ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হচ্ছে। আর সেই সঙ্গে শুরু হয়ে যাবে কক্সবাজারগামী পর্যটকদের আনাগোনা। কক্সবাজারে নির্মিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন রেল স্টেশন। ট্রেন সার্ভিসের পাশাপাশি কক্সবাজারের পর্যটনকে উন্নত শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সম্ভাবনা ও সংকটের কথা জানাচ্ছেন জাজাফী।
দেশের প্রধানতম পর্যটন নগরী কক্সবাজার। ঘোরার জন্য ভ্রমণপিয়াসী মানুষ কক্সবাজারকে প্রথম পছন্দ হিসেবে বেছে নেয়। কক্সবাজারের সঙ্গে ঢাকার রেল যোগাযোগ চালু হওয়ায় দেশের যোগাযোগব্যবস্থায় নতুন অধ্যায় তৈরি হলো। পর্যটন খাতে আয়ও বাড়বে। কর্মসংস্থানও বাড়বে হবে।
অর্থনীতির পরিভাষায় যোগান বৃদ্ধি পেলে দাম কমার কথা।
যেহেতু যোগাযোগের বড় মাধ্যম ট্রেন, তাই ধরে নেওয়া যায় পর্যটকদের বিরাট অংশ কক্সবাজার যাওয়া আসার ক্ষেত্রে রেলপথ বেছে নিবে। এটা হলে বাস এবং বিমানের যাত্রী সংখ্যা অনেকটাই কমে যাবে। ফলে বাস ও বিমান যাত্রী ধরে রাখতে ভাড়া কমানো ছাড়া পথ থাকবে না। অনেক বয়স্ক বা অল্প বয়সী মানুষও দীর্ঘ পথ বাসে ভ্রমণ করতে পারে না। তা ছাড়া দীর্ঘ ক্লান্তিকর ভ্রমণেও অনেকের মধ্যে অনীহা দেখা দেয়।
ট্রেনে হেঁটে বেড়ানো যায়। চা কফি খাওয়া যায়। টয়লেটের ব্যবস্থা থাকে, বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে পিকনিকের আমেজে যাওয়া যায়। এ ছাড়া কর্তৃপক্ষের দেওয়া হিসাব মতে ট্রেনের ভাড়া হবে বাসের প্রায় অর্ধেক বা তারও কিছু কম। ফলে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ দেশের অন্যান্য রুটের তুলনায় এই রুটে সারা বছরই যাত্রী পাবে এবং সঠিকভাবে সেবা দিতে পারলে রেলওয়ের ভালো আয় হবে। তবে সেবার মান নিশ্চিত করতে হবে।
এসব সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু আশঙ্কাও রয়েছে। পর্যটক বেড়ে গেলে হোটেল মোটেলে জায়গার সংকুলান হবে না। এটাকে পুঁজি করে হোটেল মোটেলের ভাড়া বাড়ানো হতে পারে। একইসঙ্গে অন্যান্য সেবা খাত যেমন, খাবারের হোটেল, প্রয়োজনীয় পণ্য, স্থানীয় গাড়ি ভাড়া সব বেড়ে যেতে পারে। প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে।
পরিবেশ দূষণের হার বাড়তে পারে। সেই সঙ্গে সমুদ্র সৈকত এলাকায় অপরাধ প্রবণতাও বাড়তে পারে এবং সৈকতের পরিবেশও নষ্ট হতে পারে। যে পরিমাণ ধারণ ক্ষমতা আছে তার চেয়ে বেশি পর্যটকের আগমনে সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট হতে পারে। অন্যদিকে ট্রেন চালুর পর গণপরিবহনের ভাড়া কমানো বা যাত্রী কমে যাওয়ার বিষয়টি আমলে নিয়ে একটি চক্র ভয়বহ সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
আর সেটা হতে পারে মানুষকে ট্রেন থেকে বিমুখ করা। এ জন্য ট্রেনে পাথর ছুড়ে মারার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। অন্যদিকে টিকিট নিয়ে দালালচক্র সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ পর্যটকনির্ভর। মরিশাস, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভুটান, মালদ্বীপ অন্যতম। পর্যটকে সত্যিকার অর্থে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছে বলেই ওসব দেশে পর্যটকদের আনাগোনা অনেক বেশি।
