
আল্লাহতায়ালার দেওয়া নেয়ামতের মধ্যে একটি বড় নেয়ামত হলো চোখ। চোখের মাধ্যমেই আমরা আল্লাহতায়ালার সৃষ্টিসমূহ দেখি, তারপর চিন্তা ও উপলব্ধি করে জ্ঞান অর্জন করি। ইমাম কুরতবি (রহ.)-এর মতে, ‘চোখ অন্তরে কোনো কিছু প্রবেশের বড় দরজা।’ অর্থাৎ চোখ হলো মানবাত্মার চিন্তার খোরাকের প্রবেশদ্বার। অন্তরে প্রশান্তি আর পরকালে সুখময় জীবনলাভের জন্য চোখের যেমন বিকল্প নেই, তেমনি বড় বড় পাপ কাজের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও চোখের দৃষ্টির বিকল্প নেই। সাধারণত বড় বড় পাপ কাজ সম্পাদনের প্রাথমিক ধাপ হলো চোখ।
পশ্চিমা সংস্কৃতিকে অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে মানুষ দিন দিন তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ হারিয়ে ধ্বংসের দিকে আপতিত হচ্ছে। তাই সমাজকে এই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে বাঁচাতে দৃষ্টির হেফাজতের বিকল্প নেই। দৃষ্টির হেফাজতের মাধ্যমেই একজন মুসলমান প্রকৃত মুমিনে পরিণত হতে পারে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন। (সুরা নূর, ৩০)
দৃষ্টির মাধ্যমে শয়তান মানুষকে পথভ্রষ্ট করে দিতে যেমন উদ্ধত, তেমনি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাও দৃষ্টির হেফাজতের মাধ্যমে মানুষের অন্তরে প্রশান্তি দান করতে সর্বদা প্রস্তুত। দৃষ্টির হেফাজতের মাধ্যমেই আল্লাহতায়ালা মানুষের অন্তরে নূর সৃষ্টি করেন। আর এ নূরের কারণে একজন ব্যক্তির ইলমের পথ খুলে যায় এবং ইলমের সব উপকরণ তার জন্য সহজ হয়ে যায়। এটি মানুষের অন্তরে তৃপ্তি, আনন্দ এবং উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে। আমরা যখনই বেগানা কোনো নারী বা পুরুষের দিকে দৃষ্টিপাত করি তখন আমাদের মনে অস্থিরতা কাজ করে। যার কারণে আমরা কাজে-কর্মে মনোযোগ দিতে পারি না, রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারি না। দৃষ্টির হেফাজতের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা অন্তরের এসব অশান্তি, ছটফটানি, আফসোস থেকে মানুষকে হেফাজত করে।
চোখের হেফাজত মানুষকে জাহান্নাম থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে। কেননা কুদৃষ্টি মানুষকে অশ্লীল কাজের দিকে ধাবিত করে। দৃষ্টির হেফাজত দ্বারা মানুষের দূরদর্শিতা বৃদ্ধি পায় এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সক্ষম হয়। এ সম্পর্কে আল্লামা কিরমানী (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তি তার বাহ্যিক দিকসমূহকে সুন্নাত দ্বারা সাজায়, আর সব সময় অন্তর দিয়ে আল্লাহর কথা চিন্তা করে, নিষিদ্ধ বস্তু হতে চোখকে হেফাজত করে, প্রবৃত্তিকে অন্যায় কর্ম হতে বিরত রাখে এবং হালাল খায়- সে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে কখনোই অক্ষম হবে না। অর্থাৎ, নিজেকে কুপ্রবৃত্তি থেকে দূরে রাখতে দৃষ্টির হেফাজতের গুরুত্ব অপরিসীম।
দৃষ্টি সংযত নিয়ে আমাদের সমাজে নারীদের মধ্যে কিছু ভুল ধারণা আছে। অনেকে মনে করেন আল্লাহতায়ালা কেবল পুরুষদেরকেই দৃষ্টি সংযত করার নির্দেশ দিয়েছেন। কাজেই একজন নারীর বেগানা পুরুষের দিকে তাকানোকে তারা তেমন ক্ষতিকর মনে করেন না। অনেক পর্দাশীল নারীদের অন্তরেও এ ভুল ধারণা লালিত আছে। কিন্তু আল্লাহতায়ালা নারী-পুরুষ উভয়কেই দৃষ্টি সংযত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন এ কথা আমরা অনেকেই জানি না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, মু’মিনা নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থান হেফাজত করে। (সুরা নূর, ৩১)
দৃষ্টি সংযত রাখা মানে অন্ধ হয়ে চলাকে বুঝায় না, বরং হারাম বস্তুকে উপেক্ষা করাই হলো দৃষ্টি সংযত রাখা। চোখের মাধ্যমেই যেহেতু ফিতনার আশঙ্কা বেশি থাকে, সেহেতু আমাদের দৃষ্টিকেই প্রথমে সংযত রাখতে হবে। আর দৃষ্টি সংযত রাখার প্রধান উপায় হলো দৃষ্টি অবনত রাখা। হারাম বা ফিতনার দিকে নিয়ে যায় এমন বস্তু থেকে সর্বদা দৃষ্টি অবনত রাখতে হবে। আর যদি অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেসব বস্তুর প্রতি দৃষ্টি চলে যায়, তা হলে সাথে সাথেই তা ফিরিয়ে নিতে হবে। দ্বিতীয়বার যেন মুখ ফেরানো না হয়। কেননা দ্বিতীয়বারের তাকানোতে শয়তানের কুমন্ত্রণা থাকে। আমাদেরকে যখনই শয়তান দৃষ্টির খিয়ানত করার কুমন্ত্রণা দেয়; সাথে সাথেই আল্লাহর জিকিরে নিমগ্ন থাকতে হবে। কারণ আল্লাহর জিকির মানুষকে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে হেফাজত করে এবং অন্তরে প্রশান্তি দান করে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহকে ভয় করে, শয়তানের কোনো দল যখন তাদের ঘিরে ধরে, তারা আল্লাহকে স্মরণ করে। সুতরাং তাদের অনুভূতি চলে আসে।’ (সুরা আরাফ, ২০১)
পরিশেষে, দৃষ্টিকে সংযত রাখতে হলে আমাদেরকে বিশুদ্ধচিত্তে নিয়ত করতে হবে। প্রত্যেক কাজ নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। আমরা যখন পাপ থেকে দূরে থাকার নিয়ত করি, আল্লাহতায়ালা তখন আমাদের ওপর খুশি হন। আল্লাহ ফেরেশতাদের বলেন, আমার বান্দা যখন পাপ করার ইচ্ছা করে, তখন তোমরা তা আমলনামায় লিখো না যতক্ষণ না সে ওই পাপটি করে। যদি সে তা করে সমান পাপ লিখ। আর যদি সে তা আমার কারণে ত্যাগ করে, তা হলে তার এই পাপটি নেকি হিসেবে লিখো। আর যদি বান্দা নেকি করার ইচ্ছা করে কিন্তু সে ওই নেকি করেনি, তার জন্য তা নেকি হিসেবে লিখো। অতঃপর যদি সে নেকি করে তা হলে তার জন্য ওই নেকি দশগুণ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত লিখো। (বুখারি ও মুসলিম)। হতে পারে দৃষ্টি সংযত রাখার ইচ্ছা পোষণ এবং তা বাস্তবে লালন করার মাধ্যমেই আল্লাহতায়ালা আমাদের নেকির পরিমাণ দশগুণ থেকে সাতশ গুণ বাড়িয়ে দেবেন।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়