রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মতো মেসওয়াক ব্যবহার করা সুন্নত। আসুন তার ব্যবহারের পদ্ধতি জেনে নিই। জাইতুন ও খেজুর গাছের ডাল দিয়ে মেসওয়াক করেছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। এগুলো দিয়ে মেসওয়াক করা উত্তম। এ ছাড়া তিক্ত স্বাদযুক্ত গাছের ডাল (নিম) হলেও ভালো। মেসওয়াকে বাড়তি ফায়দা হাসিলের জন্য কাঁচা ও নরম ডাল হওয়া ভালো। মেসওয়াক হাতের আঙুলের মতো মোটা ও এক বিঘত পরিমাণ লম্বা হওয়া মুস্তাহাব; এটা আবশ্যকীয় নয়।
মেসওয়াক ধরার সুন্দর একটি পদ্ধতি বলেছেন সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)। তিনি বলেছেন, ডান হাতের কনিষ্ঠাঙ্গুলি মেসওয়াকের নিচে থাকবে। মধ্যমা ও তর্জনীর ওপরে ও বৃদ্ধাঙ্গুলি নিচে রেখে মেসওয়াক ধরা। এতে করে মুখের ভেতর ভালোভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মেসওয়াক করা যায়।
মেসওয়াক করার সুন্নতসম্মত পদ্ধতি
ডান হাতে মেসওয়াক নিয়ে ডান দিক থেকে মেসওয়াক শুরু করা। দাঁতে প্রস্থে ও জিহ্বায় লম্বালম্বি মেসওয়াক করা সুন্নত। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৭; আল বিনায়া, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২০৪, আদ্দুররুল মুখতার, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ১১৩)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা মেসওয়াক করো। কারণ মেসওয়াক মুখ পবিত্র ও পরিষ্কার করে এবং এটা মহান প্রভুর সন্তুষ্টি লাভের উপায়। আমার কাছে যখনই জিবরাইল (আ.) এসেছেন, তখনই আমাকে মেসওয়াক করার উপদেশ দিয়েছেন। শেষে আমার আশঙ্কা হয়, তা আমার ও আমার উম্মতের জন্য ফরজ করা হবে। আমি যদি আমার উম্মতের জন্য কষ্টকর হওয়ার আশঙ্কা না করতাম, তাহলে তাদের জন্য তা ফরজ করে দিতাম। আমি এত বেশি মেসওয়াক করি, আমার মাড়িতে ঘা হওয়ার আশঙ্কা হয়।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২৮৯, ইবনে খুজাইমা, হাদিস: ১৩৫)
রাসুলুল্লাহ (সা.) যে সময় মেসওয়াক করতেন: হাদিসের আলোকে জানা যায়, রাসুলুল্লাহ (সা.) দিন-রাতের বিভিন্ন সময় মেসওয়াক করতেন। যথা—
১. ঘুম থেকে উঠেই বা তাহাজ্জুদ আদায়ের আগে: হুজাইফা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) রাতের বেলা যখন তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য উঠতেন, তখন মেসওয়াক দ্বারা মুখ পরিষ্কার করে নিতেন।’ (বুখারি, হাদিস: ১১৩৬; মুসলিম, হাদিস: ৫১৬)
২. ঘরে প্রবেশ করে মেসওয়াক করতেন: আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘরে প্রবেশ করে প্রথমে মেসওয়াক করতেন’। (মুসলিম, হাদিস: ২৫৩)
৩. শয্যার পাশে মেসওয়াক রাখতেন: আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) শয্যার পাশে মেসওয়াক রেখে ঘুমাতেন। ঘুম থেকে উঠে প্রথমে মেসওয়াক করতেন।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ৫৯৬৯)
৪. অজুর আগে মেসওয়াক করতেন: আয়েশা (রা.) বলেন, ‘দিনে বা রাতে যখনই রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘুম থেকে জাগ্রত হতেন, অজু করার আগে মেসওয়াক করে নিতেন।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ২৪৯০০)
