যুক্তরাষ্ট্রের একটি থিংক ট্যাংক বলেছে, গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে জয়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার মার্কিন কর্মকর্তাদের স্বীকৃতি ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি লাভের পর দেশ পরিচালনায় যাত্রা মসৃণ হচ্ছে। গত ৮ এপ্রিল আটলান্টিক কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে ভারতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি গৌতম লাহিড়ী লিখেছেন, মার্কিন সরকারের সমর্থন ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি লাভের সঙ্গে সঙ্গে ‘হাসিনার সরকার পরিচালনার জাহাজটি এখন মসৃণ সমুদ্রে যাত্রা করছে।’ লাহিড়ী উল্লেখ করেছেন, ‘জানুয়ারিতে তার দলের জয়ে এই অঞ্চলের প্রায় সব মহলেই প্রশংসার ঢল নেমেছে। শেখ হাসিনা একটি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী এশিয়ার অন্যতম পরাশক্তি চীন ও ভারত উভয়েই তার নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন দিয়েছিল। আঞ্চলিক শক্তি, মতাদর্শগত এবং রাজনৈতিক ঝোঁকনির্বিশেষে তার প্রশাসনকে অভিনন্দন জানাতে ছুটে এসেছে।’ লাহিড়ী লিখেছেন, যাই হোক আওয়ামী লীগ সরকারের বেশির ভাগ দৃষ্টি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। এটি বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্র’ প্রচারের জন্য কতটা সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করেছে তা দেখে। ‘যদিও মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছিল, নির্বাচনগুলো অবাধ বা সুষ্ঠু ছিল না। মার্কিন কর্মকর্তারা নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।’
কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বিস্তারের প্রয়াসে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু প্রণীত পররাষ্ট্রনীতিকে গ্রহণ করেছেন এবং এর সুফল ভোগ করছে বাংলাদেশের জনগণ। দ্বিপক্ষীয় ইস্যুতে ন্যায্যতার ভিত্তিতে তিনি সম্পর্ককে মূল্যায়নের চেষ্টা করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক ইস্যুতে শেখ হাসিনার সাহসী কণ্ঠস্বর বাংলাদেশের চলার পথকে ক্রমশ মসৃণ করে তুলছে।
লাহিড়ী বিপুলসংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থীর দিকে ইঙ্গিত করে উল্লেখ করেছেন, দলের সিনিয়র ব্যক্তিদের স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দিয়ে আওয়ামী লীগ অবশ্যই সম্ভাব্য অন্তর্দলীয় বিরোধের ঝুঁকি নিয়েছিল। ‘তবু এটি ভোটারদের প্রকৃত নির্বাচনি বিকল্প প্রদান এবং সংসদে কণ্ঠস্বরের বৈচিত্র্যকে প্রসারিত করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, একটি নির্বাচনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপ্রতিরোধ্য সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা একটি দল একদলীয় রাষ্ট্রের সমতুল্য নয়। বাংলাদেশকে একদলীয় রাষ্ট্র না বানিয়ে অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একই রকমের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। উল্লেখ্য, কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কী করবে না, এটা তাদের একান্ত নিজস্ব বিষয়। বিগত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট প্রদানের সুযোগ পেয়েছেন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতেই সরকার গঠিত হয়েছে।
বিদেশিদের মূল্যায়নকে কেনই-বা গুরুত্ব প্রদান করতে হয়? বিদেশিদের অভিমতকে গুরুত্ব দেওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তা ছাড়া এ মূল্যায়ন যদি গবেষণাকেন্দ্রিক হয়ে থাকে, তাহলে সেটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য ততধিক অর্থবহ হয়ে থাকে। বিশেষ করে গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে একটি সমালোচনামূলক আলোচনা তথা তুলনামূলক আলোচনার প্রতিচিত্র দেখা যায়। সে জায়গা থেকে যারা সত্যিকারের পাঠক ও মূল্যায়নের ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় তারা প্রকৃত অর্থে সঠিক বার্তা পেয়ে থাকে। বাংলাদেশের পথচলাকে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করে থাকেন।
যারা বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তুমুল সমালোচক, তারাও বাংলাদেশের দৃশ্যমান উন্নয়নের প্রশংসা করতে দ্বিধা করেন না। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে যেসব দৃশ্যমান কর্মকাণ্ড সম্পাদিত হয়েছে, অনেকেই সে উন্নয়নে অভিভূত এবং সেসব সম্পর্কে তাদের মুগ্ধতার বাণী ছড়িয়ে থাকেন। আবার সমালোচকরা এও বলে থাকেন, টানা সরকারে থাকলে এমন উন্নয়ন অসম্ভব নয়। তথাপি দেশ যোগ্য নেতৃত্বের ধারকের হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে চলছে তথা চলার পথকে মসৃণ করে সামনে অগ্রসরমাণ সে ব্যাপারে স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠবোধ করে থাকে। প্রকৃত অর্থে বিদেশি সংস্থা তথা পর্যবেক্ষকদের মাধ্যমে গবেষণাভিত্তিক মূল্যায়নের পরবর্তী সময়ে ইতিবাচক ভাবধারায় সংবাদের ব্যাপক গুরুত্ব হয়েছে।
