হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)-এর প্রেসিডেন্ট এম. শাহাদাত হোসাইন তসলিম। এর আগে তিনি দুইবার এ সংগঠনের প্রেসিডেন্ট ও একবার মহাসচিব ছিলেন। কুমিল্লার এ কৃতিসন্তান পড়াশোনা করেছেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। একাধারে তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী, সমাজসেবক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। আল-রশিদ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ২০০১ সাল থেকে জড়িত আছেন হজ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে। বাংলাদেশের হজ ব্যবস্থাপনাকে সহজ, সুন্দর ও আদর্শ হজ ব্যবস্থাপনায় উন্নীত করার নেপথ্য কারিগর তিনিই। হজ ব্যবস্থাপনা, হাজিদের করণীয়-বর্জনীয়, হাবের সঙ্গে দীর্ঘ পথচলা ও ব্যক্তিজীবনের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন মিরাজ রহমান ও রায়হান রাশেদ
খবরের কাগজ: টানা তৃতীয়বারের মতো হাবের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন, অনুভূতি কী?
তসলিম: টানা তিনবার (২০১৯ থেকে বর্তমান) আমি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছি—প্রতিবারই পূর্ণ প্যানেলে জয় পেয়েছি। আর এর আগে একবার মহাসচিব (২০১৭-২০১৯) নির্বাচিত হয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহতায়ালার রহমত, হাজিদের দোয়া এবং হাব সদস্যদের ভালোবাসা এবং আস্থায় এটা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের ৯৫% হাজিদের হজকেন্দ্রিক সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ কর্মযজ্ঞটি হাবের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। পৃথিবীতে হাব-ই একমাত্র সংগঠন, যার অধীনে এত অধিকসংখ্যক মানুষ বেসরকারিভাবে হজে যায়। আমিসহ আমার নির্বাচিত সহকর্মীরা হাবের মাধ্যমে অর্পিত হজকেন্দ্রিক দায়িত্বকে ইবাদত মনে করে পালন করি। তাই হাব সদস্যরা আমাদের ওপর এ গুরুদায়িত্ব অর্পণে আস্থা রাখেন।
খবরের কাগজ: আপনার নেতৃত্বে হাবে সংঘটিত হয়েছে এমন কিছু কাজের কথা বলুন, যা এর আগে হয়নি।
তসলিম: বাংলাদেশের হজ ব্যবস্থাপনায় বেশকিছু বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনা ছিল। হজযাত্রীদের কষ্টের অনেক বিষয় ছিল। অনেক অনিয়ম ছিল। সততা, নৈতিকতা ও ন্যায়বিচারের ঘাটতি ছিল। আমরা এগুলো চিহ্নিত করে আন্তরিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করেছি। সারাজীবনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে হাজিরা বিভিন্নভাবে প্রতারিত হতেন এবং এজেন্সি মালিকরা বঞ্চিত হতেন নৈতিক ও যৌক্তিক অনেক অধিকার থেকে। উভয় পক্ষীয় সমস্যার সমাধানের একটি সেতুবন্ধন তৈরিতে কাজ করেছি। যেমন—হজযাত্রীদের ব্যবহার অনুপযোগী একটি ব্যাগ নিতে বাধ্য করা হতো। এ ব্যাগের পেছনে ছিল অনৈতকতার চর্চা। হাজিদের থেকে বেশি টাকা নিয়ে কম টাকায় ব্যাগ সরবরাহের ব্যাপারটি গোটা হজ ব্যবস্থাপনার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। অনৈতিক এ বাণিজ্য বন্ধে আমি এক প্রকার যুদ্ধ করেছি। আল্লাহ আমার সহায় হয়েছেন এবং এটি বন্ধ হয়েছে। সরকার ব্যাগ-ব্যবস্থা চালু করেছিল ভালোর জন্য, কিন্তু কিছু সুযোগসন্ধানী এর অপব্যবহার করেছিল।
হজযাত্রী রিপ্লেসমেন্টে বিড়ম্বনায় পড়তে হতো। টাকার লেনদেন করতে হতো। সেটাও আমরা বন্ধ করেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল হজ ব্যবস্থাপনার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। এখন রিপ্লেসমেন্টের জন্য কারও কাছে যেতে হয় না। এজেন্সিগুলো নিজ অফিসে বসেই অনলাইনে এটা করতে পারেন।
এ ছাড়া ডিজিটাল হজ ব্যবস্থাপনারই সুফল হিসেবে হজযাত্রীদের নিবন্ধন, প্রাক-নিবন্ধনের পদ্ধতিটি সহজ হয়েছে। আগে হজের তিন মাস আগে নিবন্ধন, প্রাক-নিবন্ধন প্রক্রিয়াটি মাত্র ৭ দিনের জন্য খুলে দেওয়া হতো। এটা নিয়ে তৈরি হতো ব্যাপক জটিলতা। আমরা এটিকে সহজ করেছি। সারা বছর নিবন্ধনের সুযোগ রেখেছি।
খবরের কাগজ: আপনি একজন সফল ব্যবসায়ী, সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদ। এ পথচলার অনুপ্রেরণা কে?