৫. নামাজ ও অজুর সময় মেসওয়াকের গুরুত্ব: রাসুলুল্লাহ (সা.) অজুর আগে মেসওয়াক করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। কোনো কোনো বর্ণনার ভাষ্য এমন, ‘আমার উম্মতের ওপর যদি (অধিক) কষ্টের আশঙ্কা না হতো; তাহলে আমি তাদের ওপর প্রত্যেক অজুর সময় মেসওয়াক করাকে আবশ্যকীয় করে দিতাম।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ৯৯২৮)
৬. জুমার দিনে মেসওয়াক: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির জন্য জুমার দিন গোসল ও মেসওয়াক করা কর্তব্য এবং সে সামর্থ্য অনুযায়ী সুগন্ধিও ব্যবহার করবে।’ (মুসলিম, হাদিস: ১৮৪৫)
মুখ অপরিষ্কার বা গন্ধযুক্ত থাকলে, কোরআন তেলাওয়াতের আগে, মসজিদে প্রবেশের আগে, কারও সঙ্গে সাক্ষাতের আগে, কোনো দ্বীনি মজলিসে বসা বা যাওয়ার আগে মেসওয়াক করার কথা বিভিন্ন হাদিস থেকে পাওয়া যায়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) মৃত্যুর আগমুহূর্তেও মেসওয়াক করেছেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) আমার ঘরে আমার বুকে মাথা রাখা অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তিনি অসুস্থ হলে আমাদের মধ্যকার কেউ দোয়া পড়ে তাঁকে ঝাড়ফুঁক করতেন। আমি তাকে ঝাড়ফুঁক করছিলাম এ সময় আব্দুর রহমান ইবনে আবু বকর এলেন। তার হাতে মেসওয়াকের একটি তাজা ডাল ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) তখন সেদিকে তাকালেন। আমি বুঝতে পারলাম, তিনি মেসওয়াকের প্রয়োজন বোধ করছেন। আমি সেটি নিয়ে চিবিয়ে প্রস্তুত করে তাঁকে দিলাম। তিনি এর দ্বারা সুন্দরভাবে মেসওয়াক করলেন, যেমনটি তিনি (সুস্থতার সময়) করে থাকেন। অতঃপর তিনি তা আমাকে দিলেন। পরক্ষণই তার হাত ঢলে পড়ল। দুনিয়ার জীবনের শেষ দিনে এবং আখেরাতের প্রথম দিনে আল্লাহতায়ালা আমার থুথুকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর থুথুর সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন। (বুখারি, হাদিস: ৪৪৫১)
মেসওয়াক সঙ্গে রাখা উচিত
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নতের অনুসরণে আমাদের সঙ্গে সব সময় মেসওয়াক রাখা উচিত। আবু সালামা (রহ.) বলেন, ‘আমি জায়েদকে (রা.) দেখেছি, তিনি মসজিদে বসে থাকতেন, আর মেসওয়াক তার কানের ওই স্থানে থাকত; যেখানে লেখকের কলম থাকে। যখনই তিনি নামাজের জন্য যেতেন মেসওয়াক করে নিতেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ৪৭)
সালেহ ইবনে কায়সান (রহ.) বলেন, ‘উবাদা ইবনে সামেত (রা.)-সহ এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অন্য সাহাবিরা চলাফেরা করার সময় তাদের কানের ওপর মেসওয়াক গুঁজে রাখতেন।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস: ১৮০৫)
রাসুলুল্লাহ (সা.) অজুর পানি দিয়ে দাঁতন (ভিজিয়ে) (মেসওয়াক) করতেন। (মুসনাদে আবু ইয়ালা, কানজ, খণ্ড: ৭, পৃষ্ঠা: ২৫) তারপর তিনি আড়াআড়ি দাঁত ঘষতেন, খাড়াখাড়ি নয়; কিন্তু জিহ্বটা খাড়াখাড়ি ঘষতেন। (আবু নোয়াইম আহমাদ, তালখিস, পৃষ্ঠা: ২৩) এরপর তিনি সেটাকে ধুয়ে কানে কলম রাখার মতো কানের ওপর রাখতেন। (তাবারানি, তালখিস, পৃষ্ঠা: ২৫)
লেখক : আলেম, গবেষক ও সাংবাদিক