প্রথমত, বাংলাদেশের অগ্রগতিকেন্দ্রিক বিদেশি সংস্থার মূল্যায়ন সাধারণ জনগণকে সরকার ও দেশের প্রতি বিশ্বাস ও ভরসার জায়গা সত্যিকার অর্থে বৃদ্ধি ও বেগবান করে থাকে। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিরূপণে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের সময়ক্ষেপণের কারণে সাধারণ জনতা অনেক সময় মিথ্যা তথ্যকে সঠিক হিসেবে ধরে নিয়ে ভ্রান্ত ধারণার ওপর ভর করে থাকে। এ ধরনের মূল্যায়নের প্রচারের মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে সত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি দেশের উল্লেখযোগ্য অর্জনের স্বীকৃতিকে অর্থবহ হিসেবে উপস্থাপনে সহায়তা করে থাকে।
দ্বিতীয়ত, গুজব, মিথ্যার বেসাতি, মিথ্যা তথ্য দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যারা একটি আধিপত্য বিস্তার করে সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্তিতে নিপতিত করতে চায়, তাদের প্রতি একটি বিশেষ বার্তা হিসেবে এ ধরনের মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ। তাদের একেবারে মাটিতে নামিয়ে আনা কিংবা এ গোষ্ঠী সম্পর্কে সাধারণ জনগণের ধারণা কালক্রমে নেতিবাচক আকারে উপস্থাপিত হবে। আমরা মনে করি, এ ধরনের গবেষণালব্ধ ফলাফল তাদের প্রতি একধরনের চপেটাঘাত। এ সরকার বেশি দিন টিকতে পারবে না, অচিরেই নির্বাচন দিতে হবে, বিদেশিদের চাপ রয়েছে সরকারের ওপর; এ ধরনের বক্তব্যকে মিথ্যা প্রমাণিত করার হাতিয়ার হিসেবে মার্কিন থিংক ট্যাংকের মূল্যায়ন যুগোপযোগী জবাব।
তৃতীয়ত, কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এ ধরনের গবেষণা ফলাফলের মাধ্যমে যারা প্রকৃত অর্থে দেশের জন্য শ্রম দিচ্ছেন, দেশকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছানোর নিমিত্তে নিরবধি কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের পূর্ণোদ্যোমে উৎসাহ-উদ্দীপনায় কাজের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি হবে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা প্রদান করে। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের নির্বাচনি ইশতেহারের অন্যতম কর্মসূচি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রয়াসকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে মার্কিন থিংক ট্যাংকের গবেষণা ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে দেখা দেবে।
চতুর্থত, বিদেশিদের কাছে একটি পরিষ্কার বার্তা প্রদানের লক্ষ্যে এ ধরনের গবেষণালব্ধ ফলাফল একটি মাইলফলক হিসেবে আবির্ভূত হবে। মাইলফলক এই অর্থে বিদেশিরা কূটনৈতিক, ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক ও অন্যান্য খাতে তাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বাংলাদেশকে বাছাই করে নেবে। শুধু তা-ই নয়, ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ থাকায় বিদেশিরা অন্য দেশ থেকে বিনিয়োগ তুলে এনে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছেন। এ ধরনের নজির যেহেতু ইতোপূর্বে ঘটেছে, সমসাময়িক সময়েও এ ধরনের ঘটনা ঘটারসমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, তার প্রধান শক্তি এ দেশের জনগণ। কাজেই বাংলার মানুষের কল্যাণের জন্য তিনি কল্যাণকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, এটাই অনুমেয়। শত প্রতিকূলতাকে মাড়িয়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে তিনি পদ্মা সেতু নির্মাণের ঝুঁকি গ্রহণ করে গৃহীত সিদ্ধান্ত সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করেছেন। অধিকন্তু পথপরিক্রমায় উদ্ভূত নানাবিধ সংকট ও প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে তিনি সামনে বিজয়ীর বেশে পথ চলছেন।
বর্তমান সরকার গঠন করার পরবর্তী সময়ে তিনি কূটনৈতিক সফরগুলোতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে মজবুত করে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের চিত্র বিনির্মাণে সম্পর্ক জোরদারে চুক্তি সম্পাদন করছেন। এ জন্যই বলা যায়, আগামীতে দেশে-বিদেশে দই জায়গায় শেখ হাসিনার পথচলা মসৃণ হলে বাঙালিদের জন্য আশানুরূপ পরিবর্তন আনয়নে সক্ষম হবেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষদের ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেটি তিনি সম্পন্ন করেছেন। তিনি ভিশন ২০৪১ প্রস্তাব করেছেন এবং দেশ যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে অগ্রসরমাণতা বহমান থাকলে অচিরেই বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধ ও সোনার বাংলায় পরিণত হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি
ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়