নোবেল বিজয়ের ১৩ বছর পর ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে বিশ্বকবি খ্যাত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় এসেছিলেন। থেকেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদারের (আর সি মজুমদার) বাংলোতে। টানা ৯ দিনের ঢাকা সফরে ঘুরেছেন পুরান ঢাকা ও নব্য গড়ে ওঠা রমনায়। অবস্থান করেছিলেন বুড়িগঙ্গায় নবাব সলিমুল্লাহর ছেলে খাজা হাবিবুল্লাহর বিলাসবহুল জলযানে। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) আয়োজনে কার্জন হলে দুটো বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তৎকালীন মুসলিম হলে (সলিমুল্লাহ মুসলিম হল) গাঁদা ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল রবি ঠাকুরকে, জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থীদের অনুরোধে বাসন্তিকা পত্রিকার জন্য লিখে দিয়েছিলেন ‘বাসন্তিকা’ কবিতা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে রবীন্দ্রনাথের এমন অনেক স্মৃতিই রয়েছে, যেগুলো শুধু বইয়ের পাতায় বদ্ধ। রবীন্দ্রনাথের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্রমণের কোনো স্মারকচিহ্নের দেখা না মিললেও আর সি মজুমদারের সঙ্গে তোলা রবি ঠাকুরের একটি স্থিরচিত্র মেলে।
হলটির শহিদ অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য স্মৃতি গ্রন্থাগারের রক্ষিত ছেঁড়া-জীর্ণ-শীর্ণ ৪৩ বছরের আগের একটি বাসন্তিকা পত্রিকায় মিলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই ছবিটি। জগন্নাথ হলের বাসন্তিকা পত্রিকায় রজতজয়ন্তী সংখ্যায় আর সি মজুমদারের লিখা ‘কবিস্মৃতি- রবীন্দ্রনাথ’ এর মধ্যে ছোট আকারের রবীন্দ্রনাথের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে ৯ দিন ভ্রমণের অনেক স্মৃতিই উঠে আসে। ১৯০৫ সালে রমেশ চন্দ্র মজুমদার কলকাতা কলেজে ভর্তি হওয়ার পর বন্ধুদের আড্ডায় রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গ চলে আসতো, যদিও তখন রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাননি। বন্ধুমহলের সবচেয়ে বড় কুলদাপ্রসাদ মল্লিকসহ কয়েকজনের অংশগ্রহণে ‘রবীন্দ্র চক্র’- এর বৈঠক বসত। সেই থেকে রবীন্দ্রভক্ত হয়ে পড়েন আর সি মজুমদার।
আর সি মজুমদার জগন্নাথ হলের বাসন্তিকার রজতজয়ন্তীর সংখ্যায় ‘কবিস্মৃতি- রবীন্দ্রনাথ’ এর প্রথমাংশে এভাবে লিখেছেন, ‘সন্ধ্যায় ইনস্টিটিউটে, কখনো বা শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে আমাদের এই ছোট্ট রবীন্দ্রচক্রের বৈঠক বসত এবং আমরা কয়েকজন রবীন্দ্রনাথের পরম ভক্ত হয়ে উঠলাম। তারপরে ৬৭ বছর কেটেছে- সে ভক্তি কখনো কমেনি, শতগুণ বেড়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ যখন আসেন, তখন তাকে অনেকটা কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন আর সি মজুমদার। বাসন্তিকায় লিখা শুধু ‘কবিস্মৃতি- রবীন্দ্রনাথ’ এ নয়, ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত ‘জীবনের স্মৃতি দ্বীপে’ বইয়ের ‘ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র’ অংশে ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসাকে ঘিরে বিস্তর বর্ণনা করেছেন আর সি মজুমদার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে যখন রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন ঘটনাক্রমে কবিগুরুর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল আর সি মজুমদারের বাসায়।