বাংলাদেশ থেকেও প্রতি বছর ওসব দেশে হাজার হাজার পর্যটক যাচ্ছেন। ওসব দেশে গিয়ে পর্যটকরা যেমন সেবা ও পরিবেশ পেয়ে থাকেন তার ছিটেফোঁটাও আমাদের পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে নেই। ফলে বিদেশি পর্যটকরা তো নয়ই, দেশি পর্যটকরাও এখানে আসতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। আর্থিক সঙ্গতি আছে এমন দেশি পর্যটকরাও বিদেশমুখী হন।
সুতরাং পর্যটন শিল্প বলে আমরা যেটাকে আখ্যায়িত করি সেখানে পর্যটন শব্দটি থাকলেও শিল্প খুব একটা নেই বলাই চলে। শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারলেই কেবল এ খাত হয়ে উঠতে পারে অত্যন্ত লাভজনক এবং দেশ এই খাত থেকে অনেক বেশি লাভবান হতে পারে। ঈর্ষণীয় বৈদেশিক মুদ্রাও আয় হতে পারে। সে ক্ষেত্রে যাতায়াত ভাড়া, হোটেল ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এসব নিয়ে নিউজ হলেও আশানুরূপ পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না।
এসব অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ করাসহ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করলেই তবে এ খাত হয়ে উঠতে পারে অপার সম্ভাবনাময়। এ ছাড়া কক্সবাজারে সমুদ্র সৈকত ছাড়া আর কোনো বিনোদন মাধ্যম নেই। নেই কোনো সিনেপ্লেক্স, মাল্টিপ্লেক্স, উল্লেখ করার মতো শিশুপার্ক বা অন্যান্য বিনোদন কেন্দ্র। ফলে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এখানে এসে খুব সহজেই হতাশ হয়ে পড়ে, আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
বর্তমান পরিস্থিতিতেও কক্সবাজার থেকে মাসে শত কোটি টাকা রাজস্ব পাচ্ছে সরকার। কিন্তু সেই তুলনায় সরকারি তেমন সুযোগ সুবিধা নেই বলে পর্যটকরা মনে করে। সৈকত এলাকায় মোবাইলে ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের অবস্থাও খুব দুর্বল। তারা চাইলেও ঘরে রেখে আসা প্রিয়জনদেরকে ভিডিও কলে বা লাইভের মাধ্যমে সমুদ্র দেখাতে পারে না। অথচ পুরো জোনটাকে ফ্রি ওয়াইফাই জোন করে দেওয়া যায়।
লাবণী পয়েন্ট থেকে কলাতলী পয়েন্ট পর্যন্ত এই তিন চার কিলোমিটার এলাকায় ১০০০টি রাউটার লাগালে এবং প্রতিটির জন্য মাসে ১ হাজার টাকাও যদি খরচ হয় তবে মাসে ইন্টারনেট বাবদ খরচ হবে ১০ লাখ টাকা। যেখানে সরকার শত কোটি টাকা মাসে রাজস্ব পাচ্ছে সেখানে পর্যটকদের জন্য এই ব্যয় খুবই সামান্য। সৈকত এলাকায় যে বাতিগুলো আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম আলো দেয়।
জায়গাটা আলোকোজ্জ্বল করতে পারলে সৈকত উঠতো নিরাপদ এবং আকর্ষণীয়। এমনকি এই সব ক্ষেত্রে যা খরচ সেটাও সরকার চাইলে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমেও মেটাতে পারে। দরকার শুধু উদ্যোগের। এই শহরে যাতায়াতের জন্য ব্যাটারিচালিত রিকশা বা টমটমই একমাত্র বাহন। কিন্তু সেটার ভাড়ার কোনো বিধিনিষেধ নেই। যার কাছ থেকে যত হাঁকিয়ে নিতে পারে। পর্যটকদের জিম্মি করে রাখা হয়।
৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার পথ ব্যাটারিচালিত টমটমে যাওয়া আসার জন্য ভাড়া নেওয়া হয় ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা! পাঁচ কিলোমিটার পথ যেতেও তারা ভাড়া দেড় শ থেকে দুই শ টাকা দাবি করে। যেখানে যেতে তাদের মাত্র ১০ থেকে ১২ মিনিট সময় লাগে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে শুধু ট্রেন সার্ভিস দিয়ে কক্সবাজারের পর্যটন কখনোই উন্নত শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছাতে পারবে না।
কলি