ছাত্রজীবনে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উজ্জীবিত হয়েছিলেন তিনি, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশ নেন। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে লঙ্গরখানার জন্য ত্রাণ সরবরাহের পাশাপাশি নিরন্ন মানুষকে জাগিয়ে রেখেছিলেন গানে-গানে। সক্রিয় সেই রাজনীতিকর্মী এরপর সমাজ বদলের পথ হিসেবে বেছে নেন সংগীতকে। রবীন্দ্রসংগীতের পরে গণসংগীতেও তিনি প্রতিবাদ জারি রেখেছিলেন সামরিক শাসন আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে আপসহীন থেকে অচল থেকেছেন নিজস্ব মূল্যবোধে।
দেশের কিংবদন্তিতুল্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কলিম শরাফীকে তার জন্মশতবার্ষিকীতে এভাবেই স্মরণ করেছেন বরেণ্য সংস্কৃতিজনরা।
বুধবার (৮ মে) সন্ধ্যায় ঢাকার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় সংগীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী তার স্মরণসভার আয়োজন করে।
প্রথমে মিলনায়তনের বাইরে কলিম শরাফীর প্রতিকৃতিতে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন অনুষ্ঠানে আগত দর্শক ও শিল্পীরা। পরে মিলনায়তনে অনুষ্ঠানের শুরুতে কলিম শরাফীর জীবনী নিয়ে নিশাদ হোসেন রানা নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া’ প্রদর্শিত হয়। কলিম শরাফীর জীবনী পাঠ করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহসভাপতি বেলায়েত হোসেন। এরপর ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’ গানটির সঙ্গে একক নৃত্য পরিবেশন করেন নেওয়াজ মৃন্ময় রহমান। উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সংগীত বিভাগের শিল্পীরা পরিবেশন করেন দুটি সমবেত সংগীত।
উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দের সঞ্চালনায় আলোচনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী, প্রবীণ সাংবাদিক আবেদ খান, বাংলাদেশ সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ রায়, উদীচীর সহসভাপতি মাহমুদ সেলিম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন উদীচী সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান।
সারওয়ার আলী বলেন, কলিম শরাফী সারা জীবন রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করেছিলেন। কিন্তু জাতির সংকটের নানা সময়ে গণসংগীতে তিনি আশ্রয় করেছিলেন। গণসংগীতকে তিনিই নিয়ে গেছেন সাধারণ মানুষের কাছে। সারাটা জীবন সংগীতকে বহন করে চলেছেন বলে অনেক বঞ্চনার শিকার হয়েছেন তিনি। কিন্তু কখনোই তিনি গান ছেড়ে দেননি। গানে-গানে তিনি এক বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলে গেছেন।
১৯৯১ সালে যুদ্ধাপরাধী গোলম আযমের বিচারের দাবিতে প্রতিষ্ঠিত গণআদালতের অন্যতম বিচারক ছিলেন কলিম শরাফী। গণআদালতের অন্যতম সংগঠক আবেদ খান বলেন, সেসময়ে এক ভাষণে আমি যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে কড়া মন্তব্য করেছিলাম। সেই মন্তব্য শুনে শহিদজননী জাহানারা ইমাম ও ফয়েজ আহমেদ আমাকে নিয়ে ভীত ছিলেন। অনেকে আমাকে বক্তব্য সংশোধন করতে বলেছিলেন। একমাত্র কলিম শরাফী আমাকে বলেছিলেন- তুমি যা করেছ ঠিক করেছ। আজীবন সংগ্রামী মানুষটি বলতেন, মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিরুদ্ধে যারা থাকবে তাদের কখনো ছাড় নয়।
একুশে পদকপ্রাপ্ত সংগীতশিল্পী মাহমুদ সেলিম বলেন, রাষ্ট্র কলিম ভাইকে স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক দিয়েছে বটে; কিন্তু সংগীত জগৎ থেকে যে প্রাপ্য সম্মান সেটুকু পাননি। তিনি আপস করতে জানতেন না বলে অনেকের চক্ষুশূল হয়েছিলেন। তিনি কখনো সরল প্রতিবাদ করতেন না। প্রচণ্ড অভিমানী মানুষ ছিলেন। কিন্তু গান তিনি ছেড়ে যাননি কখনো। জীবনে বহু সংগ্রাম-তিতিক্ষার মাঝেও সংগীতকে তিনি জীবনের আধার করেছিলেন। একে একে তিনি বহু সংগঠন তৈরি করে গেছেন যার উত্তরাধিকার বহন করছি আমরা।
বদিউর রহমান তার বক্তব্যে কলিম শরাফীর ১০১তম জন্মদিনের আয়োজনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপনের দাবি জানান।
১৯৬৮ সালে উদীচী প্রতিষ্ঠার পরের বছরই কলিম শরাফী সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত হন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে বৃন্দ আবৃত্তি পরিবেশন করেন উদীচী কেন্দ্রীয় আবৃত্তি বিভাগের বাচিক শিল্পীরা। একক সংগীত পরিবেশন করেন মহাদেব ঘোষ, ইকবাল ইউসুফ, মাহমুনা ঐশী এবং মায়েশা সুলতানা ঊর্বি।