১৯২৬ সালে কবিগুরু যখন ঢাকা আসবেন বেশ শোরগোল পড়েছিল। তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক জর্জ হ্যারি ল্যাংলির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হয় রবীন্দ্রনাথ আর সি মজুমদারের বাড়িতে থাকবেন। আর রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ এবং রবীন্দ্রসংগীতের প্রধান স্বরলিপিকার দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র সহযোগী কালীমোহন ঘোষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাড়িতে থাকবেন। এবং কবির সঙ্গী ইতালির খ্যাতনামা অধ্যাপক জিয়োসেপ্নে তুচ্চিসহ দুজন বিদেশি সঙ্গী থাকবেন উপাচার্যের বাসভবনে। যদিও বাকিদের থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢাকার লোকজনের মাথাব্যথা না থাকলেও কবি ভক্তদের মাঝে বেশ শোরগোল শুরু হয়ে গিয়েছিল ঢাকাজুড়ে।
আর সি মজুমদার ‘কবিস্মৃতি- রবীন্দ্রনাথ’ এ উল্লেখ করেছেন, ‘ঢাকায় দু-চারজন লোক বেশ শোরগোল পাকিয়ে তুলল। তারা রবীন্দ্রনাথকে জানাল যে, ঢাকার জনসাধারণের এ ইচ্ছা নয় যে তিনি আমার বাড়িতে থাকেন। এই নিয়ে অনেক অপ্রীতিকর ব্যাপার ঘটে ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার অনেক চিঠি লেখালেখি হয়। ফলে রবীন্দ্রনাথ তার বিশ্বভারতীর অধ্যাপক শ্রী নেপালচন্দ্র রায়কে সরেজমিনে তদন্ত করবার জন্য ঢাকায় পাঠালেন। নেপালবাবু ফিরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে জানালেন যে, দু-একটি লোক ছাড়া আমার বাড়িতে থাকায় সকলেরই সম্মতি আছে। তখন স্থির হলো রবীন্দ্রনাথ আমার বাড়িতেই থাকবেন।’
অন্যদিকে ‘জীবনের স্মৃতি দ্বীপে’ বইয়ের ‘ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র’ অংশে মজুমদার লিখেছেন তার পাঠানো এক চিঠির প্রেক্ষিতে একটি চিঠিতে- ‘রবীন্দ্রনাথ লিখলেন যে, তিনি আমার বাড়িতেই থাকবেন।’
রবীন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন গোয়ালন্দ, নারায়ণগঞ্জ হয়ে। তিনি ১৯২৬ সালের ৭ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছান।
আর সি মজুমদার ‘জীবনের স্মৃতি দ্বীপে’ বইয়ের ‘ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র’ অংশে লিখেছেন, ‘নারায়ণগঞ্জ স্টিমার স্টেশন থেকে গাড়ি করে রবীন্দ্রনাথকে ঢাকায় আমার বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। সেখানকার বড় বড় জমিদার, বিশেষতঃ ভাওয়ালের রাজকুমার এবং ঢাকার নবাব, আমায় বলে পাঠালেন যে রবীন্দ্রনাথের জন্য কোনো গাড়ি দরকার হলে আমি যেন তাদের জানাতে দ্বিধা না করি। রবীন্দ্রনাথের আগমন উপললক্ষে ঢাকায় বিপুল উদ্দীপনা; রাস্তায় বহু লোক তাকে সংবর্ধনা জানালেন।’
যখন আর সি মজুমদারের বাড়িতে কবি গুরু প্রবেশ করেন ব্যাপক উৎসাহ আর উদ্দীপনায় তাকে সাদরে গ্রহণ করা হলো। ঢাকা শহরের ভদ্র সমাজের মানুষজনের উপস্থিতিও ছিল বেশ।
