২০২৩ সাল। আমার জীবনে বয়ে নিয়ে এল কু কু। খুলেই বলছি। বছরের প্রথম দিনেই ঘুম থেকে উঠে দেখি কথা বলতে পারছি না। গাল ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। দাঁতে প্রচণ্ড ব্যথা। ব্যথার তীব্রতায় টিকতে না পেরে এলাকার এক ডাক্তার দেখালাম। তিনি দেখে এক গাল হেসে বলল, ‘দুশ্চিন্তার কিছু নেই, আক্কেল দাঁত উঠতেছে।’ভাবটা এমন দেখাল যেন ‘ঘরে নতুন অতিথি আসছে’ সেই খবরটা দিচ্ছে। আমি কু কু করে বললাম, ‘ব্যথা কমানোর জন্য কিছু দেন।’ তিনি পেইন কিলার দিয়ে দিলেন।বাসায় এসে আম্মাকে বলতেই আম্মা বলল, ‘যাক এতদিনে আক্কেল হবে।’
ছোট ভাই তার সব দাঁত দেখিয়ে হেসে বলল, ‘একটা উঠলে তো হবে না। তোমার তো আরও তিনটা আক্কেল দাঁত ওঠার কথা।’
আমি কিছুই বলতে পারলাম না। যেখানে সবসময় বলি সেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলাম, ‘হাতি গর্তে পড়লে খরগোশও টিটকারি মারে।’ ব্যথার চোটে প্রথমে খরগোশকে ‘খরগোশত’ লিখে ফেলেছিলাম। দুপুরে ব্যথার ওষুধ খেয়ে ঘুম দিলাম, মনে আশা ব্যথার যদি পরিবর্তন হয়। ঘুম থেকে উঠে দেখি দুটি জিনিস পরিবর্তন হয়েছে। গাল আরও ফুলেছে এবং ব্যথা আরও বেড়েছে।
ছোট ভাই সেলফি স্টিক নিয়ে আমার ফোলা গালের সঙ্গে সেলফি তুলতে আসছিল। সেলফি স্টিক দিয়ে পিডাই রুম থেকে বাইর করছি। ব্যথার অবস্থা দেখে বুঝে গেলাম, ডেন্টিস্টের কাছেই যাওয়া লাগবে। কয়দিন আগে কোথায় যেন পড়েছিলাম ‘মহিলা ডাক্তারের কাছে রোগ নিরাময় দ্রুত হচ্ছে।’ সঙ্গে সঙ্গে বিখ্যাত মডেল কাম ডেন্টিস্ট ‘শায়লা নাইম’-এর কথা মন পড়ে গেল। অনেক কষ্টে তার কম্পাউন্ডারের নাম্বার জোগাড় করে কল দিলাম। নাম ধাম সব বলার পর তিনি বলল, ‘আপনার সিরিয়াল পড়ছে ৭২৩ নাম্বার। দেখাবেন ২০২৪ সালের জুনের ১৭ তারিখ।’
আমি কু কু করে বললাম, ‘ভাই ফাইজলামি করতেছেন নাকি?’
তিনি হেসে বলল, ‘ম্যাডামের সিরিয়াল লম্বা। কিছু করার নেই। এর আগে দেখানো সম্ভব না।’ আমি ফোন কেটে দিয়ে কাছেই এক ডেন্টিস্টের কাছে গেলাম। সিরিয়াল পড়ল ১৩। আমি বললাম, ‘ভাই ১৩ নাম্বারটা পরিবর্তন করা যায় না? এইটা আমার জন্য আনলাকি।’
ডেন্টিস্ট মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘ভাই সরেন তো। দিকদারি কইরেন না। ১৩ না নিলে আর আছে ২৭। চলব?’
