বর্তমানে হাতের মুঠোয় প্রযুক্তি। যেকোনো তথ্য মুহূর্তে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে খুব সহজে করা যায় ভাবের আদান-প্রদান ও তথ্যের বিনিময়। ফলে মানুষের জীবনযাত্রা হয়েছে সহজ ও সাবলীল। তবে একইসঙ্গে তথ্যের অবাধ প্রবাহ মানুষকে তুমুল বিভ্রান্ত করছে। প্রতিনিয়ত বিপদে ফেলছে। ব্যক্তিগত তথ্য কিংবা অন্যের যেকোনো তথ্য সুরক্ষার ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনা অত্যন্ত কঠোর। তথ্য প্রকাশ করে মানুষকে বিপদে ফেলা বা গুজব ছড়ানো গুনাহ। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অধিক ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। নিশ্চয়ই কতক ধারণা গুনাহ। তোমরা অন্যের দোষ খোঁজাখুঁজি করো না, একে অন্যের অনুপস্থিতিতে দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো সেটাকে ঘৃণাই করে থাকো...।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১২)
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের ৪৩নং ধারা অনুযায়ী ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ১২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি কখনোই অন্য এক ব্যক্তির গোপনীয়তা, পারিবারিক বিষয়, বাসস্থান বা যোগাযোগে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এমনকি আত্মসম্মান নষ্ট হয় এমন কোনো পদক্ষেপও নিতে পারবে না। ইসলামে ব্যক্তিগত ও অন্যের তথ্য সুরক্ষা করা ঈমানি দায়িত্ব। মানুষের দোষ খুঁজে বলে বেড়ানো পাপ। এতে মানুষের জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্রে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। মুয়াবিয়া (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তুমি যদি মানুষের গোপনীয় বিষয় জানার জন্য পেছনে লাগো। তাদের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করবে কিংবা অন্তত বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ৪৮৮৮)
ব্যক্তিজীবনের কোনো তথ্যই মূল্যহীন নয়; বরং সময়ের পরিক্রমায় অতি সামান্য তথ্যও আপনাকে ঘায়েল করার গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হতে পারে। তাই সব সময় নিজের গোপনীয় বিষয় সংরক্ষণে সতর্ক থাকতে হবে। অন্যের গোপনীয় বিষয় প্রকাশ করা যাবে না। কারও গোপনীয়তা নষ্ট হয়, এমন কাজে জড়ানো যাবে না। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীরা এবং তোমাদের মধ্যে যারা বয়োপ্রাপ্ত হয়নি, তারা যেন তোমাদের কক্ষে প্রবেশ করতে তিন সময়ে অনুমতি গ্রহণ করে...।’ (সুরা নুর, আয়াত: ৫৮) কারও গোপনীয় বিষয় সন্ধান করা থেকে সতর্ক করে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হে লোকজন! যারা মুখে ঈমান এনেছ, কিন্তু এখনো ঈমান তোমাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি, তোমরা মুসলিমদের গোপনীয় বিষয় খুঁজে বেড়িও না। যে মুসলিমদের দোষ-ত্রুটি তালাশ করে বেড়াবে আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটির অন্বেষণে লেগে যাবেন। আর আল্লাহ যার ত্রুটি তালাশ করেন তাকে তার ঘরের মধ্যে লাঞ্ছিত করে ছাড়েন।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ৪৮৮০)
সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ও অপরাধীর সঠিক শাস্তির বিধানের জন্য রাষ্ট্রের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অপরাধীর সব তথ্য প্রকাশ করার জন্য ইসলামে নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘যখন তাদের কাছে নিরাপত্তার কিংবা ভয়ের কোনো সংবাদ আসে, তখন তারা তা রটিয়ে দেয়। যদি তারা তা রাসুলের কিংবা তাদের মধ্যে যারা ক্ষমতার অধিকারী তাদের গোচরে আনত, তবে তাদের মধ্য থেকে তথ্যানুসন্ধানীরা প্রকৃত তথ্য জেনে নিত। যদি তোমাদের প্রতি আল্লাহর দয়া ও করুণা না থাকত, তবে তোমাদের অল্পসংখ্যক ছাড়া সবাই শয়তানের অনুসরণ করত।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ৮৩)
আজকাল প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় আমরা খুব সহজে নানাবিধ তথ্য পাই। তথ্য পেলেই প্রথমে যাচাই করতে হবে। এর সত্যতা নিশ্চিত করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! কোনো ফাসেক যদি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে ভালোভাবে যাচাই করে দেখবে—যাতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি করে না বসো। ফলে নিজেদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদের অনুতপ্ত হতে হয়।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ৬)
যাচাই না করে সংবাদ প্রচার করা নিজেকে মিথ্যাবাদী হিসেবে পরিচিত করার বহিঃপ্রকাশ। তথ্য পেলেই যাচাই করা ছাড়া প্রচারের নিন্দা করেছেন আল্লাহতায়ালা। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই কান, চোখ, অন্তরের প্রতিটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ৩৬)
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