‘জীবনের স্মৃতি দ্বীপে’ আর সি মজুমদার অনেকটা এভাবেই বর্ণনা করেছেন, ‘তার আসার দিন আমার গৃহদ্বারে, সিঁড়িতে, ওপরের বারান্দায় এবং ঘরে নানারকম আলপনা আঁকা হয়, দরজার সামনে মঙ্গলকলস এবং আম্রপল্লব। ...কবি এসে পৌঁছানমাত্রই তার ওপর ফুলবর্ষণ শুরু হলো। মেয়েরা শঙ্খধ্বনিতে তাকে স্বাগত জানালেন। মঙ্গল-কলসের মাঝে পথ দিয়ে আমরা বাড়িতে প্রবেশ করলাম।’
আর সি মজুমদারের এই বর্ণনা তাই প্রমাণ করে নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথকে এক পলক দেখতে এবং তার যেন সম্মান আর কদরের ঘাটতি না হয় বেশ সচেতনই ছিলেন তারা। ১৯০৯-১০ সালের দিকে কলকাতায় হায়দরাবাদ থেকে একজন বড় সংগীতজ্ঞ ও বাদকের আসরে রবি ঠাকুরের গলায় প্রথম গান শোনেন। পঞ্চাশ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে শুনলেন ‘তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী।’
আর সি মজুমদার ‘কবিস্মৃতি- রবীন্দ্রনাথ’ এর মধ্যে লিখেছেন, ‘পঞ্চাশ বছর বয়সে তার গলায় যে সুর ধ্বনিত হলো সারা সভাকক্ষ তার মূর্ছনায় ভরে গেল। গানের প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট বুঝতে পারা যাচ্ছিল-যা আজকালের রবীন্দ্রসংগীতে দুর্লভ।’
১৯২৬ সালে কবিগুরুর ঢাকা ভ্রমণ প্রসঙ্গে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্র-রচনা’ শীর্ষক এক লিখাতে লিখেছেন, ‘১৯২৬-এর ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখে ঢাকা মিউনিসিপ্যাল নর্থব্রুক হলে সংবর্ধনা গ্রহণ দিয়ে ঢাকা কর্মসূচি শুরু করলেও ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলের (এখন সলিমুল্লাহ মুসলিম হল) কর্মসূচি দিয়েই মূলত তার বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক কর্মসূচির সূচনা।’
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে যখন রবীন্দ্রনাথকে ফুলেল সংবর্ধনা দেওয়া হয় তখন বৈদ্যুতিক পাখায় গাঁদা ফুলের পাপড়ি বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেই না পাখা চালিয়ে দেওয়া হলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল ফুলের পাপড়ি, চারপাশ করতালিতে ধ্বনিত হলো।
এদিকে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক এক লেখায় ১০ ফেব্রুয়ারি দুপুরে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ওই ফুলেল সংবর্ধনা প্রসঙ্গে লেখেন, ‘‘সংবর্ধনা সভায় হলের ছাত্ররা রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি অভিনন্দনপত্র পাঠ করেন। মুসলিম হলের শিক্ষার্থীদের আন্তরিক সংবর্ধনায় রবীন্দ্রনাথ বিশেষভাবে অভিভূত হয়ে পড়েন। সংবর্ধনার উত্তরে তাই তিনি প্রথমেই বলেন, ‘এই সভাগৃহে প্রবেশ করার পর থেকে এ পর্যন্ত আমার ওপর পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে। প্রাচীন শাস্ত্রে পড়েছি কৃতী ব্যক্তির ওপর পুষ্পবৃষ্টি হয়। এ পুষ্পবৃষ্টি যদি তারই প্রমাণ করে তবে আমি আজ আনন্দিত।’ অভিভাষণের শেষে কবি বলেন, ‘ঈশ্বর এক, তার মধ্যে কোনো ভেদ নাই। যিনি সকল বর্ণের, সকল জাতির জন্য নিত্য, তার গভীর প্রয়োজন প্রকাশ করছেন।’’
অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষের ওই লেখার সূত্রে জানা যায়, ১০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ডাকসুর আয়োজনে কার্জন হলে তিনি উপস্থাপন করেন প্রথম বক্তৃতা: ‘দ্য বিগ অ্যান্ড দ্য কমপ্লেক্স’।