তসলিম: সফলতা আপেক্ষিক বিষয়। সফলতার শেষ নেই। আমি যতটুকু কাজ বা যা-ই করেছি, যা-ই বুঝেছি, অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি—এসবের মূল প্রেরণা আমার আব্বা মাওলানা রশিদ আহমদ। তিনি বাংলাদেশের বিখ্যাত একজন আলেম, লেখক ও পণ্ডিত ছিলেন। শিক্ষকতা করেছেন, করেছেন ব্যবসাও। তিনি ছিলেন নিভৃতচারী একজন সমাজসেবক। বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি আমার জীবনের পাথেয়। আমি তার কাছ থেকেই সবকিছু শিখেছি। আব্বার পরে আম্মা এখন পর্যন্ত আমার অনুপ্রেরণার উৎস। আমি তার কাছে এখনো বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হই। তিনি আমাকে গাইড করেন। আলহামদুলিল্লাহ, আমার জীবনের সবকিছু জুড়ে আছে আব্বা-আম্মার দোয়া ও প্রভাব। পাশাপাশি আমার শিক্ষকদের অবদানও অনস্বীকার্য।
খবরের কাগজ: জীবনে চলার পথে যখন এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হন—কি সিদ্ধান্ত নেবেন তা বুঝে উঠতে পারেন না, তখন কী করেন?
তসলিম: ব্যক্তিগত জীবনে আমি এমন পরিস্থিতিতে দৃঢ় থাকি। সহজে ভেঙে পড়ি না। আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি। বেশি বিপদে বা কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে, আমি সিজদায় পড়ে যাই। সিজদায় লুটিয়ে পড়ে রাব্বুল আলামিনের কাছে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফরিয়াদ জানাই।
খবরের কাগজ: হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
তসলিম: বাংলাদেশের হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। এ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আল্লাহকে পাওয়ার যেমন সুযোগ রয়েছে, তেমন জাহান্নামে যাওয়ার মাধ্যমও হতে পারে এটি। আমি এখানে কাজ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চাই। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, হজযাত্রীদের খাদেম হয়ে থাকা। খাদেম হিসেবে থাকার এ নিয়তের বরকতেই আমি হাবের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে আছি। এ পদে থাকি আর না থাকি— হজযাত্রীদের খাদেম হিসেবে আশকোনা হজক্যাম্পে এক বোতল পানি নিয়ে হলেও এ সেবায় আমি আজীবন থাকতে চাই।
বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত মুসলিম দেশের আদলে বাংলাদেশের হজ ব্যবস্থাপনাকে আমি আদর্শ ও মডেল হজ ব্যবস্থাপনায় উন্নীত করতে চাই। বিশেষভাবে হজ ও ওমরাযাত্রীদের জন্য বিশ্বমানের হজ ও ওমরা সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা আমার জীবনের অন্যতম সেরা স্বপ্ন। প্রত্যেক হজ ও ওমরাযাত্রী হজ বা ওমরা পালনে যাওয়ার আগে এ সেন্টার থেকে বাস্তবসম্মত হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজেকে প্রস্তুত করবেন। এমন ব্যবস্থাপনা ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কিছু মুসলিম দেশে রয়েছে।
আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি—যদি এ রকম একটি হজ ও ওমরা সেন্টার করা যায়, তা হলে বাংলাদেশের কোটি কোটি মুসলমানদের উপকার হবে। এটি হবে সদকায়ে জারিয়া। যুগের পর যুগ হাজিরা এখান থেকে সেবা পাবেন এবং সঠিকভাবে হজ ও ওমরা পালন করবেন। এ ছাড়া যারা ধনাঢ্য আছেন, তাদের প্রতি অনুরোধ করব— তারাও যেন এ ব্যাপারে এগিয়ে আসেন।
খবরের কাগজ: হজ পালনেচ্ছু প্রত্যেক বাংলাদেশির কোন কোন বিষয়ে প্রস্তুতি ও সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি?