আমি দিকদারি না করে বসে পড়লাম। মাত্র পাঁচ নাম্বার সিরিয়াল চলছে। এতক্ষণ আর কী করব। মোবাইল বের করলাম ব্রাউজ করার জন্য। দেখি নেট শেষ। নেট ছাড়া ডাক্তারের চেম্বারে ওয়েট করা আর পানি ছাড়া টয়লেটে যাওয়া একই কথা। একটু পরেই খেয়াল করলাম ডাক্তারের চেম্বারে ওয়াই-ফাই সাইন। কম্পাউন্ডারকে পাসওয়ার্ড জিজ্ঞাসা করলাম। সে বলল, ‘Teeth007.’
বাহ, জেমস বন্ডের দাঁত! ফ্রি ওয়াই-ফাই পেয়ে স্লগ ওভারের মতো শট শুরু করলাম। নেট ইউজ করতে করতে বিরক্ত হয়ে গেলাম। আমার ডাক আসছে না। বসে থাকতে থাকতে ডেন্টিস্ট নিয়ে জোকস মনে পড়ে গেল। এক ডেন্টিস্ট এক রোগীকে দাঁত তোলার সময় অনেকক্ষণ ধরে অভয় দিচ্ছিল। একদমই ব্যথা পাবেন না, এইতো হয়ে যাবে। একটু পর খুব সহজে দাঁত চলে এল। ‘এই দেখেন কোনো ব্যথাই পাননি।’ পরে দেখা গেল দাঁত না, রোগীর আলজিহ্বা চলে এসেছে।
অবশেষে আমার ডাক পড়ল। ডাক্তারের রুমে ঢুকে দেখি ডাক্তার আর তার দুই পাশে দুই সুন্দরী। এরা নিশ্চয় ইন্টার্ন করছে।
‘কী সমস্যা?’ ডাক্তার জিজ্ঞাসা করল।
‘আমার আক্কেল দাঁত উঠছে।’ আমার কথা শুনে দুই সুন্দরী খুক খুক করে হেসে ফেলল। মানুষের কষ্টে আজকাল সবাই হাসে। এই হলো দেশের অবস্থা।
‘কোনো সমস্যা নেই। ওয়াশ করে দিচ্ছি। নীলা তাকে ওয়াশ করে দাও।’ ডাক্তার এক ইন্টারনিকে আদেশ দিল। নীলা ওয়াশ করতে লাগল আর আমি ব্যথায় নীল হতে থাকলাম।
শেষ হলে ডাক্তারের ভিজিট ৫০০ টাকা দিয়ে বের হয়ে এলাম। আক্কেল দাঁতের আক্কেল সেলামি ৫০০ টাকা। আসার সময় কম্পাউন্ডারকে বললাম, ‘এই যে জেমস বন্ড ভাই গেলাম।’
কম্পাউন্ডার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল।
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে ওষুধ কিনতে গেলাম। সব ওষুধ দিয়ে ছেলেটি বলল, ‘ভাই ৪৫০ টাকা আসছে।’ আমি ৪৫০ টাকা দিয়ে চলে আসার আগে, কী মনে করে
বললাম, ‘ভাই সব ওষুধের দাম পাশে লিখে একটা ক্যাশ মেমো দেন।’ দোকানের ছেলেটা দেখলাম গাঁইগুঁই শুরু করল। ‘ভাই এখন ঝামেলা বেশি।’
‘আরে কীসের ঝামেলা? দেন দেন।’
ছেলেটি স্লিপ করে বলল, ‘ভাই ভুল হইছে। আসলে ৩৫০ টাকা আসছে।’
‘চমৎকার! একটা ভুলে ১০০ টাকা। এরকম দিনে ১০টা ভুল করলে তো দুদিন পর আপনি হাসপাতাল দিতে পারবেন।’
আমার দেখাদেখি আশপাশের আরও অনেকে ক্যাশ মেমো চাইতে লাগল। এইবার লও ঠেলা! বের হওয়ার আগে এক লোক বলল, ‘ভাই ক্যাশ মেমো ধইরা বুদ্ধির কাম করছেন।’
আমি আক্কেল দাঁত দেখিয়ে হেসে ফেললাম। মাত্র তো আক্কেল দাঁত উঠতেছে, সবই তার কেরামতি।
কলি