বিশ্বজিৎ ঘোষ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক ওই লেখাতে উল্লেখ করেন, “সভার প্রারম্ভে সমবেত সুধীদের কাছে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় দিতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর জি এইচ ল্যাংলি বলেন: ‘এটা আমাদের পক্ষে আজ একটা পরম সুযোগ যে, এই সন্ধ্যায় পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পী আমাদের কাছে কিছু বলবেন।’
ওই সন্ধ্যায় রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ ভাষণ উপস্থাপন করেন। তার ভাষণের মূল কথা ছিল: শিল্প-সৃষ্টি বিষয় ও ভাবের আবেগময় বিবরণ বা নিবেদন। তাই এটা কখনোই ক্যামেরায় তোলা ফটোর মতো নয়। শিল্পী খুবই ভাবপ্রবণ এবং তার এই প্রবণতা বিষয় নির্বাচনের রুচি-বাগীশতাতেই নয়, তার শিল্পের প্রত্যেকটি বিস্তৃত ব্যাপারেও। ...আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, ঈশ্বর তার সৃষ্টির মধ্যে বাস করেন। শিল্পীও তেমনি নিজেকে মেলে ধরেন তার শিল্পের মাঝে। শিল্পীর শিল্পাদর্শ নিছক বিলাস বা কল্পনা-উদ্ভূত নয়, তা পরম বাস্তব।”
পরবর্তীতে অসুস্থতার কারণে ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী কর্মসূচিগুলো বাতিল করা হয়। অধ্যাপক ঘোষ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্রনাথ’ ১৯২৬ সালের বাসন্তিকা (জগন্নাথ হল বার্ষিকী) পত্রিকার সূত্র টেনে ওই পত্রিকায় লেখা হয়- “কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সংবর্ধনার জন্য, হল ইউনিয়ন বিপুল আয়োজন করিয়াছিলেন। কবি হঠাৎ অসুস্থ হইয়া পড়ায় সংবর্ধনা হইতে পারে নাই। কার্জন হলে আমাদের হলের পক্ষ হইতে কবিকে একটি অভিনন্দনপত্র দেওয়া হয়। অভিনন্দনপত্র মূল্যবান বস্ত্রে মুদ্রিত ও রৌপ্যখচিত হয়ে ভেলভেট নির্মিত একটি সুদৃশ্য আধারে কবিকে উপহূত করা হয়। কবি ইহার কারুকার্যে অতীব প্রীত হইয়াছিলেন।”
অসুস্থ হলে সিভিল সার্জন ও ঢাকার অন্যান্য বড় বড় ডাক্তাররা শরীর পরীক্ষা করতে হাজির হন আর সি মজুমদারের বাড়িতে। আর সি মজুমদার তার ‘জীবনের স্মৃতি দ্বীপে’ লিখেছেন, “ডাক্তারেরা দেখে বললেন যে অসুখের কোন লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথ শুনে বললেন যে অসুখ তেমন কিছু নয়। তবে বহুদিন পরে পূর্ব বাংলায় এসেছি; মনে হয় জলে একটু থাকতে পারলে ভাল হতো।”
পরবর্তীতে বুড়িগঙ্গার ওয়াইজঘাটে নবাব সলিমুল্লাহর ছেলে খাজা হাবিবুল্লাহর বিলাসবহুল জলযান তুরাগ হাউস বোটে কবির থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ছাত্র নাট্যকার শ্রীমন্মথ রায়ের দায়িত্বে ২০-২৫ জন উৎসুক ছাত্র তার পরিচর্যার দায়িত্ব নিলেন। জানা যায়, তুরাগ হাউস বোটে অবস্থানকালীন সময়ে প্রতিদিন সকালে রবীন্দ্রনাথ ঢাকার নবাবদের মোটরচালিত বোটে বুড়িগঙ্গায় ভ্রমণে বের হতেন। প্রায় ছয় থেকে সাত মাইল ভ্রমণ করতো মোটরচালিত বোট।
বুড়িগঙ্গায় জলযান বিলাসের পুরো সময় জুড়ে দেখভালে পাশে ছিলেন তৎকালীন জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট আর সি মজুমদার ও তার স্ত্রী। এই সময় জুড়ে অনেক মানুষ সাক্ষাৎ করতে আসতেন। আর সি মজুমদার কবিস্মৃতি- রবীন্দ্রনাথ এ লিখেন, “এক দিন বিকালে প্রায় ৪০-৫০ জন উপস্থিত। রবীন্দ্রনাথ আমার স্ত্রীকে ডেকে বললেন, এদের একটু জলযোগের ব্যবস্থা কর। আমার বাড়ি সেখান থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে। কিন্তু মন্মথ তার ছাত্রদলকে নানা দিকে পাঠিয়ে আধ-ঘণ্টার মধ্যেই শহর থেকে প্রচুর মিঠাই ও চায়ের ব্যবস্থা করল।”