তসলিম: হজ একটি ধৈর্যের যাত্রা। কষ্টমিশ্রিত আমল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, হজ এক প্রকারের জিহাদ। সুতরাং হজের কষ্টগুলো মেনে নিতে হবে। প্রায় ৩০/৪০ লাখ মানুষকে একই সময় একই স্থানে একই আমল করতে হয়—এর ব্যবস্থাপনা করাটা খুব সহজ নয়। সুতরাং এখানে ধৈর্যধারণের কোনো বিকল্প নেই। আরও মনে রাখতে হবে, এটা কোনো সাধারণ সফর নয়। লৌকিকতা, দাম্ভিকতা কিংবা আভিজাত্য প্রকাশের সফর নয় এটি। এ সফরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিজেকে সংযত রাখতে হবে।
খবরের কাগজ: সোস্যাল মিডিয়ার অনেক পোস্টে দেখা যায়— বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশের তুলনায় বাংলাদেশ থেকে হজ পালনের খরচ অনেক বেশি। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাচ্ছি...
তসলিম: সোস্যাল মিডিয়ায় দেখা যায়, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া বা অন্যান্য অনেক দেশ থেকে ২ লাখ, ৩ লাখ টাকায় হজে যাওয়া যায়। অনেকে লেখেন, বাংলাদেশ থেকে বেশি টাকা নেওয়া হচ্ছে। তারা সরকার, কর্তৃপক্ষ বা হাবকে দোষারোপ করেন। মানুষের এই জানাটা ভুল। কোনো দেশ থেকেই এত কম টাকায় হজে যাওয়ার সুযোগ নেই। এসব প্রচারণায় তথ্যগত অনেক ঘাটতি রয়েছে। এটাকে আমি নিছক অপপ্রচার ছাড়া অন্য কিছু বলতে চাই না। এ ব্যাপারে সবার সচেতনতা কামনা করি।
তবে বাংলাদেশের হজের প্যাকেজ আরও কম হওয়া উচিত। হজের খরচ কমানোর জন্য হাব সবসময় সব ধরনের চেষ্টা করে থাকে। সরকারও করছে, ধর্ম মন্ত্রণালয়ও করছে। এ ক্ষেত্রে আমি বিশেষভাবে অনুরোধ করব—বিমান ভাড়া আরেকটু কমানো সম্ভব হলে, হজ প্যাকেজ আরও কমানো সম্ভব।
এ ছাড়া আমরা সৌদি আরবের প্যাকেজও কমনোর চেষ্টা করছি। আশার কথা হলো—২০২৩ সালের হজের প্যাকেজ থেকে ২০২৪ সালের হজের প্যাকেজ ৯০ হাজার টাকা কমেছে। অথচ ২৩ থেকে ২৪ সালে কিন্তু কোনো সেবা বা খাদ্যের দাম কমেনি।
খবরের কাগজ: আপনার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত আল-রশিদ ফাউন্ডেশন নিয়ে কিছু বলুন...
তসলিম: আল-রশিদ ফাউন্ডেশন মূলত একটি সমাজসেবামূলক সংস্থা। অসহায়, গরিব এবং দুস্থ মানুষদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করা হয় এ সংস্থা থেকে। আল-রশিদ ফাউন্ডেশনের নানা কর্মমুখী অর্জন রয়েছে। করোনা মহামারী চলাকালে এ সংস্থা নিজস্ব অর্থায়নে সারা বাংলাদেশের মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মৃতের পরিবহন, গোসল ও দাফন-কাফন সম্পন্ন করেছে।