
মহাসমুদ্রের শত বছরের ঘুমিয়ে থাকা নীরব কল্লোলের সঙ্গে লাইব্রেরির তুলনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মানবাত্মার অমর আলোকে উদ্ভাসিত থাকে লাইব্রেরির বইগুলো। মানুষ বই পড়ে আলোকিত হয়। কিন্তু আমরা আজও এই আলোয় পরিপূর্ণভাবে উদ্ভাসিত হতে পারিনি। গতকাল ছিল জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস। দিবসটি উপলক্ষে খবরের কাগজের বিশেষ আয়োজনের বিভিন্ন প্রতিবেদনে এ রকম ছবিই উঠে এসেছে। লাইব্রেরি আছে, বই আছে, পাঠক নেই। সংকট বহুমুখী। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে আমাদের প্রতিবেদক ও সংবাদদাতারা যে প্রতিবেদনগুলো পাঠিয়েছেন তা হতাশাজনক।
খবরের কাগজে প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম থেকে জানা যায়, বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকলেও সুযোগ ঘটছে না। নানা সংকটের কারণে বইপাঠকে আমরা জনপ্রিয়, এমনকি সহজ-স্বাভাবিক করতে পারিনি। এ রকম কয়েকটি শিরোনাম: ‘রাজধানীর লাইব্রেরি: বই আছে পাঠক নেই’; ‘চাকরিপ্রত্যাশীরাই আসেন বেশি’; ‘জনবলসংকটে ব্যাহত হচ্ছে কার্যক্রম’; ‘সাইনবোর্ডসর্বস্ব পাবলিক লাইব্রেরি’; ‘কালের সাক্ষী কোহিনুর লাইব্রেরি হারাতে বসেছে ঐতিহ্য’; ‘বই আছে, নেই পড়ার মানুষ’; ‘ভবন সম্প্রসারণ হয়নি, জনবলসংকটও মেটেনি’; ‘গোপালগঞ্জের নজরুল পাবলিক লাইব্রেরি, পাঠকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন’।
উল্লিখিত শিরোনামগুলো হতাশাজনক। তবে এই হতাশার বিপরীতে আশাপ্রদ সংবাদও আছে। সবচেয়ে উজ্জ্বল সংবাদটি বান্দরবানের উপজেলা রুমা থেকে পেয়েছি আমরা। সেখান থেকে পাঠানো প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বান্দরবান জেলার সবচেয়ে দুর্গম জনপদ রুমায় জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে ‘মোহিনী সৃজনশীল পাঠাগার’। এই পাঠাগারটি সরকারি কোনো পাঠাগার নয়, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও পায় না। প্রায় একক প্রচেষ্টায় নিজস্ব অর্থায়নে পাঠাগারটি গড়ে তুলেছেন এবং পরিচালনা করছেন শিশুসাহিত্যিক ও কবি ‘অরণ্য ক্যানভাস’ পত্রিকার সম্পাদক কাজী মোহিনী ইসলাম। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া বইয়ের প্রতি ভালোবাসা থাকলে যে পাঠকদের জন্য পাঠাগার গড়ে তোলা যায়, তা এই পাঠাগারটিই প্রমাণ। আমাদের প্রান্তিক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশু-কিশোরদের গ্রন্থপাঠে উদ্বুদ্ধ করার মতো অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে পাঠাগারটি।
সমস্যাগুলো আমাদের অধিকাংশ প্রতিবেদনেই তুলে ধরা হয়েছে। বেশির ভাগ লাইব্রেরিতে প্রয়োজনীয় বই পাওয়া যায় না। রয়েছে নতুন বইয়ের অপ্রতুলতা। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় না। পাঠাগারের পরিবেশ পাঠকবান্ধব নয়। রয়েছে জনবলসংকট। অব্যবস্থাপনায় হারিয়ে গেছে লাইব্রেরির জৌলুশ ও ঐতিহ্য। লাইব্রেরির সংস্কারকাজের ধীরগতির জন্য নতুন করে নির্মিত ভবনে পাঠাগার চালু করা যায়নি।
একটা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চট্টগ্রাম বিভাগীয় গণগ্রন্থাগার ভবনের সংস্কার তিন বছরে শেষ করার কথা থাকলেও সাত বছরেও শেষ হয়নি। এক বছর আগে নির্মিত জামালপুর জেলা গণগ্রন্থাগারের ভবন মাটিতে দেবে গেছে। লাইব্রেরির জন্য বরাদ্দ করা বাজেটও অপ্রতুল। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক আফসানা বেগম এই বাজেটসংকটের কথা উল্লেখ করেছেন আমাদের প্রতিবেদকের কাছে। অনেক পাঠাগার বছরের পর বছর বন্ধ রয়েছে। লাইব্রেরিতে পাঠক যারা আসেন, তারাও আসেন চাকরির সঙ্গে সম্পর্কিত বই পড়তে অথবা চাকরির প্রস্তুতি নিতে। এই প্রবণতাও কাম্য নয়। সব মিলিয়ে জাতীয়ভাবে লাইব্রেরি এবং বই পড়ার হতাশার চিত্রই ফুটে উঠেছে আমাদের বিশেষ আয়োজনের প্রতিবেদনগুলোয়। তবে এখনকার অবস্থা যতই প্রতিকূল হোক, এই হতাশাজনক পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো জরুরি।
দেশব্যাপী পাঠাগার আন্দোলন গড়ে তোলা গেলে এই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। আসলে লাইব্রেরিকে ঘিরে যত ধরনের সমস্যা আছে, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সেসব সমস্যার সমাধান করে গ্রন্থপাঠের প্রতি পাঠকদের আকৃষ্ট করতে পারে। বাংলাদেশের বিভিন্ন ছোট-বড় শহর ও জনপদের যারা বই ভালোবাসেন, লেখক, সংস্কৃতিকর্মী, তাদের স্থানীয়ভাবে উদ্বুদ্ধ করা হলে পাঠাগার আন্দোলন বাস্তবায়িত করা সহজ হবে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি ও স্থানীয় প্রশাসন সম্মিলিতভাবে এই আন্দোলনটি সফল করে তুলতে পারে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সেদিকে নজর দেবে বলে প্রত্যাশা করছি। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন, ‘এসো এখানে এসো, এখানে আলোকের জন্মসংগীত গান হইতেছে’, দেশব্যাপী লাইব্রেরি আন্দোলনের সূচনা করে আমরা জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক, জ্ঞানতাত্ত্বিক ও সৃজনশীলতাকে সমৃদ্ধ করতে পারি।