পয়ষট্টি বছরের রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বেশ ভোজনরসিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে যখন তিনি এলেন প্রতিদিন তার খাবারে বড় কই মাছ খাবারে দেওয়া হতো এর পাশাপাশি অন্যান্য তরকারিও থাকত। মাছ খেয়ে বেশ খুশিও হতেন তিনি। আর সি মজুমদার তার ‘জীবনের স্মৃতি দ্বীপে’ বইতে লিখেছেন, “অন্যান্য তরকারির সঙ্গে তিনি পুরো মাছটিও খেতেন। খেয়ে তিনি খুব খুশী হতেন- বলতেন, ‘পূর্ব বাংলার মতো মাছ রান্না আমাদের ওদিকে করতে পারে না।”
মেয়ের নামে কবিতা এবং রবীন্দ্রনাথের নাম চুরি:
আর সি মজুমদারের একমাত্র পুত্রসন্তানের নাম ছিল অশোক, ডাক নাম রবি। রবির বয়স তখন নয় দশ বছর হবে। সকলকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছিলাম যতদিন রবীন্দ্রনাথ থাকবেন যেন তাকে রবি বলে ডাকা না হয়। কিন্তু একদিন ঘটে বিপত্তি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর সি মজুমদারের ছেলের নাম জিজ্ঞেস করলে সে বলে, ‘রবি।’
এ নিয়ে আর সি মজুমদার ‘জীবনের স্মৃতি দ্বীপে’ লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথ আমার ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার নাম কি?’ সে, বলে বসল ‘রবি।’ তখন তিনি গম্ভীরভাবে আমাকে ও আমার স্ত্রীকে ডেকে বললেন, ‘তোমরা তো লোক ভালো নও।’ আমরা তো কিছু বুঝতে না পেরে ভয়ানক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি। ‘কি ব্যাপার?’ তিনি বললেন, ‘আমি আসার আগেই আমার নামটা তোমরা চুরি করেছ। সুতরাং এরপর আরও অন্য জিনিস চুরি করতে পার।’ আমরা হেসে উঠলাম।”
ওই বইতে মেয়ে ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঘিরে তিনি আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “আমার বড় মেয়ের বয়স তখন বারো তেরো বছর। এক দিন হঠাৎ সে রবীন্দ্রনাথের সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি নাকি খুব বড় কবি? আপনি নাকি অনেক কবিতা লিখেছেন।’ রবীন্দ্রনাথ একটু হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, এই দুর্নাম আমার আছে।’ অমনি একটি ছোট খাতা বার করে সে বলল, ‘আমায় নামে একটি কবিতা লিখে দিন না।’ রবীন্দ্রনাথ তার নাম জিজ্ঞাসা করলেন- ভালো নাম ও ডাক নাম। এবং তৎক্ষণাৎ তার সেই ছোট খাতায় তারই কলমে একটি কবিতা লিখে দিলেন- তার মধ্যে তার দুটি নামই আছে। আমার এই মেয়ের বিবাহের সময় এই কবিতাটি প্রতিলিপিসহ ছাপিয়েছিলাম। পরে রবীন্দ্রনাথের ‘স্ফুলিঙ্গ’ নামক ছোট একখানি পুস্তিকায় ও রচনাবলিতে এটি ছাপা হয়েছে। তবে তাতে ঘটনাটির কোনো উল্লেখ নেই।
বইটির একটি জায়গায় আর সি মজুমদার লিখেছেন, “৯দিন রবীন্দ্রনাথ আমার অতিথি ছিলেন।”
সরেজমিনে গিয়ে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথের আসা প্রসঙ্গে কোনো তথ্য কিংবা স্মারকচিহ্নের খোঁজ পাওয়া যায়নি। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের হল প্রভোস্টের কক্ষে দেখা মেলে হলটির আজীবন সদস্যের নাম যেখানে কবিগুরুর অবস্থান দ্বিতীয়।
