
অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস পূর্ণ হলো। এ সময় অর্থনীতিতে স্বস্তি ফেরাতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিছু সংস্কারের সুফল পাওয়া গেছে। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, পুরোপুরি স্থিতিশীলতা আসতে আরও সময় লাগবে।
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকারের শেষ সময়ে অর্থনীতির সব কটি সূচকই ছিল নড়বড়ে। গত ৫ আগস্ট মাসে যখন রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে, অর্থনীতি তখন রীতিমতো সংকটে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকার কিছু পদক্ষেপ নেয়, যার ফলে অর্থনীতিতে অস্থিরতা কমার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। তবে কিছু ঝুঁকি এখনো রয়েই গেছে। পটপরিবর্তনের পরপরই গতি বেড়েছে রেমিট্যান্স মজুদে। আগস্ট থেকে প্রতিমাসে টানা দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি করে রেমিট্যান্স আসছে দেশে। পাশাপাশি বাড়ছে রপ্তানি আয়। স্থিতিশীল হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার। রিজার্ভও মোটামুটি সন্তোষজনক অবস্থায় আছে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাসহ নানা ধরনের সংকটেও বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। টানা চার মাস ধরে ৪ বিলিয়ন মানে ৪০০ কোটি ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ৪৪৪ কোটি ডলার রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ বেশি। আর আলোচ্য অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই থেকে জানুয়ারি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১২ শতাংশ।
সর্বশেষ গত মাসে (জানুয়ারি) রেমিট্যান্স এসেছে ২১৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এটি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। অর্থনীতির এই দুটি সূচক ইতিবাচক হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্বস্তিদায়ক অবস্থানে রয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
সুখবর হলো, চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত দেখা দিয়েছে। কমেছে বাণিজ্য ঘাটতিও। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাস জুলাই-নভেম্বরে চলতি হিসাবে যেখানে ঘাটতি ছিল ১৯ কোটি মার্কিন ডলার, সেখানে ডিসেম্বর শেষে উদ্বৃত্ত হয়েছে ৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার। অন্যদিকে অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি ছিল ৫৬ কোটি ডলার। ডিসেম্বরের শেষে সেটি ১৩৮ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত হয়েছে। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) বাণিজ্যঘাটতি কমে ৯৭৬ কোটি ডলারে নামে। এর আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে বাণিজ্যঘাটতি ছিল ১ হাজার ৮৮ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলেছে, চলতি হিসাবে ঘাটতি কমা বা উদ্বৃত্ত হওয়া অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। গত ছয় মাসে রেমিট্যান্স ২৭ দশমিক ৭ শতাংশ ও রপ্তানিতে ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে এ সময়ে আমদানি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। এ সময়ে বিদেশি মুদ্রা বাইরে যাওয়ার তুলনায় দেশে প্রবেশের গতি বেশি ছিল। এ কারণে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত দেখা দিয়েছে। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। নতুন বিনিয়োগ থমকে আছে। ভোগ্যপণ্যের আমদানি ঠিক আছে। এ সূচক আমাদের অর্থনীতির জন্য ভালো সংবাদ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক হবে এটি।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, অর্থনীতির অবস্থা যতটা খারাপ ভাবা হচ্ছে, ততটা খারাপ নয়। অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে- এই মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অবস্থা কখনই শ্রীলঙ্কার মতো হবে না। আগামী বাজেটে ভালো কিছু পদক্ষেপ দেখতে পাবেন।’ সম্প্রতি সচিবালয়ে ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি। মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বৃদ্ধির কারণে মানুষ চাপে পড়েছে- এ কথা স্বীকার করে সালেহউদ্দিন বলেন, বাস্তবে যতটা না ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে, ব্যবসায়ীরা তার চেয়ে বেশি দাম বাড়িয়েছেন।
