বিষয়ে বক্তব্য দিয়ে থাকে। অধিকার প্রতিষ্ঠায় কথা বলে।
কিছুদিন আগেই সে ‘চেঞ্জ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ’ শীর্ষক তার প্রথম টেডএক্স বক্তব্য রেখেছে নিউইয়র্কের ইরভিংটনে। এ ছাড়া এস্তোনিয়ার রাজধানী ট্যালিনে আয়োজিত ‘লেটস ডু ইট’ কনফারেন্সে সে বক্তব্য দিয়েছে। তার অন্যান্য বক্তব্যের মধ্যে রয়েছে- ইউএন গ্লোবাল কম্প্যাক্ট ও প্যাসিফিক ইনস্টিটিউট আয়োজিত ‘ওয়াটার ম্যান্ডেট’ সেমিনার, কার্বন ডিসক্লোজার প্রজেক্ট আয়োজিত ‘ওয়াটার সিকিউরিটি’ কনফারেন্সে বক্তব্য এবং সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশন্স নেটওয়ার্ক আয়োজিত ‘হিউম্যান প্ল্যানেট ফোরাম’ অনুষ্ঠানে রাখা বক্তব্য অন্যতম।
গত বছর ২৬ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের উপস্থিতিতে ফাতিহা জাতিসংঘে বক্তব্য দিয়েছে। আর এ বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একই দিন একই বিষয়ে জাতিসংঘে বক্তব্য রেখেছে। নানা বিষয় নিয়ে ফাতিহা সচেতনতা গড়ে তুলতে কাজ করছে। আমরা যখন গাছ কাটি, আইসক্রিম খেয়ে যেখানে-সেখানে খোসা ফেলে পরিবেশ নষ্ট করি, ছোট্ট ফাতিহা তখন পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য প্রতিবাদ করে চলেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১২ আগস্ট বিশ্ব যুব দিবসের অনুষ্ঠানে সে জাতিসংঘে ভাষণ দিয়েছে। সেখানে সে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা যুবকদের দ্বারা বনাঞ্চল ধ্বংস ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে এর ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরেছে। এ ছাড়া ১৬তম আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সম্মেলন, ইউএন ডে এবং উইমেন পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাজেন্ডাতে অংশ নিয়ে শিশু নির্যাতন, লিঙ্গ বৈষম্য, পারিবারিক সহিংসতায় শিশুদের সমস্যা, শরণার্থী শিশুদের অমানবিক জীবন নিয়ে বক্তব্য তুলে ধরেছে। ওর বয়সীরা যখন কথা বলতেই ভয় পায় ফাতিহা তখন শিশুদের আনন্দময় শিক্ষার অধিকার নিয়ে কথা বলে।
বিশ্বব্যাপী শিশুদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বড় হয়ে সে এমন কিছু করবে যেন আর কোনো শিশু ক্ষুধা বা তৃষ্ণায় একটি দিনও না কাটায়। ফাতিহার মতে ‘সন্তানকে মুখস্থ করাবেন নাকি আবিষ্কারের নেশা ধরিয়ে দেবেন সেই সিদ্ধান্ত আপনার।’ ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও শিশু কিশোর-কিশোরীদের জন্য নিরাপদ পৃথিবী গড়ার জন্য সবাইকে আহ্বান জানিয়েছে ফাতিহা।
রেবেকা শবনম
বিশ্বকে বাঁচানোর জন্য আওয়াজ তুলে বিশ্বব্যাপী আলোচিত আরেক বাংলাদেশি টিনএজার রেবেকা শবনম। ফাতিহার মতোই সেও বিশ্বের প্রবল প্রতাপশালী দেশ আমেরিকার মাটিতে দাঁড়িয়ে যখন বলছে আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি, তখন লাল-সবুজের পতাকার মর্যাদা যেন আরও বেড়ে গেছে।
মাত্র ছয় বছর বয়সে মা-বাবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমায় রেবেকা। গত ১০ বছরে দেশের স্মৃতি তার অন্তর থেকে ম্লান তো হয়নি বরং দেশের কল্যাণে নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অত্যন্ত সপ্রতিভ ষোড়শী রেবেকা। আর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সে জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের ঝুঁকি ও তা মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার জন্য নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
এইতো সেদিনের কথা। স্পেনের মাদ্রিদে চলছিল বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশের অধিকার আদায়ে ওই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একদিকে বাংলাদেশ সরকারের হয়ে প্রধানমন্ত্রী যেমন চেষ্টা করে যাচ্ছেন, অন্যদিকে তেমনি আন্দোলনকারীদের কাতারে থেকে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে রেবেকা। সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সে ম্যানহাটানে প্রায় দুই লাখ মানুষের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। জলবায়ু পরিবর্তনরোধে সোচ্চার সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা তুনবার্গের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ম্যানহাটানে জড়ো হওয়া আন্দোলনকারীদের সামনের সারিতে ছিল রেবেকা শবনম। তাকে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা। তারপরই সে রাতারাতি পরিচিত হয়ে ওঠে বিশ্বের কাছে। বর্তমানে নিউইয়র্কে বসবাসরত শবনমের চেষ্টা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ কতটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, সে বিষয়ে সবাইকে জানানো। নিউইয়র্কে হাজারো মানুষের সামনে সে বলেছে, ‘আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি, যা জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।’ বক্তৃতায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরে সে।
আলজাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রেবেকা বলে, ‘ভেবেছিলাম, যখন বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হবে তখন সবাই চুপ থাকবে। তবে সবার সাড়া দেখে আমি নিজেই অবাক। এটা শুধু পরিবেশগত সংকট নয়, এটা মানবাধিকার সংকটও। বাংলাদেশের নারীরা পাচারের শিকার হয়। আর এটা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আরও বেড়েছে। আমরা বাংলাদেশে থাকা নারী ও রোহিঙ্গাদের জানাতে চাই, তাদের জীবনের জন্য বিশ্বজুড়ে আন্দোলন করছি আমরা।’
রেবেকা মনে করে, সামনে হাঁটতে হবে আরও অনেক পথ। ভয়াবহ ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশের নারী, শিশু ও রোহিঙ্গাদের জন্য বিশ্বের দরবারে কীভাবে সুবিচার প্রত্যাশা করা যায়, সেটাই তার চিন্তার মূল বিষয়। রেবেকা বলেছে, জলবায়ু আন্দোলনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ কেউ যেন ভুলে না যান, তা নিশ্চিত করতে লড়াই চালিয়ে যাবে সে। আমাদের দেশে এমন রেবেকা ও ফাতিহার সংখ্যা নেহাত কম নয়, যারা পৃথিবীকে বাঁচাতে চায়। শুধু জ্বলে ওঠার অপেক্ষায়।
মোহনা জাহ্নবী