এদিকে জগন্নাথ হলের শহিদ অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য স্মৃতি গ্রন্থাগারে দেখা মিলে রজতজয়ন্তী বাসন্তিকা পত্রিকার একটি সংখ্যা। যার মারফতে তৎকালীন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ছবি, বাসন্তিকা পত্রিকা এবং ওই পত্রিকায় লিখা তৎকালীন হল প্রভোস্ট অধ্যাপক রমেশচন্দ্রের ‘কবিস্মৃতি- রবীন্দ্রনাথ’ পাওয়া যায়।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের গ্রন্থাগারিক আলম সরকার এবং জগন্নাথ হলের সহকারী গ্রন্থাগারিক বিমল চন্দ্র সরকারের ধারণা, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সেইসব কাগজ পুড়িয়ে দেওয়া হতে পারে। তাদের মতো একই ধারণা পোষণ করেন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ।
সার্বিক বিষয়ে তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কারের ১৩ বছর পর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলে, বক্তৃতা রেখেছিলেন, এটি নিশ্চয়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যে কারণেই হোক শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না, রেকর্ড সংরক্ষণের প্রতি গোটা জাতির ইতিহাসে মনোযোগের অভাব রয়েছে। এ বিষয়ে তথ্য ছবিসহ রেকর্ড সংরক্ষিত অবস্থায় নেই। মাত্র একটি মাত্র ছবি পাওয়া যায়, তৎকালীন জগন্নাথ হলের প্রভোস্টের সঙ্গে।’
এর পেছনে তিনটি কারণে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমত, তখন হয়তো ক্যামেরার ব্যবহার এতটা ব্যাপক ছিল না। দ্বিতীয়ত, ১৯৭১ সালে যেভাবে জগন্নাথ হল তছনছ হয়েছে; আমার ধারণা এ ধরনের কোনো রেকর্ড যদি থাকতো হয়তো সেটা তখন নষ্ট হয়ে গেছে। তৃতীয়ত আমরা জাতিগতভাবেই রেকর্ড সংরক্ষণের প্রতি ততটা মনোযোগী না। ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ডি.লিট উপাধি দেয়। সেই তথ্যও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকর্ডে নেই, বিশ্বভারতীর ফাইলে পেয়েছি। তেমনি অসুস্থতার কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে ডি.লিট উপাধি গ্রহণের জন্য আসতে পারবেন না- এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে চিঠি দিয়েছিলেন সেটিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত নেই। পরবর্তীতে সেটি আমি জাদুঘরে দেখেছিলাম।’
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে আজীবন সদস্য করার কারণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ দশটা বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের এই অঞ্চলে ছিলেন। বাঙালি এবং একজন বিখ্যাত নোবেল বিজয়ী। কেউ কেউ বিখ্যাত মানুষকে সম্মান দেখালে নিজেই অনেকটা সম্মানিত হয়। হয়ত এই বোধ থেকেই আজীবন সদস্য করা হয়েছে।’
বিশ্ববিদ্যালয় এ নিয়ে কাজ করতে পারে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় করতে পারে, তবে খুব যে বেশি তথ্য পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তারপরে বিশ্ববিদ্যালয় চাইলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নজরুলকে নিয়ে একসঙ্গে একটি কাজ করলেও করতে পারে। আমি অনেক খুঁজেছি, কলকাতায় খুঁজেছি; তেমন একটা পাইনি। ফলে এটি একটি কঠিন কাজ। এটা আমাদের জাতিগত সংকট, আমরা পুরোনো জিনিস ওভাবে রাখি না ধ্বংস করে ফেলি।’