বর্তমান সরকার অর্থনীতিতে স্বস্তি ফেরাতে নানাভাবে চেষ্টা করলেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে এখনো। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- রাজস্ব আদায় ঘাটতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থানের অভাব, বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমা, অস্থির পুঁজিবাজার ও বৈদেশিক বিনিয়োগে ভাটা।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘দেশে রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতা না থাকলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ছয় মাস হতে চলল। গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে এটা খুবই কম সময়। তবে সরকারকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য স্থিতিশীল বিনিময় হার দরকার, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়াতে হবে, জ্বালানির দাম কমানোর সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা উচিত। দেশে গ্যাসের অনুসন্ধান বাড়াতে হবে এবং শিল্পে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি।’
সরকারের ব্যয় বাড়ছে। অথচ, রাজস্ব আদায়ে পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আলোচ্য অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সামগ্রিকভাবে ঘাটতি হয়েছে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, আলোচ্য সময়ে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রাজস্ব ১০ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি নেগেটিভ বা ঋণাত্মক হয়েছে। এনবিআরের সাবেক সদস্য ও রাজস্ব-সংক্রান্ত সংস্কার কমিটির অন্যতম সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘এমন খারাপ অবস্থা আগে খুব কমই দেখা গেছে। ভ্যাট, কাস্টমস ও আয়কর- এই তিনটি উৎস থেকে আদায় নেগেটিভ হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় এনবিআর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি সভা ডেকে আদায় কীভাবে বাড়ানো যায়, তার একটি কর্মপরিকল্পনা করা জরুরি।’
মূল্যস্ফীতি এখনো বড় চ্যালেঞ্জ : নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার চাঁদাবাজি ও মজুদদারি মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি এখনো। মধ্যস্বত্বভোগীদের নেটওয়ার্ক ভাঙতে না পারা এবং অযৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের মতো অনিয়ম বন্ধ করতে না পারায় সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমাতে পারেনি। চাল, পেঁয়াজ, সয়াবিন তেল, আলুসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে আমদানিতে শুল্ক কমানোর পরও এর সুফল ভোক্তা পাচ্ছেন না। যে কারণে মূল্যস্ফীতির পারদ এখনো চড়া। তবে বিবিএসের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে তার আগের মাসের তুলনায় মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। যদিও খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থউপদেষ্টা নিজেও স্বীকার করেন, ‘মূল্যস্ফীতি এখনো আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তবে অর্থনীতির যেকোনো সূচক একবার উঠলে তা নামতে সময় নেয়। মার্চ থেকে এটি নামতে শুরু করবে এবং আশা করছি, আগামী জুনে ৭ শতাংশে নেমে আসবে।’ সম্প্রতি সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি।
গত ৯ জানুয়ারি সরকার এক অধ্যাদেশ জারি করে প্রায় ১০০ পণ্যের ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে সারা দেশে ব্যবসায়ীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ব্যাপক সমালোচনার মুখে অবশ্য সরকার পোশাক, ওষুধসহ ৯টি পণ্য ও সেবা থেকে ভ্যাট কমিয়েছে। তার পরও ব্যবসায়ীরা আন্দোলন করছেন বাকি পণ্যের ওপর থেকে ভ্যাট ও শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য। এ প্রসঙ্গে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সরকার এমন সময়ে ভ্যাট বাড়িয়েছে, যে সময়ে সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট। মজুরির চেয়ে মূল্যস্ফীতি দ্বিগুণ। অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সুযোগ এসেছিল, প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর; কিন্তু সরকার সে পথে হাঁটেনি। তারা পরোক্ষ করের ওপর বেশি জোর দিচ্ছে।’
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, জনগণ যে কর দেয়, সরকার পুরোপুরি পায় না। সরকারের সুযোগ ছিল এসব জায়গায় হাত দেওয়ার; কিন্তু দেয়নি। তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেনি ভ্যাট বাড়াতে। তারা বলেছে কর বাড়াতে। কারণ, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আদায়ের হার সবচেয়ে কম; কিন্তু সরকার প্রত্যক্ষ কর না বাড়িয়ে পরোক্ষ কর বাড়িয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়ছে।’