জাজাফী
একই পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া কোটি কোটি টিনএজারের সঙ্গে ফিলিস্তিনের টিনএজারদের জীবন ধারায় আকাশ-পাতাল ব্যবধান। ফিলিস্তিন হয়ে উঠেছে খোলা আকাশের নিচে পৃথিবীর বৃহত্তম জেলখানা। ফিলিস্তিনের কারোরই চোখে ঘুম নেই, পেটে খাবার নেই, ঘুমানোর জায়গা নেই, পড়াশোনা করার মতো স্কুল নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই।
গত বছর ৩১ ডিসেম্বর বেতিনে বিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফেরার পথে ১৪ বছর বয়সী স্কুলপড়ুয়া কিশোরী মালাক আল খতিবকে ইসরায়েলি বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। দিনের পর দিন অত্যাচার দেখে সে ফুসে উঠেছিল। ইসরায়েলের সশস্ত্র সেনাদের ওপর বাধ্য হয়ে সে পাথর ছুড়ে হামলা করেছিল। তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড ও দেড় হাজার ডলার জরিমানা করা হয়। কারাবন্দি এই কিশোরী ফিলিস্তিনের বর্তমান পরিস্থিতির প্রতীক।
রামাল্লার কাছে বেতিন শহরে কিশোরী মালাকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। মালাকের মা খাওলা আল-খতিব দুঃখ জড়ানো কণ্ঠে বলেন, ‘প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও গরম কাপড় ছাড়াই কিশোরী মেয়েটিকে ডাণ্ডাবেরি পরিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। এ অবস্থা দেখে মা হিসেবে আমার হৃদয় ভেঙে গেছে। আমি তার জন্য বাড়ি থেকে শীতের কাপড় নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু বিচারকের বাধার কারণে মেয়েকে দিতে পারিনি।’
মানবাধিকার সংগঠন ডিফেন্স ফর চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল প্যালেস্টাইনের (ডিসিআই প্যালেস্টাইন) হিসাব মতে, পাথর নিক্ষেপের অভিযোগে দখল করা পশ্চিম তীর থেকে ইসরায়েলি বাহিনী প্রতি বছর গড়ে হাজার খানেক শিশু-কিশোরকে আটক করে। ইসরায়েলের কারাগারে এখনো ২০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি শিশু-কিশোর কিশোরী বন্দি। ইসরায়েলে ১২ বছরের কম বয়সীদের শিশু বলা হয়। ফলে বিচার করার সময় মালাক শিশু হিসেবে বিবেচিত হয়নি। যদিও ইউনিসেফের হিসাবে, ১৮ বছর পর্যন্ত ছেলে বা মেয়ে শিশুর মর্যাদা পায়। ইসরায়েল কোনো কিছুরই ধার ধারে না।
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ফিলিস্তিনের শিশুদের প্রতি অমানবিক আচরণের জন্য ইসরায়েলের সমালোচনা করা হয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের ২০২২ সালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, গাজায় প্রতি পাঁচ শিশুকিশোরের মধ্যে চারজনই বিষণ্নতা ও ভয়ের মধ্যে বাস করছে। এখানকার অর্ধেকেরও বেশি শিশু-কিশোর আত্মহত্যার কথা ভাবে এবং অন্য শিশুদের মৃত্যুর সাক্ষী হওয়ার ট্রমা নিয়ে বেঁচে থাকে। আর এই বেঁচে থাকার সংগ্রাম দেখে দেখে তারাও হয়ে ওঠে বোমার মতো শক্তিশালী। মাহমুদ দারবিশ তাই লিখেছিলেন-
‘মৃত্যু অবধারিত, কিন্তু তাই বলে
জীবনকে তো থামিয়ে রাখা যায় না।'
আর সে কারণেই ফিলিস্তিনি কিশোর-কিশোরীরা মরণ অবধারিত জেনেও গুলতি কিংবা পাথর হাতে বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে যায় ট্যাংকের সামনে।
১৬ বছরের অকুতোভয় কিশোরী আহমেদ তামিমি। যে বয়সে হেসে খেলে পার করার কথা, সেই বয়সে সে বন্দি। কোঁকড়া চুলের এই কিশোরীর একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ভয়ংকর ক্রোধ নিয়ে সে তাকিয়ে আছে দখলদার ইসরায়েলি সেনাদের দিকে। হুঙ্কার দিয়ে চলে যেতে বলার পরও সেনারা যখন যায়নি তখন সে দুই সেনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এত কিছু করেও যখন সেনাদের সরাতে পারেনি তখন তাদের দুই গালে সজোরে থাপ্পড় মারতে শুরু করে। কী দুঃসাহসী অকুতোভয় এই কিশোরী!
কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। তাকে ও তার মাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার করা হয়েছে। তবুও সে মাথা নোয়ায়নি। তার মুক্তির জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আওয়াজ উঠেছে। কিশোরী মালাকার মতোই তামিমির বাড়িও রামাল্লাতে। ছোট বেলা থেকেই প্রতিবাদে অংশ নেওয়া তামিমি সাহসিকতার জন্য এর আগেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রশংসা কুড়িয়েছে। অনেক বছর ধরে তার গ্রামে প্রতি শুক্রবারেই প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। মাত্র ৯ বছর বয়সে তামিমি প্রথম মিছিলে অংশ নিয়েছিল। ২০১৫ সালে ১১ বছর বয়সে ইসরায়েলি সেনার হাত থেকে তার চাচাতো ভাই মোহাম্মদকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল তামিমি। এমনকি সে তার ভাইকে বাঁচাতে এক ইসরায়েলি সেনার হাতে কামড় পর্যন্ত দিয়েছিল। ওই ছবি প্রকাশের দুই বছর পর তামিমিকে তুরস্কে ‘হানদালা সাহসিকতা পুরস্কার’ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তুরস্কের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান তাকে সাক্ষাতের জন্য আমন্ত্রণ জানান। গত বছর শিশু অধিকারের ওপর একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার জন্য খোদ যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংগঠন তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তবে দুঃখজনকভাবে মার্কিন প্রশাসন তাকে ভিসা দেয়নি।
মালাক আল খতিব কিংবা আহেদ তামিমির মতোই আরেক কিশোরী উইসেল শেখ খালিল। গাজার রাস্তায় এক্কাদোক্কা খেলে বেড়ানো ১৪ বছর বয়সী এ কিশোরী এখন ফিলিস্তিনের মানুষের মনে বীর হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। অঙ্ক আর নাচে বেশ দখল ছিল ওর। রঙতুলি হাতে ধরিয়ে দিলে মনোমুগ্ধকর ছবি আঁকত। খুবই সাধারণ, শান্ত কিশোরীটি হঠাৎ করে ক্ষোভে ফেটে পড়ল। পরিবারের সদস্যরা অনেক বোঝাল। বলল সীমান্তে গেলে ইসরায়েলি সেনারা গুলি করে মেরে ফেলবে। কিন্তু সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ১১ বছরের ছোট ভাইকে নিয়ে বিক্ষোভ করতে ইসরায়েলি সেনাদের গুলি ও কাঁদানে গ্যাস উপেক্ষা করেই একেবারে সীমান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। প্রথম দিকে সে বিক্ষোভকারীদের পানির বোতল এগিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু ইসরায়েলি সেনারা দমন-পীড়ন বাড়ালে তার মনে আগুন জ্বলে ওঠে। মাতৃভূমি ফিলিস্তিনকে দখল করে গড়ে তোলা ইসরায়েলের কাঁটাতারের বেড়া কেটে ফেলতে চেষ্টা করে। একপর্যায়ে ইসরায়েলি সেনাদের স্নাইপারের গুলিতে শহীদ হয় অকুতোভয় কিশোরী উইসেল।
উইসেল তার বাবা-মাকে বলেছিল, ‘এভাবে মুখ বুঝে আর ইসরায়েলি বর্বরতা মেনে নেবো না। অবশ্যই অন্যদের সঙ্গে সীমান্তে গিয়ে বিক্ষোভ করব।’ এটাও বলেছিল, ‘মা, আমি যদি মারা যাই, তবে আমাদের ছোট্ট ঘরটিতে আমার ভাইবোনরা একটু আরামে থাকতে পারবে।’এ বছরের শুধু মে মাসে ১৮ বছরের কম বয়সী ৩৩১ জন ফিলিস্তিনিকে আটক করা হয়েছে। ২০১৬ সালে প্রতি মাসে গড়ে ৩৭৫ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক ফিলিস্তিনিকে আটক করেছিল ইসরায়েল। এরপরও তৃতীয় ইন্তিফাদা শুরুর পর অসংকোচে রাস্তায় নেমে এসেছে ফিলিস্তিনি কিশোর-কিশোরীরা। হয়তো এই পথ পাড়ি দিতে তাদেরও হয়ে উঠতে হবে মালাক, তামিমি বা উইসেল। তারপর পৃথিবীর অন্যসব টিনএজারের মতো তারাও হাসি আনন্দ ও নিরাপদে বেড়ে উঠবে মুক্ত ফিলিস্তিনে। সেই দিনের অপেক্ষায়।
কলি